গল্প শিরোনাম / আগুলি সাহানা

গল্প
শিরোনাম / আগুলি
সাহানা

ধুলোমাখা রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে চলেছে আগুলি। রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো বড় বড় পাথরে ভর্তি। একপাশে নদীর ঢাল। অন্যদিকে চিরহরিৎ গাছের জঙ্গল….শুকনো ধুলোর ঝাপটা লাগে মুখে। দিনটা শুকনো। আগুলির মুখটা মুহূর্তে লাল হয়ে ওঠে….মাথার রুমালটা একটু টেনে নেয় দাঁড়িয়ে। থামার সময় তার কাছে নেই। একটা বড়ো ব্যাগে সে টেনে এনেছে জামাকাপড় আর প্রচুর কাপড়ের টুকরো। সব জমা দিতে হবে মহাজনকে। তার মত ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন দর্জি আছে সারা শহরে। কাজের অর্ডার নিয়ে আবার সময় মতো পৌঁছে দেয় তারা যথাস্থানে। রোদ-ঝড়-জল-বৃষ্টি কিছুই ওদের থামাতে পারে না, ওরা থামে না। একনাগাড়ে দু-তিন দিন কাজ করে অর্ডার জমা দিতে হয় নির্দিষ্ট দিনে।
এই মুহূর্তে আগুলি আছে প্রথম সারির দলে। দক্ষ কর্মী। টাকা পয়সা নিয়ে কোনোই ঝামেলা নেই তার। কোন চাহিদাও নেই।
বছর দুয়েক আগে স্বামী যোগ দিয়েছিল সেনাবাহিনীতে। পেটের দায় বড় দায়!
ছোট্ট শহরের একদল লোক বড় রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল! তারপর…..দুই দেশের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ! কামানের গোলার আঘাতে হঠাৎ উড়লো পা!
পঙ্গু অবস্থায় বহুদিন সামরিক হাসপাতালে ছিল!
আগুলি অসহায় চারটি ছেলেমেয়ে নিয়ে। একদম ছোটটি তো মাত্র চার!
পাহিল বেশিদিন কষ্টভোগ করেনি। এক শরতের সকালে ফুটফুটে রোদের মধ্যে হাসপাতালে পরিদর্শনে আসা কর্মকর্তার রিভলভার কেড়ে নিয়ে সোজা নিজের মাথায় ……খবরটা নিঃস্পন্দ করেছিল আগুলিকে।
যৌবন অক্ষুণ্ণ, তাই প্রচুর স্তাবক চারপাশে। কেউ ভালো, কেউ মন্দ।
এমন সময় এলো কারখানার মালিক গুস্তাভ। তিন তিনটে গারমেন্টস কোম্পানি তার। একদিকে ম্যানুফ্যাকচারিং এবং সাপ্লাই। সারা পৃথিবী জুড়ে তার ব্যবসা!
কিন্তু …..
আগুলির কর্মদক্ষতা ছাড়াও তার চাহিদা অন্য কিছুর।
প্রতিবার অর্ডারের ডেলিভারি নিতে সে নিজেই আসতো….নানা অছিলায়….
কফি তৈরি করে কিচেনের দরজাটা ভেজিয়ে বসতো তারা। বাচ্ছারা অন্য কামরায়।
কফির কাপ পেরিয়ে আঙুলগুলো চেপে ধরতো আগুলির হাত, ক্রমশঃ….খুব খারাপ লাগতো না লোকটাকে। আগুলি নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছিলো!
অনেক পরে আগুলি জেনেছিলো এই কাজ তাদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই হয়েছে! লোকটার চরিত্র সম্পর্কে একটা ঘিনঘিনে ভাব…..

একবার সরাসরি প্রতিবাদ করলো। এক থাপ্পড় লাগালো গালে।
গুস্তাভ একটু হাসলো। কঠিন তামাটে হাত দিয়ে মুখটা মুছে নিল!
“তোমাকে অন্য চোখে দেখতাম। এখন দেখছি, তুমি সেইরকম নও।
বেশ! আমি ব্যবস্থা করছি!”

ব্যবস্থা সে করেছিল।
আধ মাইল দূরে তার গুদামে গিয়ে ডেলিভারি দিতে হবে প্রতি সপ্তাহে। তবেই টাকা।

গুদামে চারজন রক্ষী আছে। সকলেই মিলিটারি ফেরত। বেশ কর্মঠ এবং শক্ত চেহারার লোক।
প্রথম দিনেই ধাক্কা খায় আগুলি।
গুস্তাভ বসে আছে কাঠের চেয়ারে। ওপর থেকে ঝোলা হলদে বাল্বের আলোতে ঘরটা কেমন আধা অন্ধকার! কোণায় কোণায় জমাট নিস্তব্ধতা। আগুলির সঙ্গে আরও চারজন ছিলো। তারমধ্যে একজন বয়স্কা।
মালপত্র বুঝে নিয়ে গুস্তাভ তাকালো সবার দিকে।
ঠোঁট চেটে বললো, “কাজ তো অনেক হলো। এসো একটু পান করা যাক।”
সুদৃশ্য বোতল থেকে আঙুরের রস ঢালল নীল গ্লাসে। মেয়েরা পা ছড়িয়ে বসলো গোল হয়ে। মিষ্টি রুটি, ফল আর নীল গ্লাসের পানীয়! একটা ঘোর লাগে!
অনেক পরে সম্বিত ফিরে যা দেখলো….সবাই প্রায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে….বেসামাল বেশবাস আর শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা! গুস্তাভ আর তার সঙ্গীরা কেউ নেই!

সেই ঘটনার পর প্রায় দু’মাস কেটেছে। এখন তো প্রতি সপ্তাহে যেতেই হয়। পেটের দায়! তবে সেই মর্মান্তিক যন্ত্রণা আর নেই! স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছে দলের অনেকেই। শক্তিশালী মানুষের সঙ্গে সংঘাতে যাওয়া কাজের কথা নয়!

থানায় গিয়েছিল আগুলি। দুজনকে
নিয়ে।
সেপাই এবং অফিসার দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলো।
যেন তাদের কোন চরিত্রই নেই!
অসহায় মনে হয়েছিলো নিজেকে! চারটে ছেলেমেয়েকে মানুষ করার দায়িত্ব আছে তার। বড়ো আর মেজো ছেলেকে ইতিমধ্যেই রুটি কারখানায় ঢুকিয়েছে! প্রভাবশালী গুস্তাভ যদি সেটা বন্ধ করে দেয়!

গুস্তাভ সেটি করেনি। বদলে একদিন তার বাড়ির গেটে এসে দাঁড়িয়েছিলো। আগুলি ঝটপট বেরিয়েই দ্যাখে সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দুই মেয়ের দিকে। প্রজাপতির মতো দুটি বাচ্ছা তখন বাগানে ছোটাছুটি করছিলো!

আগুলি বোঝে, বিপদ অনেক!
মিষ্টি হেসে ভেতরে ডেকে আনে। কফি এবং কেক পরিবেশন করে।
গুস্তাভও হেসে গোঁফে তা দেয়। পাখি ধরা দিয়েছে!
ভুল!!
পাখি ধরা দেয়নি!
আজ আগুলির হাত ব্যাগে রয়েছে একটা হাতুড়ি, দুটো কাঁচি আর ……একটা বাঁকা ধারালো ছোরা! এক বোতল পুরনো দ্রাক্ষা রসও আছে। একটা বুনো, বিষাক্ত  লতা….মিশ্রণ তৈরি করে পানীয়ে মেশালে পক্ষাঘাত নিশ্চিত, সেটাও আছে!
আজ আঘাত হানার দিন!
আগুলির মতো আরও দশজনের দল আসছে শহরের বিভিন্ন রাস্তা ধরে। একটু একটু করে ওরা এগিয়ে চলেছে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে।
ওদের সবার মনে একটাই গুনগুনানি….
আমরা বাঁচি –
আত্মসম্মানে,
আত্মমর্যাদায়-
নিজের দায়িত্বে নিজেরাই!
আজও,
আমরা ক্ষমতায় বাঁচি,
আমরা_আশায়_বাঁচি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *