#মূর্তি © মোনালিসা সাহা দে

#মূর্তি

© মোনালিসা সাহা দে

মূর্তিটা থেকে গলগল করে রক্ত ঝরে পড়ছে। কিন্তু এ কী করে সম্ভব? ওটা তো নিছকই একটা মূর্তি! একটু সামনে এগিয়ে গেল অর্ণব। না তো! শুধু রক্ত ঝরে পড়ছে, তা নয়। মূর্তিটা থেকে ঠিক যেন মাংস খুবলে খুবলে বেরিয়ে আসছে। তার দিকে এমন ক্রূর দৃষ্টিতে কেন তাকিয়ে এ মূর্তি?

আর সহ্য করতে পারছিল না সে। এক ছুটে অন্য ঘর থেকে লাঠি নিয়ে এসে ঠাকুরঘরে ঢুকে মূর্তিটা ভেঙে ফেলল সে। তারপর আর কিছু মনে নেই।

জ্ঞান ফিরল যখন তখন সে তার বিছানায় শুয়ে। মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে তার মা।

– কাল রাতে তো… মানে আমি মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখি…
আচ্ছা, এখানে কি করে এলাম মা?

– বিকট শব্দ শুনেই আমার ঘুম ভেঙে যায় রে খোকা। এসে দেখি এই কান্ড। কিন্তু তার আগে তুই বল কাল রাতে তোর কি হয়েছিল? কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে মা লক্ষ্মীর প্রতিমা তুই ভেঙে দিলি? এ কি করলি তুই? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল?

অর্ণব জানে কাল রাতে সে যা দেখেছিল তা তার মনের ভুল কখনোই ছিলো না। মনের ভুল এত জীবন্ত হতে পারে না কোনভাবেই।

– ভাঙ্গা মূর্তিটা কি এখনও ঠাকুরঘরে আছে মা?

– হ্যাঁ। কিন্তু নিছক মূর্তি তো নয়, এ যে প্রতিমা ছিলো রে। এবারে কি হবে কে জানে! এত বড় অশুভ ঘটনা ঘটে গেল। আমি ভোরেই ঠাকুরমশাইকে ফোন করেছি। উনি আসবেন একটু পরেই। অপেক্ষায় আছি। উনি প্রায়শ্চিত্তের কি বিধান দেন দেখি।

অর্ণব কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেলো। চোখের সামনে এখনও ভেসে চলেছে কাল রাতের বিভীষিকা। মাতৃরূপে এত কাঠিন্য আসতে পারে কেমন করে?

*

দিন কেটে গেলো, এলো আবার রাত।

ঠাকুরমশাই এসে তিন মাসের মধ্যেই লক্ষী-নারায়ন পুজো করে একান্ন জন ব্রাহ্মণকে খাওয়ানোর বিধান দিয়ে গিয়েছেন। সেই আচারেও কোনো ত্রুটি হলে বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে, এমন আশঙ্কাও জানিয়ে গিয়েছেন।

এদিকে বিকেলেই ভাঙা প্রতিমা গঙ্গায় দিয়ে আসা হয়েছে। অদ্ভুত ভাবে ঘাটে দেখা গিয়েছে জামাইবাবুর পরিবারকেও একই রকম ভাবে। তাদের চোখেমুখেও ছিল আতঙ্কের ছাপ, আর তাদের বাড়ির প্রতিমাও ছিল কেমন যেন ভাঙাচোরা। কেউ কাউকে কোনও প্রশ্ন করেনি যদিও। অনেক সময় প্রশ্ন করার প্রয়োজনও পড়ে না। উত্তর এমনি এমনিই পাওয়া যায়।

পাড়ার কয়েকজন ছেলের সাথে অর্ণব আর অর্ণব এর মা দুজনেই আজ গঙ্গার ঘাটে গিয়েছিলেন। অর্ণবের বাবা মেয়ে চলে যাওয়ার পর সেই যে অসুস্থ হয়েছেন, তারপর থেকে সুস্থ আজও হননি। তবুও আজ তিনি বারবার একই প্রশ্ন করে চলেছেন,
-কি ঘটেছিল কাল রাতে অণু?

অর্ণব কোনও উত্তর দিতে পারেনি। ভদ্রলোক মেয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই কেমন যেন মূর্তির মত থমকে যান। মনে মনে হয়ত বা তাঁর আদরের মামনির কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন বারবার। কিন্তু অর্ণব বা অর্ণবের মা, কারও চোখেই আজ ঘুম নেই।

নিরঞ্জনের সময় মায়ের প্রতিমার ভাঙা মুখমণ্ডলটা বড্ড চেনা চেনা লিখেছিল তাদের দুজনেরই। পুজোর সময়ও তো মায়ের মুখটা এমন ছিল না! এই মুখ যেন কোনও দেবীর নয়, কোনও মর্ত্যমানবীর।

মধ্যরাত্রে অর্ণব নিদ্রাহীন দু চোখে ঘুম আনার জন্য একটু মদ্যপান করতে বাধ্য হলো। তৃণাকে সকাল থেকে একটাও ফোন করা হয়নি। ফোন করার মতো মানসিক অবস্থাতেই সে ছিল না। কি বলবে সে তৃণাকে? সত্যিটা জানলে এমন বাড়ির বউ হয়ে আসতে চাইবে কি সে?

বছর দুই আগে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে অর্ণবের দিদি সুতন্দ্রা। থানায় ডায়েরি করা ছাড়া আর বিশেষ কোনো খোঁজখবর নেয়নি তারা। নিজের দিদি হলে তাও বা নেওয়া যায়। ভারী তো সৎ দিদি, তাতে আবার স্বামীর ঘর থেকে চলে আসা। বাবা সারাদিন কাজের জন্য বাইরে থাকত। অর্ণব আর তার মা মিলে মেয়েটার উপর কত অত্যাচারই না করেছে!
একদিন রাতে তো দিদিকে সে একলা পেয়ে… না না, কাজটা মোটেই ঠিক হয়নি সেদিন! পরের দিন সকালেই তো দিদি কোথায় একটা চলে যায়!
অর্ণব এখন ঘামছে।

জামাইবাবুরাও তো একবারের জন্যও দিদির কোনো খোঁজ নেয়নি। সেই যে দিদিকে ওরা তাড়িয়ে দিল, ওদের দাবি মত কোন টাকাও দেয়নি অর্ণব, পুলিশের খবরও দেয়নি। বাড়িতে বোঝা হিসাবে পড়েছিল দিদি। মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে করতে মূর্তির মত হয়ে গিয়েছিল সে। সেই রাতের পর কোথায় গিয়েছিল, এতদিনে মরলো কিনা কে জানে! মনেপ্রাণে চেয়েছিল অর্ণব দিদির দেহটা যেন পাওয়া না যায়। সে রাতের ঘটনার জন্য যদি কোনও ভাবে ফেঁসে যায় সে!

অর্ণব আর তার মা, অন্যদিকে হয়ত বা সুতন্দ্রার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সকলেই আজ জানে তাদের ঘরের লক্ষ্মী পূজা আর কোনোদিনই সাফল্যমন্ডিত হবে না। মা লক্ষ্মী তাদের ঘর ত্যাগ করেছেন। তবু আজ তারা সকলেই আজ বড় নিশ্চুপ, ঠিক যেন এক একটা মূর্তি!

*********

© মোনালিসা সাহা দে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *