“খাদ” কলমে -: মমতা শঙ্কর সিনহা(পালধী)
নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে নিবেদন করছি আমার স্বরচিত গল্প “খাদ”
নাটক/গল্প/কথোপকথন-:”খাদ”
কলমে-:মমতা শঙ্কর সিনহা(পালধী)
#প্রথম দৃশ্য#
অনুসূয়া ও অচিন্তবাবু দুজনে মধ্যবিত্ত পরিবারের দম্পতি যুগল।অচিন্তবাবু আজ রবিবার হওয়ায় একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে খবরের কাগজ নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলেন আর গিন্নিকে এককাপ চা দিতে বললেন।
স্বামীর নয় আজ ছুটির দিন।অফিসের তাড়া নেই।তাই তিনি দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছেন।অথচ অনুসূয়ার তো ৩৬৫ দিনই সংসারের অফিসে পরিশ্রম করে যেতেই হয়।অচিন্তবাবুর ডাকে সাড়া দিয়ে অনুসূয়াদেবী রান্নাঘর থেকে গলদঘর্ম হয়ে এককাপ গরম চা নিয়ে স্বামীর সামনে দিলেন।হাতের বাজারের ব্যাগটা অচিন্তবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে অনুসূয়া বললেন চা’টা খেয়ে বাজার যাবে।আর মনে আছে তো তোমার আজ দীপা’কে (দীপাঞ্জনা অনুসূয়াদেবী আর অচিন্তবাবুর একমাত্র আদরের মেয়ে)পাত্রপক্ষ বিকালে দেখতে আসবে।ওদের জন্য একটু ভালো মিষ্টি নিয়ে এসো।
#দ্বিতীয় দৃশ্য#
সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো।আজ রবিবার হওয়ায় অচিন্তবাবুর বাড়িতে একটু ভালোমন্দ খাবার হয়েছে দুপুরে। খেতে বসে বাবা-মার সাথে দীপা খোস মেজাজে তার কলজের সহপাঠীদের সঙ্গে মেলামেশা,কথাবার্তা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে।দীপা বলছে,জানো বাপী—এবার তো আমার ফাইনাল ইয়ার তোমরা আমার বিয়ের বিষয়টা নয় একটু পরেই ভাবনা চিন্তা করতে পারতে।এতে আমার পরীক্ষার ক্ষতি হতে পারে।বাপী-মা তোমরা ছেলের বাড়িরতে বলেছ— তো, যে আমি গানে ডিপ্লোমা করেছি ভবিষ্যতে গান নিয়ে আমি কিছু একটা করতে চাই,আবার আমি চাকরিও করব।নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।তোমারা এত তাড়াহুড় করছো কেন ? ওরা যদি এসব না মেনে নেয়ে তাহলে তো পরবর্তি সময় অশান্তির সৃষ্টি হবে!
মেয়ের মাথায় হাত রেখে অচিন্তবাবু মেয়েকে বললেন আমি ওদের সাথে ফোনে তো সব কথা খুলে বলেছি।ওরা সব শুনে তোমাকে দেখতে আসতে রাজি হয়েছেন। এর সাথে সাথে অনুসূয়াদেবী দীপাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন আজকাল সরকারি চাকুরী করা ছেলের বড্ড অভাব।সেই দিক থেকে দেখতে গেলে অতনু পাত্র হিসাবে মনে হয় ভালোই হবে।
#তৃতীয় দৃশ্য #
রবিবার বিকাল পাঁচটার সময় ছেলে অতনুকে সাথে নিয়ে মল্লার সেন ও হৈমন্তীদেবী অচিন্তবাবু ও অনুসূয়াদেবীরএকমাত্র দীপাঞ্জনাকে দেখতে আসলেন।অতিথিদের অভর্থনা পর্ব শেষে অচিন্তবাবু অনুসূয়াকে মেয়েকে নিয়ে আসতে বললেন পাত্রপক্ষের সামনে।দীপা’কে নিয়ে অনুসূয়াদেবী হাজির হলেন পাত্রপক্ষের সামনে।বেশ কিছুক্ষণ সকলের সাথে কথোপকথন ও পাত্র পাত্রীর আলাপচারিতার শেষে পাত্র অতনুর বাবা-মা বললেন দীপা’কে তাদের পচ্ছন্দ হয়েছে।তারা বাড়ি ফিরে একটু আলোচনা করে বিয়ের পাকা কথা কবে বলবেন তা ফোন করে জানিয়ে দেবেন বলে সৌজন্য বিনিময় করে সেদিন দীপাঞ্জনাদের বাড়ি থেকে চলে আসলেন।
#চতুর্থ দৃশ্য#
মল্লারবাবু ও হৈমন্তীদেবী সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে আজ দু একদিনের ধরে স্বামী স্ত্রী উভয়ের মধ্যে অনেক আলোচনার পর ঠিক করলেন দীপাঞ্জনার সাথেই তাদের একমাত্র ছেলে অতনুর বিয়ে দেবেন।কিন্তু অচিন্তবাবুর কাছ থেকে বরপণ হিসাবে দুলক্ষ টাকা নেবেন এছাড়া তিনি তার একমাত্র মেয়েকে বিয়েতে যা গয়নাগাটি, আসবাবপত্র যা দেওয়ার সে তো দেবনেই। যেমন ভাবা তেমন কাজ।
আজ বুধবার পাঞ্জি দেখে হৈমন্তীদেবী স্বামীকে বললেন আগামী শুক্রবার একটা ভালোদিন আছে তুমি ঐ দিন অচিন্তবাবুদের ফোন করে বিয়ের জন্য পাকা কথা বলো।মল্লারবাবু অফিস থেকে ফিরে স্ত্রীর কথা শুনে সহমত প্রকাশ করলেন এবং অচিন্তবাবুকে শুক্রবার যথা সময়ে ফোন করে অতনু আর দীপাঞ্জনার বিয়ের জন্য পাকা কথা বলার দিনক্ষণ ঠিক করলেন।
#পঞ্চম দৃশ্য#
২২শে শ্রাবণ রবিবার মল্লার সেন ও হৈমন্তীদেবী এলেন অচিন্তবাবুদের বাড়ি পাকা কথা বলতে।অনেক কথোপকথন এর পর ঠিক হলো আগামী ১২ই অঘ্রায়ণ অতনু আর দীপাঞ্জনার চারহাত এক হবে সামাজিক ও আইনী উভয় মতে।আগামী ১০ই আশ্বিন আশীর্বাদের দিনই অচিন্তবাবু মল্লারবাবুর হাতে বরপণের দুলক্ষ টাকা তুলেদেবেন আর যা যা দেবার আছে মেয়েকে বিয়ের দিনই… কথা ভেবে হাতছাড়া করতে পারলো না।
যথা সময়ে ১২ই অঘ্রায়ণ অতনু আর দীপাঞ্জনার শুভ বিবাহ সুসম্পন্ন হলো।
#ষষ্ঠ দৃশ্য #
শ্বশুর বাড়ীর পরিবেশ প্রথম প্রথম বেশ ভালোই লাগছিলো দীপাঞ্জনার। সে তার কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে বসলো চাকরির পরীক্ষায়।সাথে সাথে গানেরও চর্চা চলছিলো বেশ ভালোই।ইতি মধ্যে অতনু আর দীপাঞ্জনা দার্জিলিঙের এর পাহাড়ি মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে তাদের মধুচন্দ্রিমাও উদযাপন করে এসেছে।
এইভাবে এক বছর প্রায় অতিক্রান্ত দীপাঞ্জনা আর অতনুর বিবাহের।এক দিন দুপুরে ডাইনিং টেবিলে সবেমাত্র খাবার খেতে বসেছে দীপাঞ্জনা ও তার শ্বাশুড়ি হৈমন্তীদেবী ।সেই সময় হঠাৎই কলিংবেল বেজে উঠলো।একটু বিরক্ত হয়ে হৈমন্তীদেবী বললেন এখন আবার কে এলো!!
দীপাঞ্জনা যাও তো দেখো কে এসেছে!দীপাঞ্জনা দরজা খুলতেই পিওয়ন তাকে জিজ্ঞেস করলো দীপাঞ্জনা রায় কে আছেন? দীপা বলল আমিই দীপাঞ্জনা রায়।বলুন কি ব্যাপার। ম্যাডাম আপনার নামে একটি রেজিস্ট্রি চিঠি আছে।এখানে একটা সই করুন।দীপাঞ্জনা সই করে হাতে চিঠিটি নিয়ে ঘরে গিয়ে শ্বাশুড়ি মাকে সব কথা বললে তার মুখটা যেনো কেমন একটু বিবর্ণ হয়ে গেলো। ছেলের বউ এর এই সফলতা তিনি যেনো ঠিক মন থেকে মেনে নিতে পারলেন না।
#সপ্তম দৃশ্য#
অনেক দিন ধরেই হৈমন্তীদবী আর মল্লারবাবু দীপাঞ্জনাকে কি যেনো একটা বলতে গিয়েও বলতে পারছেন না।অতনুর সামনে তো আর দীপাঞ্জনাকে তারা কিছু বলতে চান না।যাতে ছেলে তাদের খারাপ চোখে দেখে।
দীপাঞ্জনার চাকরির জন্য দুলক্ষ টাকা দরকার সেই টাকা অতনু দেবে বললেও মল্লারবাবু ও হৈমন্তীদেবীর অশান্তির কারণে সে তা দিতে পারে না।অগত্যা দীপাঞ্জনার বিয়ের গয়না বিক্রি করতে হয়।কিন্তু তাতেও পুরো টাকার জোগাড় না হওয়াতে শ্বাশুড়ি মা দীপাকে বলেন “তোমার বাবার তুমি তো একমাত্র মেয়ে।আর সেই মেয়ের বিয়েতে তিনি কিনা খাদ মেশানো গয়না দিয়েছেন!যে গয়না বিক্রি করে তোমার চাকরির জন্য দুলক্ষ টাকাও জোগাড় করা গেলো না!”
ছিঃ ছিঃ যখন ক্ষমতা ছিলো না মেয়ের বিয়েতে খাঁটি গয়না দেবার তখন মেয়ের জন্ম দিয়েছেন কেনো?
দীপাঞ্জনা সে কথা শুনে ভীষণ কেঁদে ছিলো।কিন্তু সেদিন সে শ্বাশুড়িকে উপযুক্ত জবাবও দিয়েছিলো।বলেছিলো-মা আপনার ছেলের সরকারি চাকরির করে বলে আমার বাবার কাছ থেকে আপনারই তো বরপণ হিসাবে হাতপেতে দুলক্ষ টাকা নিয়ে ছিলেন বিয়েতে।তারপর তো আসবাবপত্র, গয়না সবই তো দিয়েছে আমার বাবা একাই।জানেন তো মা আজ আমার কি মনে হচ্ছে আমার বাবা গয়নায় খাদ মেশায় নি বরং তার একমাত্র আদরের মেয়েকে সরকারি চাকুরিরত পাত্রের সাথে বিয়ে দিয়ে খাদের ধারে ঠেলে দিয়েছিলেন।আজ আমি যদি আমার বাবার দেওয়া সেই পণের দুলক্ষ টাকা আপনাদের কাছে চাই তাহলে কি স্ব-সম্মানে আপনারা আমাকে সেই টাকা ফিরিয়ে দিতে পারবেন?পারবেন না–পারবেন না—আপনাদের সে বিবেকবোধ নেই।
আমার বাবার মেয়ের জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা ছিলো কারণ তিনি তো আমাকে সব দিয়েছেন। তাই আমি গর্বিত আমার বাবা-মার জন্য। কারণ ওনারা আমার বাবা-মা বলে।আর আপনারা কি করেছেন একবার ভাবুন। নিজের ছেলের বিয়েতে আমার বাবার কাছে হাত পেতেছেন বরপণের দুলক্ষ টাকার জন্য। তাই বলি কি মা —আপার ছেলের জন্ম দেওয়াটাই কি ভুল ছিলো না মা??
#অষ্টম দৃশ্য #
হৈমন্তীদেবীর আর সত্য কথাগুলো সহ্য হলো না ।তিনি দীপাঞ্জনার গায়ে হাত তুলতে গেলেন।অতনু এতক্ষন বাইরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো। প্রবল বিবেকের দংশনে মায়ের হাত ধরে ফেলে সে দীপাঞ্জনাকে বলল আমায় তুমি ক্ষমা করা দীপা।বাবা-মার হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থী।আজ আমি সবটাই বুঝতে পারছি।তোমার গয়না আমি আবার সব নতুন করে গড়িয়ে দেবো।আর তোমার চাকরির জন্য দুলক্ষ টাকাও আমিই দেবো।কারণ বারন আমি আর শুনছি না।অতনু মাকে বলল জানো তো মা তোমরা শ্বাশুড়িরা কেনো বউমাদের নিজের মেয়ে বলে মেনে নিতে পারো না ।এত দ্বিধা,বিদ্বেষ কিসের? তুমিও তো মা একদিন আমার বাবার সাথে বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে এসেছিলে।সেদিন যদি আমার ঠাকুমা বা দাদু তোমার সাথে এ রকম ব্যবহার করতেন সেদিন কি হত মা ? একবার ভাবো তো? আর যদিও বা সে রকম কিছু ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে তুমি আর তোমার ছেলের বউ এর সাথে তার পুনরাবৃত্তি না ঘটিয়ে ওকে আপন করে নিজের কাছে টেনে নাও–,
দেখবে সব কেমন সহজ হয়ে গেছে।
সব শেষে আজ দীপাঞ্জনার ও অতনু দুজনেই চাকুরিরত।তারা তাদের সন্তান ও বাবা-মাকে নিয়ে এক সুখী দম্পতি।
—————–সমাপ্ত————