**ট্রামের গল্প –পর্ব -২** কাবেরী বোস
**ট্রামের গল্প –পর্ব -২**
কাবেরী বোস
সুধা কাঁধের ব্যাগটা ঠিক করে নিয়ে ট্রামে উঠে পড়লো , বেশ ভীড় সামনে পুজো তাই ছোটো বড় সবারই কচকচানি ট্রামে! সুধা আস্তে আস্তে লেডিস সিটের দিকে এগিয়ে গেলো, এখন বয়স টা টের পায় সে ,বাঁ পাটাও কষ্ট দিচ্ছে বেশ কয়েকদিন হলো ! সামনের ইয়াং মেয়েটা মনে হয় কিছু বুঝেছিলো সে উঠে দাঁড়িয়ে সুধা কে বললো ,” আপনি বসুন আন্টি আমি সামনেই নামবো “সুধা অল্প হেসে বসে পড়লো সিটে , আহ ! পাটা আরাম পেলো একটু , ট্রাম চলেছে দুলে দুলে ! হাওয়া আসছে জানলা দিয়ে সুধা চোখ টা বুজিয়ে বসে রইলো নামবে সেই ধর্মতলা ! যাবে অসিত দার কাছে বীরেনের অফিসের কিছু টাকা পাওয়ার ছিলো সেটা আটকে গেছে! কোনোদিনো ভাবেনি এরমদিন দেখতে হবে! সুধা র সাথে বীরেনের আলাপ ইউনিভার্সিটির পড়া পড়তে গিয়ে , বেশ গম্ভীর ও বদমেজাজি স্যার ছিলো বীরেন ! সবসময়ই মুখ টা ব্যাজার করে থাকতো কেউ পড়া না পারলেই অসম্ভব রেগে যেতো! সুধা অবশ্য চুপচাপ ঠান্ডা টাইপের ছিলো , পড়া করে যেতো। বীরেন তাকে বকার চান্স পেতো কম , এইভাবেই দিনগুলো চলছিলো হঠাৎ সুধার বাবার হার্ট এট্যাক হয় যাকে বলে ম্যাসিভ এট্যাক! হাসপাতালে বাবার জীবন মরণ লড়াই আর সুধার ও তাইই , বাবাকে নিয়ে টানাপড়েন চলতে থাকে! আত্মীয়স্বজন রা কেউই তেমন আসেনা পাশে এসে দাঁড়ায় বীরেন প্রায় ভগবানের মতো! বাবা র যাবতীয় ওষুধপত্র থেকে শুরু করে মোটামুটি সবই সে দেখাশোনা করে , আর্থিক সঙ্গতি সেরম না থাকায় বাবা সরকারি হাসপাতালে টানা ২০ দিন লড়াই করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে!! আকাশ ভেঙে পড়ে সুধার মাথার ওপর সে আর ছোটো বোন আর মা !! কি যে করবে ভেবে পায়না!! কিন্তু বীরেন সব ব্যাবস্থা করে দেয় , সুধাকে একটা চাকরি তার সাথে পড়াশুনো আর বোনকেও ফ্রিতে পড়াতো বীরেন ,আসলে লোকটাই ছিলো ওরম পাগলাটে টাইপের !লোকের উপকার করে বেড়াতো টেনে টেনে এদিকে পকেট ফুটকড়াই যা মাইনে পেতো সবই একে ওকে পড়িয়ে দিয়ে শেষ হয়ে যেতো! লম্বা ঢ্যাঙা চেহারা বয়স ত্রিশের কাছাকাছি হবে শার্প মুখ , সবসময় গম্ভীর !! এইরকম বিদঘুটে লোকটাকেই কিভাবে যেনো সুধা ভালোবেসে ফেলেছিলো!! কিন্তু অনেক পরে বলেছিলো , বীরেন কিছু বলেনি অবাক হয়ে সুধার দিকে তাকিয়ে ছিলো!! কিন্তু মনে মনে নিশ্চই সায় ছিলো তাই বীরেনের সাথে এই ট্রামে করেই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতো সুধা ! প্রেম কম লেকচার বেশী হতো তবু ভালো লাগতো এই লোকটাকেই! বীরেনের হাত ধরেই পড়াশুনো করে স্কুলের চাকরি পায় সুধা , বোনও তখন মাস্টার্স করছে ,সেইসময় দুই বাড়ির জোড়াজুড়িতেই বীরেন আর সুধা বিবাহবন্ধনে বাঁধা পড়ে, এরপর দিনগুলো কিভাবে যেনো গড়গড় করে চলে গেলো টানা ত্রিশ বছর ভাবা যায়!! ওরম কাঠখোট্টা লোকটার ভেতর যে এমন এক প্রেমিক মানুষ আছে তাকে জানতো!! সুধার জীবনের ছোটো বড় সব পাওয়া এই বীরেনের হাত ধরে!! এই ট্রামে করে তারা প্রায়ই ময়দানে পৌঁছে যেতো তারপর হাতে হাত ধরে বাদাম ভাজা খেতে খেতে কত কত কথার সমুদ্র যে বয়ে যেতো তার ঠিক নেই , এরমধ্যে এই ট্রামে একটা ১৪-১৫ বছরের ছেলে লজেন্স বিক্রি করতো কেউ কিনুক না কিনুক বীরেন ঠিক কিনতো! একদিন সেই ছেলেটিকে দুম করে নিজের ঠিকানা দিয়ে আসতে বলে দিলো!! সুধা কপট রাগ করলেও মনে মনে খুব গর্ব ই অনুভুব করতো , সেই ছেলেটির সব ভার বীরেন নিয়েছিলো , এখন সে কোথায় সুধা জানেনা !বীরেনের সাথে যোগাযোগ ছিলো হয়তো! বিদেশে চাকরি পেয়ে সে চলে গিয়েছে বীরেন বলেছিলো এরপর আর … সুধার দুই ছেলে মেয়েই উপযুক্ত , দুজনেই চাকরি করে নাতি নাত্নী ভরা সংসার সুধা আর বীরেনের , বেশ যাচ্ছিলো দিনগুলো , ছেলে মেয়েরা বাইরেই থাকে , মেয়ে প্লেনের টিকিট পাঠিয়ে দিয়ে বললো এবারের পুজো যেনো তারা মেয়ের কাছেই কাটায় ! বীরেন আর সুধা যাবে বলে সব রেডি ঠিক যাওয়ার আগের দিন সুধার হার্ট এট্যাক হলো !! রাতেই ঘটেছিলো !! হাসপাতালে ভর্তী করা হলো ! যমে মানুষে নয় যমে আর বীরেনের টানাটানি চললো!! মানুষ টা পাগলের মতো সব বেচতে লাগলো!! ধার নিলো কিছু , যাদের কাছে কোনোদিনো হাত পাতবে ভাবেনি তাদের কাছেও হাত পাতলো!! শুধু সুধার জন্যে !! শেষে বাড়ি বেচবে শুনে ছেলে মেয়ে দুজনেই বাবাকে ধমকে দিয়ে গেলো বলে গেলো ,” মার বয়স হয়েছে চলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক তুমি হঠকারিতা করছো কেন! এই বাড়ি শুধু তোমাদের নয় আমাদেরো ভাগ আছে এতে !!” বীরেন অসহায় এর মতো বোঝাতে লাগলো যে ওটা তোমাদের মা হয় একটু বোঝো সে সারাজীবন কষ্ট করে তোমাদের বড় করেছে , আর তোমরা বাড়ি বাড়ি করছো!! কিন্তু না কথা শোনেনি কেউই ! বাবা কে যারপরনাই কথা শুনিয়ে শাষিয়ে গেছে দুজনেই!! ওপরওলার আশীর্বাদে বাড়ি বিক্রি করার আগেই সুধার জ্ঞ্যান ফিরে আসে যা না ফিরলেই মনে হয় ভালো হতো!! সুধার বোন ভগ্নীপত সবাই নিতে এসেছিলো তাকে বীরেন বাদে !! কারণ বীরেন তখন দুর আকাশের তারা হয়ে গেছে নিজেই সুধাকে বাঁচাতে বাঁচাতে!! এক রাতে বীরেন তাকে বুকের ভেতর চেপে বলেছিলো সু আমার শ্বাস প্রশ্বাস টা তোমার সাথেই বাঁধা আছে তুমি থেমে গেলে আমিও থেমে যাবো!! কিন্তু সুধা!! তার শ্বাস তো চলছে!! বীরেন নেই আজ এক বছর হয়ে গেলো!! হঠাৎ কারো ডাকে চোখ টা খুলে গেলো দেখলো কণ্ডাকটর বলছে এসে গেছে মাসিমা ধর্মতলা আপনি নামুন !! সুধা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো !! মনে হলো সামনের দুটো সিটে সে আর বীরেন এখনো বসে আছে আর সেই লজেন্স বিক্রি করা ছেলেটা লজেন্স হাতে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে তাদের দিকে!!
#নীলবৃষ্টি
স্বত্ব সংরক্ষিত