# সীমান্ত # পর্ব – ১৭ কলমে – অরণ্যানী

# সীমান্ত # পর্ব – ১৭
কলমে – অরণ্যানী

বিরহী মেঘ :-
ওদিকে সারা রাত নদীর পাড়ে বসেই মেঘের কেটে গেল। ভোরের আলো ফুটলে নদীতে নেমে জল পান করল। হঠাৎই ক্ষুধা অনুভব করায় হাতের তীর ধনুক ছুঁলো। মনে পড়ে গেল সেই দৃশ্য। তীর বিদ্ধ রক্তাক্ত মিনু। তীরগুলো রাগ করে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলে দিল মেঘ। ধনুকটাও হাত দিয়ে মুচড়ে ভেঙে ফেললো। রইলো শুধু ঝুলিতে তার বাক্সটা। সারাদিন জঙ্গলে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলো। দুপুরে সেই ঝোপটায়, যেখানে মিনু তীর বিদ্ধ হয়েছিল সেখানে এলো। সেখানে তখনও শুকনো রক্তের দাগ। মেঘ সেই দিকে চেয়ে রইল। তারপর গেল নিজের ঘরে। যেখানে কাল রাতে মিনু শুয়েছিল সেখানে বসে কাল সংজ্ঞাহীন চাদর ঢাকা মিনুর মুখ, মাথার অবিন্যস্ত চুল, জ্ঞান ফিরে মেঘের দিকে তাকানো দৃষ্টি, সব মনে করতে লাগলো। একটু পর ঘোর ভাঙলো। মিনু নেই। শূন্য দৃষ্টিতে ঘরের দিকে তাকিয়ে মেঘ।

কখনো জ্যোৎস্না রাতে মাচার উপর জেগে একা মেঘ। পাশে আদিবাসীদের ঘরগুলিতে সকলে গভীর নিদ্রামগ্ন। কখনো আকাশের চাঁদের দিকে চেয়ে মেঘ।
কখনো নদীর পাড়ে বসে ওপারের বটতলার ঘাটের দিকে চেয়ে মেঘ। কত মেয়ে বউরা স্নান করতে, কাপড় কাচতে, বাসন মাজতে, জল নিতে ঘাটে আসছে যাচ্ছে। মেঘের দু’চোখ কাকে যেন খুঁজে চলেছে। মিনুরই বয়সী মেয়েরা ঘাটে স্নান করছে। মেঘকে নদীর ওপারে এভাবে বসে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওরা যেন কী সব বলাবলি করছে। মেঘ এখন জানে যে গাঁয়ের মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকলে ওরা রেগে যায়। ওরা যে ওকে নিয়েই আলোচনা করছে বুঝে মেঘ আড়ালে সরে গেল।

শেষ দুপুরের পড়ন্ত রোদে গাছের ছায়ায় বসে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত মেঘ ঝুলি থেকে বাক্সটা বের করে চুড়ি, বালা, টিপ, ফিতে, এগুলো ম্লান মুখে হতাশ ভাবে দেখতে লাগলো। কল্পনায় ভেসে উঠল দুটো করে ঝুঁটি করা, লাল ফিতে বাঁধা, হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি পরা মিনুকে।

পরদিনও দুর্বলতার কারণে মিনুর সারাদিন একটা ঘোরের মধ্যে কাটল। অস্ত্রশিক্ষার মাঠে প্র্যাকটিসে মন দিতে না পারার কারণে কবিতা ছুটি নিয়ে চলে এলো মিনুর কাছে। তখন দুপুর। মেঝেয় পাতা বিছানায় অঘোরে ঘুমোচ্ছে মিনু। তার পাশে লুল্লু। মিনুর মা রান্নাঘরে কাজ করছে। ঝিনুক পাশের ঘরে একা বসে বিমনা হয়ে কী যেন ভাবছে। মিনুর বাবা মাঠে চাষের কাজে, দাদা অলোক অস্ত্রশিক্ষার মাঠে। কবিতা মিনুর ঘরে ঢুকে মিনুকে ঘুমোতে দেখে পাশের ঘরে ঝিনুকের কাছে গেল। বাড়িটা খুব নির্জন লাগছে। ঝিনুক কবিতাকে দেখতে পায়নি।
কবিতা – ঝিনুকদি, মিনু কেমন আছে? কিছু খেয়েছে?
ঝিনুকের ঘোর কাটলো। চমকে উঠে দেখল কবিতাকে।
ঝিনুক – ও তো শুধুই ঘুমোচ্ছে। বোধহয় খুব দুর্বল। মা গরম ভাত রান্না করছে। মাস্টারদা বলেছে গরম ভাত আর জ্যান্ত মাছের ঝোল খাওয়াতে। বাবলু তো মাছ দিয়ে গেছে। রান্না হলে খাবে। তুই অস্ত্রশিক্ষা নিতে গিয়েছিলি?
কবিতা – হ্যাঁ। মাস্টারদাকে বললাম মিনুকে দেখতে যাব, মাস্টারদা ছুটি দিয়ে দিলো।
ঝিনুক – হ্যাঁরে, আমার দাদা কেমন পারছে?
কবিতা – ভালোই তো পারছে সবাই।
ঝিনুক – শুনেছিস? দেবুর বৌদি তার বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে কাল রাতে।
কবিতা – সে কী! সুজনদাকে তো দেখলাম মাঠে প্র্যাকটিস করছে।
মিনুর মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললো – তা কী করবে? বাচ্চাগুলো ছোট। যুদ্ধ হলে তো মরবে।
ঝিনুক – বর যাবে গণসেনায়, আর বউ বাড়ি থেকে পালিয়ে বাপের বাড়ি! বয়স তো অল্প। অস্ত্রশিক্ষা নিলেই পারে। গ্রামে কত বুড়ো বাচ্চা পড়ে রইল, আর ধামড়ি মাগি যুদ্ধের ভয়ে লুকিয়ে পালালো তাবলে? এতদিনের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক।
মা – হ্যাঁ, বাচ্চাগুলোকে রেখে আসতে পারত।
কবিতা – কিন্তু ওই মালতী বৌদি তো অস্ত্রশিক্ষায় আমাদের থেকে ভালো।

