* অথ-তুলসী কথা * গীতালি ঘোষ
* অথ-তুলসী কথা *
গীতালি ঘোষ
গ্রামে গঞ্জে প্রতিটি বাড়িতেই তুলসীমঞ্চ থাকে, প্রতিদিনের যত্নে তুলসীগাছ সজীব হয়ে হেসে খেলে ওঠে। গৃহবধূরা সকাল সন্ধ্যায় সেই তুলসীমূলে প্রদীপ জ্বাললিয়ে পুজো করে। তুলসীর হাওয়া গৃহাঙ্গনকে পবিত্র রাখে, রোগমুক্ত রাখে। কিন্তু এই তুলসীগাছেরও এক উৎস কাহিনী আছে। আজ বলি তার কথা।
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ অনুসারে তুলসী ছিলেন কৃষ্ণপ্রিয়া রাধিকার এক সহচরী। কোনো একদিন তুলসীকে রাধিকা তাঁর প্রিয়তম কৃষ্ণের সঙ্গে ক্রীড়ারত অবস্থায় দেখেন। প্রচণ্ড ক্রোধে রাধিকা তুলসীকে অভিশাপ দেন যে তিনি মর্ত্যে মানবীরূপে জন্মগ্রহণ করবেন। তুলসীর অনুরোধে শ্রীকৃষ্ণ এই অভিসম্পাত কিছুটা লঘু করে বলেন যে তুলসী মানবীরূপে জন্মগ্রহণ করলেও কঠোর তপস্যা দ্বারা তুলসী কৃষ্ণের একাংশ লাভ করতে সক্ষম হবেন।
এরপরে রাধিকার অভিশাপে তুলসী রাজা ধর্মধ্বজের স্ত্রী মাধবীর গর্ভে তুলসী নাম নিয়েই জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ধীরে ধীরে ব্রহ্মার তপস্যায় মনোনিবেশ করেন এবং সেই কঠোর তপস্যায় বিচলিত হয়ে তাঁকে তাঁর ঈপ্সিত বর দিতে চান। তুলসী নারায়ণকে স্বামীরূপে কামনা করেন। কিন্তু ব্রহ্মা বলেন যে তুলসীকে প্রথমে কৃষ্ণের অঙ্গসম্ভূত সুদামকে বিবাহ করতে হবে। পরে তুলসী কৃষ্ণকে লাভ করবেন।
এদিকে সুদাম শঙ্খচূড় নাম নিয়ে দানবগৃহে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীরাধিকার অভিশাপে। তুলসীকে ব্রহ্মা আরও বলেছিলেন যে নারায়ণের শাপে তুলসী বৃক্ষরূপে জন্মগ্রহণ করবেন এবং তুলসী ব্যতীত নারায়ণের পূজা ব্যর্থ হবে। সেই কারণেই তুলসীকে পারম্পর্য অনুসারে পথ পরিক্রমা করতেই হবে। আদেশ অনুযায়ী তাঁর সঙ্গে বিবাহ হয় শঙ্খচূড়ের।
দেবতাদের প্রতি শঙ্খচূড়ের পরপর অত্যাচারে অস্থির হয়ে ব্রহ্মাকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা শিবের শরণাপন্ন হলেন। অপরদিকে শঙ্খচূড় বর লাভ করেছিল যে তাকে বধ করা অত্যন্ত কঠিন হবে। একমাত্র তার স্ত্রীর সতীত্ব কোনোক্রমে নষ্ট হলেই শঙ্খচূড়কে হত্যা করা সম্ভব হবে। দেবতাদের দুর্দশায় কাতর হয়ে নারায়ণ এক উপায় স্থির করলেন। প্রবল পরাক্রমশালী শিবকে তিনি শঙ্খচূড়ের সঙ্গে যুদ্ধে পাঠালেন ও এই সুযোগে শঙ্খচূড়ের রূপ ধরে নারায়ণ তুলসীর সতীত্ব নাশ করেন। শঙ্খচূড় এইসময় শিবের হাতে নিহত হন। স্বামীর মৃত্যুতে তুলসী কাতর হয়ে নারায়ণের চরণে পতিত হন। কিন্তু তুলসী জ্ঞাত হন যে শঙ্খচূড়কে হত্যার জন্য নারায়ণ শঙ্খচূড়ের রূপ ধরে তাঁর সতীত্ব নাশ করেন। তুলসী নারায়ণকে অভিশাপ দিয়ে বলেন যে নারায়ণ পাষাণে পরিণত হবেন। নারায়ণ তখন তুলসীকে বলেন যে তিনি গণ্ডকী নদী হয়ে উৎপন্ন হবেন এবং তাঁর কেশ থেকে তুলসী বৃক্ষের উৎপত্তি হবে। সেই সময় থেকেই নারায়ণ শিলারূপে তুলসীযুক্ত হয়ে অবস্থান করেন।
পদ্মপুরাণ মতে কাহিনীটি অন্য। জলন্ধর নামে এক অসুর ইন্দ্রকে পরাস্ত করেন এবং ইন্দ্র তখন শিবের শরণ নেন। জলন্ধরের পতিব্রতা স্ত্রী ছিলেন বৃন্দা। শিব ও জলন্ধরের যুদ্ধ অনিবার্য দেখে বৃন্দা স্বামীর প্রাণরক্ষার জন্য বিষ্ণুর পূজায় মনোনিবেশ করেন। বিষ্ণু উপায়ান্তর না দেখে ছলনা করে জলন্ধরের রূপ ধারণ করেন। বৃন্দা বিষ্ণুপূজা অসমাপ্ত রাখেন।ফলে জলন্ধরের মৃত্যু হয়। সব কিছু জানার পরে বৃন্দা বিষ্ণুকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হলে বিষ্ণু তাকে সহমৃতা হতে বলেন। আরও বলেন যে বৃন্দার শরীরের ভস্ম থেকে তুলসী,ধাত্রী, পলাশ এবং অশ্বত্থ এই চারপ্রকার বৃক্ষ উৎপন্ন হবে। তাই বৃন্দা থেকেই তুলসীর উৎপত্তি।
অপর একটি মত থেকে জানা যায় যে বৃন্দার সতীত্ব অক্ষুন্ন থাকতে জলন্ধরের মৃত্যু হবে না জেনে বিষ্ণু জলন্ধরের রূপ ধারণ করে বৃন্দার সতীত্ব নাশ করেন। এ কথা জ্ঞাত হয়ে বৃন্দা বিষ্ণুকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হলে বিষ্ণুর বরে সকলের পূজ্যা হয়ে বৃন্দা হতে তুলসীর জন্ম হয় এবং তুলসী ব্যতীত বিষ্ণুপূজা সার্থক হয় না।
(তথ্যসূত্র : বিভিন্ন পুরাণ)