জীবনবিজ্ঞান সম্পর্কিত কিছু কথা- পর্ব ৭ ✍️ডরোথী দাশ বিশ্বাস
জীবনবিজ্ঞান সম্পর্কিত কিছু কথা- পর্ব ৭
✍️ডরোথী দাশ বিশ্বাস
প্রকৃতির মাঝে হাতে কলমে শিক্ষা পাঠ্যবই-এর নীরস বিষয়কে ও প্রকৃতির জীববৈচিত্র্যকে শিক্ষার্থীদের কাছে সুন্দর সহজবোধ্য করে তুলে ধরে ছাত্রছাত্রীদের সাহসী, শৃঙ্খলাপরায়ণ, সময়ানুবর্তী ও মানবিক করে গড়ে তোলার ভাবনা নিয়েই সংঘটিত হতে পারে একদিনের প্রকৃতি পাঠ শিবির। এমনই একটি এক দিনের শিক্ষামূলক ভ্রমণ প্রকৃতি পাঠ শিবির সংঘটিত হয়েছিলো ভবেশ চন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীবৃন্দ দ্বারা, যেখানে জীবনবিজ্ঞান শিক্ষিকা হিসেবে আমিও উপস্থিত ছিলাম। প্রকৃতিপাঠ শিবির সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন কিরূপ হয় তা জানতে- নিম্নে ঐ প্রকৃতিপাঠ শিবির সংক্রান্ত ফিল্ড রিপোর্টটি পুঙ্খানুপুঙ্খ লিপিবদ্ধ করা হলো:
নির্বাচিত স্থানের পরিচয়, অবস্থান, শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও বিদ্যালয়ের শিক্ষিকাদের দ্বারা যথাযোগ্য ব্যবস্থাপনার বিবরণ:
১) স্থানের নাম: CPCRI, RC মোহিতনগর, জলপাইগুড়ি।
২) ভ্রমণপথ: ভবেশচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়, শিরিষতলা থেকে মোহিতনগর, জলপাইগুড়ি।
৩) শিক্ষামূলক ভ্রমণের সময়সীমা: একদিন
বেলা সাড়ে দশটা থেকে বেলা দুটো পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
৪) শিক্ষার্থীর সংখ্যা:
ক) পঞ্চম শ্রেণী-
খ) ষষ্ঠ শ্রেণী-
গ) সপ্তম শ্রেণী-
ঘ) অষ্টম শ্রেণী-
ঙ) নবম শ্রেণী-
চ) দশম শ্রেণী-
মোট- ৩২ জন
৫) শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মী- ১০ জন
৬) শিক্ষামূলক ভ্রমণের বর্ণনা- ভবেশচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীবৃন্দ ২৯৷০৫৷২০২৩ শিক্ষার্থীদের নিয়ে জলপাইগুড়ির মোহিতনগর CPCRI, RCতে একটি একদিনের শিক্ষামূলক ভ্রমণ সংঘটিত করেন। ঐ দিন ছাত্রীদের সকাল সাড়ে দশটায় বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছিলো। সবাই ছাতা, জল, পেন,একটা করে খাতা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো। শ্রেণী শিক্ষিকারা বলে দিয়েছিলেন– টিফিন ওখানে দেওয়া হবে। প্রজেক্টের নম্বর আছে এর ওপর। আশেপাশের ছাত্রীদেরও খবর দিতে বলেছিলেন। আমরা ১১টায় ই.রিক্স করে স্কুল থেকে রওনা দিলাম। আমরা ১১-২০ টার সময় মোহিতনগর ফার্মে পৌঁছোলাম।এটি একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা।
এই সংস্থার কার্যক্রম ও লক্ষ্য হলো:
১) দেশী ও বিদেশী ভ্যারাইটির সুপারী জার্মপ্লাজমের মূল্যায়ণ
২) উচ্চফলনশীল ও শীতসহনশীল নারকেল ভ্যারাইটির মূল্যায়ণ
৩) আবাদের ভিত্তিতে শস্যপ্রথার উন্নয়ণ
৪) আবাদী শস্যের কৃষিকৌশলের লক্ষ্য স্থিরিকরণ
৫) আবাদী শস্য ও মশলার বিস্তারণকৌশলের লক্ষ্য স্থিরিকরণ
৬) কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে পরীক্ষিত কৌশলগুলি বন্টন করা।
৭) প্রধানতঃ কোকো, সুপারী ও নারকেল নিয়ে গবেষণামূলক কাজ হয় এখানে।
CPCRI, RC মোহিতনগর-এর মানচিত্র দেখলাম— ছবিও তুললাম।
এই রিসার্চ সেন্টারের সায়েন্টিস্ট ইনচার্জ আমাদের সঙ্গ দিলেন এবং এই রিসার্চ সেন্টার সম্পর্কে অনেক মূল্যবান তথ্য দিলেন। আমরা জানলাম– মোহিতনগর রিসার্চ সেন্টার স্থাপিত হয় ১৯৫৮ সালে রিজিওনাল অ্যারিকানাট রিসার্চ স্টেশনে যেটা সেন্ট্রাল অ্যারিকানাট রিসার্চ সেন্টারের অধীনে ছিলো। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে এই সেন্টারকে সেন্ট্রাল প্লান্টেশন ক্রপ রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কাশাড়াগড়-এর সাথে যুক্ত করা হয়। এখানে শস্য ও মশলার উন্নতিকরণ, উৎপাদন, প্রতিরোধ, আবাদ বর্ধিতকরণ-এর উপর গবেষণা করা হয় এবং এই গবেষণালব্ধ জ্ঞান তরাই অঞ্চল ও দেশের অন্যান্য অংশের কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এখানকার সায়েন্টিস্ট ইনচার্জ হলেন অরুণ কুমার শীট।
অবস্থান: এটি জলপাইগুড়ি জেলায় অবস্থিত। ভবেশচন্দ্র স্কুল থেকে প্রায় ছয় কিমি দূরে। এন জে পি থেকে এর দূরত্ব ৪৫ কিমি। বাগডোগরা বিমানবন্দর থেকে ৬৫ কিমি দূরে। ভৌগোলিক ভাবে এর অবস্থান 26°31″N অক্ষরেখায় এবং 88°5″ E দ্রাঘিমারেখায়, উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে 91.3 মিটার।
জলবায়ু: এখানকার জলবায়ু হিমালয় পাদদেশস্থ কৃষির উপযুক্ত। বার্ষিক বৃষ্টিপাত ৩২০ সেমি, এর ৯০% বৃষ্টিপাত দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমীবায়ুর প্রভাবেই হয়। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা 18°c – 38°c, সর্বোনিম্ন তাপমাত্রা- 6°c – 18°c।
মৃত্তিকা: তিস্তার পলিগঠিত মৃত্তিকা, কিছুটা বালুকাময়, হিউমাস সমৃদ্ধ, আম্লিক (মাটির pH 4.5 – 6.0)।
ক্ষেত্রফল: ৬৫ একর জমির ওপর সুপারী, নারকেল, অয়েলপাম ট্রী, কাজুবাদাম ও বিল্ডিং নিয়ে এই রিসার্চ সেন্টার গড়ে উঠেছে।
সুপারী বাগান, তার সাথে গোলমরিচ লতিয়ে ওঠা কি সুন্দর বাগান। কোকো, কফি, কাজুবাদাম, অয়েল পাম, নারকেল, নাসপাতি, অল স্পাইস, তালসুপারী, ড্রাগনফল- সব আছে। আমরা বেশ কিছু গাছের ছবি তুলেছি।
আমরা টিফিন খেলাম — বেলা দুটোর সময়।
আমরা ফিরে এলাম — সাড়ে তিনটায়।
ফিল্ড রিপোর্ট বিশদে:
গত কাল ২৯৷০৫৷২০২৩ আটটা ই.রিক্স নিয়ে ৩২ জন ছাত্রীসহ আমরা রওনা দিলাম মোহিতনগর CPCRI এর উদ্দেশ্যে।
একটা বিশাল শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে থাকা সবেদা গাছের নীচে ছায়াচ্ছন্ন সবুজের মাঝে ছাত্রীরা সার বেঁধে সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে— মোহিতনগর CPCRI -এর সায়েন্টিস্ট ইনচার্জ স্যার অরুণ কুমার শিট ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসকে সামনে রেখে তাঁদের পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে অবগত করেন। এই প্রসঙ্গে বন সৃজন, জল দূষণ, মাটি দূষণ, বায়ু দূষণ, প্লাস্টিক দূষণ ইত্যাদি বিভিন্ন দূষণ সম্পর্কে সুন্দর আলোচনা করেন। ব্যাপক রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগের কুফল সম্পর্কে জানান। একটা সময় জাপান সবচেয়ে বেশি রাসায়নিক সার ব্যবহার করত, এখন অবশ্য প্রযুক্তিগত উন্নতির প্রভাবে এর ব্যবহার কমে এসেছে। এই প্রসঙ্গে ব্লু বেবী ডিজিজের লক্ষণ ও কারণ বর্ণনা করেন। গোরুর দুধে NO3 আসছে কিভাবে সেটার ব্যাখ্যাও দেন। বিভিন্ন প্রকার দূষণ ক্যানসারের কারণ। মাত্রাতিরিক্ত বাইকের ব্যবহার বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ। সুকান্তের ছাড়পত্র কবিতাটির উল্লেখ করেন— ছাত্রীদের কবিতাটি পড়তে বলেন। পরিশেষে জানান যে এখনো যদি আমরা পরিবেশকে বাঁচাতে সচেষ্ট না হই তাহলে এই সবুজ গ্রহের পরিণতি লাল গ্রহের মতই হবে।
পরিবেশসংক্রান্ত ভীষণ সুন্দর মনোজ্ঞ আলোচনার পর ডঃ অরুণ কুমার শীট ছাত্রীদের উদ্ভিদ চেনাতে নিয়ে গেলেন। তিনি একে একে কোকো, কফি, সুপারী, নারকেল, অয়েল পাম, তালসুপারী, নাসপাতি, অল স্পাইস, কর্পূর, ড্রাগনফলের গাছ, কাজুবাদাম স্পাইল্যানথাস, অর্কিড— প্রভৃতি গাছের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
ডঃ অরুণ কুমার শীট জানান- বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২৩ উদযাপন উপলক্ষ্যে নির্ধারিত কর্মসূচী ও স্লোগান হল- “Lifestyle for Environment” উনারাও এই নির্ধারিত কর্মসূচীতে সামিল হয়েছেন।
জীবনশৈলি কি— খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন তিনি— তিনি বললেন— বর্তমানে ব্যাপক প্রযুক্তির ব্যবহার ও উন্নতির কারণে, নতুন নতুন দ্রব্য উৎপাদন কৌশল ও নতুন জ্ঞান, তথ্য আহরণে বৃত্তিজগতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, ফলে আধুনিক জীবন পরিবর্তনশীল যা অভিব্যক্তি বা ক্রমবিকাশের ধারায় প্রবহমান। ফলে প্রয়োজন জীবনব্যাপী সঠিক শিক্ষার। এটাই জীবনশৈলি। আজকাল বাচ্চাদের ১১ বৎসর বয়স থেকেই বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হয়। এই সময়ে তাঁদের দেহের বৃদ্ধি ও মনের বিকাশ হয়। বিপাক ক্রিয়ার হার বাড়ে, হরমোনের পরিবর্তন ও কার্যকলাপ বাড়ে। হাড়ের বৃদ্ধি ঘটে। এ সময়ে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিনযুক্ত সুষম ও ফাইবারযুক্ত খাদ্য গ্রহনের মাধ্যমে সঠিক পুষ্টি দরকার। অতিরিক্ত ফাস্টফুড ও কোমল পানীয় দেহের ওজন বাড়ায়। তাই অতিরিক্ত ক্যালোরিযুক্ত খাবার বাদ।
তিনি আরও জানান— গার্হস্থ্য ও বৈশ্বিক চাহিদা সৃষ্টি করতে এবং মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য যোগাতে ভারত সরকার সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের কাছে প্রস্তাব রেখেছে ‘২০২৩ সালকে আন্তর্জাতিক মিলেট বর্ষ’ঘোষণা করা হোক। বিশ্ব উষ্ণায়ন, পরিবেশের যেরূপ পরিবর্তন, তাতে খাদ্য সুরক্ষার জন্য, পুষ্টির জন্য ও স্থিতিশীল কৃষিব্যবস্থায় মিলেট চাষের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কারণ খরা বা স্বল্প বৃষ্টিপাতে, কঠিন পরিস্থিতিতে মিলেট জন্মাতে পারে। মিলেট ফাইবারযুক্ত এবং প্রোটিন ভিটামিন ও খনিজসহ অত্যন্ত পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। আমাদের দেশে পার্ল মিলেট (বাজরা), ফিঙ্গার মিলেট (রাগি), ফক্সটেইল (কাউন), প্রোসো (মাইলো, জোয়ার), বার্ণইয়ার্ড মিলেট (শ্যামা চাল), কোডো মিলেট (বাজরা), লিটল্ মিলেট (সামা), ব্রাউনটপ মিলেট (বাদামী শীর্ষ বাজরা), কুইনোয়া মিলেট (ওট), টেফ মিলেট (বাজরা), বাকহুইট (ঢেমশি) প্রভৃতি নানা রকম মিলেট জন্মে। এমনকি লাল ডাঁটা শাকের বীজকেও মিলেট বলা হচ্ছে।
বিজ্ঞানী ডঃ অরুণ কুমার শিট জানালেন– মোহিতনগর CPCRI-তে প্রধানতঃ কোকো, কফি, নারকেলের সাথে সুপারী নিয়েও গবেষণা হয়। সুপারী বাগানের দিকে নির্দেশ করে বললেন— এখানে মোহিতনগর ভ্যারাইটির মাঝে খর্বাকৃতি সুপারী গাছ আছে। একটি খর্বাকৃতি সুপারীগাছ দেখিয়ে বললেন— এই গাছটির বয়স ত্রিশ বছর।
মোহিতনগর ভ্যারাইটি- ১৯৯১ সালে এই ভ্যারাইটি আবিষ্কৃত হয়। এই গাছের সুপারী আকৃতির দিক থেকে সমআকৃতিসম্পন্ন। কারণ মঞ্জরীদন্ডের মধ্যে ফাঁকা ফাঁকা ভাবে সুপারীগুলি বিন্যস্ত থাকে। এই কারণেই উদ্ভিদজীবাণু দ্বারা সুপারী আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও কম। এটাও টানা উচ্চ ফলনশীল। এক একটি গাছ প্রতি বছর ৩.৬৭ কেজি সুপারী দেয়।
ভিত্তাল অ্যারিকানাট হাইব্রীড ২ (VTLAH-2), খর্বাকৃতি সুপারীগাছ। মাঝারী প্রস্থবিশিষ্ট কাণ্ড, পর্বগুলি একের ওপর আরএকটি – এইভাবে সজ্জিত। পাতার চাঁদোয়ার আকৃতি ছোটো, পাতা সুবিন্যস্ত। মাঝারী উপবৃত্তাকার বা ডিম্বাকার ফল আনতপ্রকৃতির হয়। দ্রুত ফলনশীল গাছ। একটা গাছ থেকে বছরে ২.৬৪ কেজি সুপারী পাওয়া যায়।
কোকো- কোকোর বিজ্ঞানসম্মত নাম: Theobroma cacao. Malvaceae পরিবারভুক্ত। দেখলাম— বড় বড় গাছের ছায়ায় ঝোপঝাড়সহ খুব সুন্দর করে বেড়ে ওঠা কোকো গাছ। ফুল দেখতে পাইনি। বড় বড় লম্বাটে ফল ঝুলে থাকতে দেখেছি। ডঃ অরুণ কুমার শিট স্যার একটা পড়ে থাকা ফল নিয়ে ভেঙে দেখালেন— কি সুন্দর সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে বীজগুলো। তিনি জানালেন— পাকা ফলের রঙ তিনরকম হতে পারে। মেটে লাল, গাঢ় হলুদ ও বাদামী। পাকা ফলের বীজগুলি বের করে শুকিয়ে রোস্ট করে গুঁড়ো করে যে পাউডার পাওয়া যায় তা দিয়ে চকোলেট তৈরি হয়। ফলের নরম শাঁস থেকে কোকো বাটার তৈরি হয়। এই ফলে জরায়ুজ অঙ্কুরোদ্গম হয়।
তিনি ছাত্রীদের শাঁসসহ কোকোবীজ খেতে দিলেন। তিনি বললেন, এটি খেতে মিষ্টি কি না— ওরা প্রথমে জানালো এর স্বাদ নোনতা, পরে বললো টক, তেতো। আসলে শাঁস মিষ্টি হলেও বীজ টকটক ও তেতো।
তাল সুপারি, অ্যারিকা পাম (Areca triandra) Arecaceae পরিবারভুক্ত multi stemed palm. এটি Ornamental plant. এর ফুলে পুংকেশরের সংখ্যা তিন। ডঃ অরুণ কুমার শীট একটি লাল টুকটুকে ফল নিয়ে ছাত্রীদের দেখালেন। বললেন— ফলের শাঁস বা পাল্প ঠিক খেজুরের মত, মিষ্টি স্বাদযুক্ত। শাঁস যেমন খাওয়া যায়, বীজও সুপারির মত খাওয়া যায়।
বীজ মৃদু মাদকধর্মী, ট্যানিনযুক্ত, ক্ষারধর্মী। সুপারির মত খেলে এটি লালা নিঃসরণে সহায়তা করে, হৃৎপিন্ডকে অধিক সক্রিয় করে, ঘাম নিঃসরণ করে, খিদে কমায়, কৃমিনাশক।
ড্রাগন ফলের গাছ- শুনেছি ড্রাগন ফলের উপকারিতা অশেষ। ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য এ ফল ভীষণ উপকারী। ব্লাড সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখতে এ ফলের জুড়ি নেই। এ গাছ রুক্ষ শুষ্ক বেলে মাটিতে, খরাপ্রবণ এলাকাতে, ছায়াচ্ছন্ন অঞ্চলে- সবখানেই জন্মে। তাই বুঝি বর্তমানে এ ফলের গাছ চাষ বিশেষ লাভজনক।
মোহিতনগর গবেষণাকেন্দ্রে দেখলাম ড্রাগন ফলের গাছ লাগানো হয়েছে। দুটি গাছের মধ্যে দূরত্ব প্রায় দু’মিটার। প্রত্যেকটি গাছ খাঁচা দিয়ে ঘেরা। দেখেই বোঝা যায় এ গাছ ফণীমনসার মতো, ক্যাকটাস। স্যার অরুণ কুমার শীট জানালেন- এটি Cactaceae পরিবারেরই গাছ।
ফুল নাকি এসময়েই হয়। কিন্তু চোখে পড়লো না। ড্রাগন ফলের বিজ্ঞানসম্মত নাম- Hylocereus costaricensis.
ড্রাগন ফলের উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে স্যার বললেন— এই ফলের বহিঃত্বকের রঙ অত্যন্ত আকর্ষণীয় হলেও শাঁসের রঙ সাদামাটা। যে ফলের শাঁস যত রঙীন সেই ফল তত বেশী অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট। যেমন পাকা পেঁপে ড্রাগন ফলের চেয়ে বেশি অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট।
অলস্পাইস গাছ- অদ্ভুত একটি গাছ। ছাত্রীরা স্যারের নির্দেশে গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে ঘ্রাণ নিতে লাগলো। আমরাও পেলাম পুরু, উজ্জ্বল, চকচকে, সুঘ্রাণযুক্ত, ওভাল শেপের সেই পাতা। কেউ বলছে- এলাচের গন্ধ, কেউ বলছে তেজপাতার মতো, কেউ বলছে লবঙ্গ হতে পারে, কারো মনে হলো দারচিনি নয়তো? ডঃ অরুণ কুমার শিট জানালেন— এর নাম অলস্পাইস, যার অর্থ সবরকম মশলা। জায়ফল, জৈয়েত্রী, লবঙ্গ, দারচিনি, গোলমরিচ, এলাচ, তেজপাতা, কর্পূর- এই আট প্রকার গন্ধ পায় অনেকে। যাঁদের ঘ্রাণশক্তি আরো প্রখর তাঁরা আরো বেশি মশলার গন্ধ পেতে পারে। রান্নায় এই পাতা ব্যবহার করা হয়।
দেখলাম— কি সুন্দর সাদা ছোটো ছোটো ফুল ধরেছে। মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ছবি আসলো না।
এই গাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম— Pimenta dioica. Myrtaceae পরিবারভুক্ত অর্থাৎ জারুল গাছের পরিবার।
শুনেছি অলস্পাইস গাছ কফি গাছের শেডট্রী হিসেবে লাগানো হয়।
কাজুবাদাম গাছ— বিজ্ঞানসম্মত নাম Anacardium occidentale, Anacardiaceae পরিবারভুক্ত উদ্ভিদ। চিরহরিৎ। ডঃ অরুণ কুমার শীট খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন— কাজুর দুটো অংশ। কাজু আপেল ও কাজুবাদাম। হালকা লালচে হলুদ রঙের অংশটি অপ্রকৃত ফল, এই অংশ একটি ফুলের শক্ত বৃন্ত (Pedicel) প্রসারিত হয়ে ফলের মত তৈরি হয়। একে কাজু আপেল বলে। এর পাল্প ও জুস থেকে astringent fruit drink (non-alcoholic), সুমিষ্ট গন্ধযুক্ত অ্যালকোহলিক ড্রিঙ্কস তৈরি হয়। এই অংশ নিঃসৃত ফেনলিক রেজিন, অ্যানাকার্ডিক অ্যাসিড চামড়ার অ্যালার্জীর কারণ। কাজুবাদাম প্রকৃত ফল (Drupe). এর বীজ বহিঃস্ত্বক (Testa) ও বীজ অন্তঃস্ত্বক (Tegmen) কোনটি, সেটিও দেখিয়ে দিলেন। কাজুবাদাম সংগ্রহ পদ্ধতি খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন। কাজুবাদাম প্রথমে রৌদ্রে শুকোতে হয়, তারপর বিশেষ পদ্ধতিতে কেটে শাঁস বের করতে হয়।
এরপর স্যার দেখালেন আশ্চর্য সেই নোনী গাছ- যার বিজ্ঞানসম্মত নাম Morinda citrifolia. কফি পরিবার Rubiaceae family-র সদস্য। প্রাকৃতিকভাবেই এর বিস্তৃতি সর্বত্র। আশ্চর্য সেই শক্তিশালী ফল, যার গন্ধ বমির মত, তাই একে famine food বলে, যদিও এসময় আমরা তার দেখা পাইনি— এই ফলের পাল্প কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবার সমৃদ্ধ বলে কোনো কোনো সাংস্কৃতিক সমাজের মানুষের প্রধান খাদ্য এটি। Traditional medicine, food supplement ক্যাপসুল ও জুস হিসাবে এটির ব্যবহার দেখা যায়।
ফিরে এলাম CPCRI এর মূল ভবনে। স্যার দেখালেন গাঢ় লাল কান্ডযুক্ত, শাখা-প্রশাখায় জড়ানো, সূক্ষ্ম সবুজ ফার্ণ পাতার মত জলপ্রপাত উদ্ভিদের ঝাড়, নাম ফাইল্যানথাস। সুন্দর করে সোফার আকৃতি দেওয়া— ছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, বসবি নাকি সোফায়? ভারি অদ্ভুত সুন্দর উদ্ভিদ, এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Phyllunthus multiflorus, এটি Phyllanthaceae বা আমলকির পরিবারভুক্ত। এই পরিবারের বৈশিষ্ট্য হল যতই এর পাতাগুলিকে যৌগিক পত্রের পত্রকের মত দেখাক না কেন, এগুলি আসলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৌলিক পত্র। এজন্য প্রতিটি পর্ব থেকে একান্তর পত্রবিন্যাসে বিন্যস্ত থাকে। প্রতিটি পর্ব থেকে ফুল ও ফল হয়। যার ফলে মনে হয় যেন পাতার নীচ থেকে ফুল ফল জন্মে।
এভাবে টানা প্রায় আড়াই ঘন্টা স্যার প্রকৃতির মাঝে আনন্দের সাথে আমাদের সব চিনিয়ে দিলেন, বিস্মিত হতে হয় এই ভেবে— কি বিশাল কর্মযজ্ঞ এ গবেষণাকেন্দ্রের, এরপর স্যার আমাদের আলো বাতাসপূর্ণ সুসজ্জিত কনফারেন্স হলে বিশ্রাম নিতে বললেন। পানীয় জল ও টয়লেটের সুন্দর ব্যবস্থা। লিকুইড সোপ, ডাস্টবিন- পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার সকল নিদর্শন সেখানে। খেতে খেতে মন জুড়ানো সুশীতল কক্ষে আলোচনা চলতেই থাকলো শিক্ষিকা-ছাত্রীদের।
কি বলে ধন্যবাদ জানাবো শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী ডঃ অরুণ কুমার শীট স্যারকে?
বিখ্যাত লেখিকা ও কবি কেতকী কুশারী ডাইসনের ভাষায় বলি—
“উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের আমি সত্যিই শ্রদ্ধা করি। কত কী জানেন তাঁরা। আর সবই জরুরী জিনিস, কাজে লাগে, কোনোটা ফালতু নয়। বই খুললে চোখ খুলে যায়, বিস্ফারিত হয়ে যায় দু’চোখ। ওঁরা যে-জ্ঞানের টুকরোগুলো পরিবেশন করেন সেগুলো যেন আলু, কচুশাক, বা কলমীর মতো, সিদ্ধ ক’রে খেয়ে বাঁচা যায়। আজকালকার মটরকড়াই-চিবোনো হিং-টিং-ছট-আওড়ানো মানববিদ্যার পণ্ডিতদের মতো ওঁরা আগাপাছতলা প্রলাপ বকেন না। কিংবা আমাদের অভিধান রচয়িতাদের মতো “ফুলবিশেষ” বা “বৃক্ষবিশেষ” ব’লে ঘুমোতে চ’লে যাননা, বাস্তবের সঙ্গে একটা হেস্তনেস্ত করেন। একটা জিনিস যে ফুল বা গাছ তা তো পাঠক একেবারে নতুন ভাষাশিক্ষার্থী না হলে প্রসঙ্গ থেকেই অধিকাংশ সময় বুঝে নিতে পারেন। কিন্তু তারপরেই জানতে ইচ্ছে করে ফুলটা বা গাছটা কোন্ জাতের, কী তার ধর্ম। তাকে দেখতে কেমন, তার পাতার আকৃতি কেমন, ফুলের রঙটা কী। এইসব জানলে তবেই না বোঝা যায় একটা টেক্সটে কেন তার উল্লেখ রয়েছে।”
সত্যিই আজ আমরা সবাই শিখলাম- “জ্ঞানের টুকরো সরবরাহ করা কাকে বলে।”