পাশের ঘর থেকে লুল্লুর ডাক শোনা গেল।
মা – বোধহয় মিনুর ঘুম ভেঙেছে। মা ও কবিতা মিনুর ঘরের দিকে গেল। মিনু লুল্লুকে আদর করছে। কবিতা এসে মিনুর পাশে বসল। মা দরজা থেকে মিনুকে দেখে রান্নাঘরে গেল রান্না নামাতে।
কবিতা – কী রে, কেমন আছিস? সেদিন যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি।
মিনু — বুকে খুব ব্যথা।
কবিতা – হলো কী করে এমন? মাস্টারদা তো বললো তীর বিঁধেছিল। তুই সেদিন নদীর ওপারের জঙ্গলে গিয়েছিলি? তখন কোনো শিকারী তীর মেরেছিল তোকে? ওপারের জঙ্গলে একা গিয়েছিলি কেন?
মিনু – জানি না তো কী করে হলো। ওইদিন মাছ ধরলাম। নদীর ঘাটে নাইতে গেলাম। জঙ্গলে ঘুরছিলাম। তারপর – – –
মনে করতে গিয়ে মিনু কেমন ঘোরের মধ্যে চলে গেল। মনে পড়ল একটি যুবকের চেহারা। তারপর আরো কিছু হয়তো মনে পড়ত। কিন্তু মিনুর মা থালা হাতে ঘরে ঢুকল। মুখ গম্ভীর।
মা – থাক, যা মনে পড়ছে না, তা মনে করার চেষ্টাও করতে হবে না। উঠতে পারবি? না বালিশ দিয়ে মাথাটা উঁচু করে দেবো?
কবিতা আর একটা বালিশ এনে বালিশটা উঁচু করল। কিন্তু মিনু কষ্ট করে ধীরে ধীরে বালিশে ঠ্যাঁস দিয়ে বসল।
মিনু – লুল্লুকে আগে মাছ দিয়ে ভাত দাও, তবেই আমি খাব।
মিনুর মা বিরক্তি সহকারে লুল্লুর ডিসে মাছ-ভাত মেখে নিয়ে এলো। মিনু হাত বাড়িয়ে ডিসটা লুল্লুকে দিল।
মা — নে, এবার শান্তি তো? খা।
মা হাতে করে ভাত তুলে মিনুকে খাওয়াতে লাগলো।
কবিতা – আমি আসি রে মিনু। পরে আবার আসবো।
মিনু – আসিস, নইলে একা একা বিছানায় শুয়ে বসে কিইবা করবো।
কবিতা – বিকেলে অস্ত্রশিক্ষার শেষে আসবো।
মিনু কবিতার মুখের দিকে তাকাল। কবিতাও বুঝল মিনু কী বলতে চাইছে। আসলে ওটা কবিতার বিজয়ের সঙ্গে দেখা করার সময়।
কবিতা – আসবো ঠিকই।
কবিতা ও মিনু পরস্পরের দিকে তাকাতেই ওদের চোখে মুখে কী যেন এক গোপনীয় উচ্ছ্বাস খেলে গেল। এতো অসুস্থ অবস্থাতেও মিনুর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মিনুর মা তা দেখে একটু অবাক হয়ে কবিতার দিকে তাকাতে কবিতা চোখ সরিয়ে নিল।
ঝিনুক ডাকলো কবিতাকে – কবিতা শোন এদিকে। কবিতা ঘরে ঢুকে দেখল ঝিনুক জানলার ধারে বসে আছে। মুখ গম্ভীর। চোখ দুটো ফোলা আর লাল। বেশ বোঝা যায় এতক্ষণ সে একা ঘরে বসে নীরবে চোখের জল ফেলে যাচ্ছিল। কবিতা সংকুচিত ভাবে ঝিনুকের দিকে এগিয়ে যেতে ঝিনুক একটা ভাঁজ করা কাগজ কবিতার দিকে এগিয়ে দিল।
কবিতা নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল – এটা কী?
ঝিনুক – ওকে দিস।
কবিতা – কী লাভ?
ঝিনুকের চোখ থেকে আবারও জল পড়তে লাগল। ঝিনুক উঠে এগিয়ে এসে কবিতার হাতে চিঠিটা গুঁজে দিয়ে কবিতার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো।
ঝিনুক – কেউ যেন না জানে।
এই দৃশ্যের সামনে কবিতা বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারল না। সেছাড়া ভয়ও করল পাছে মিনুর মা এসে যায়। কবিতা দ্রুত চিঠি হাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গেল।
(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *