চেতনায় বিদ্যাসাগর কলমে-:মমতা শঙ্কর সিনহা(পালধী)
চেতনায় বিদ্যাসাগর
কলমে-:মমতা শঙ্কর সিনহা(পালধী)
ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়/ ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা এই দুই নামেই স্বাক্ষর করতেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়।ঊনিশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ,সমাজসংস্কারক, পন্ডিত, উদার মনষ্ক, বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্ম গ্রহণ করেন অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে(হুগলি জেলা, ব্রিটিশ ভারত) বিশিষ্ট পন্ডিত ভুবনেশ্বর বিদ্যালঙ্কার ও তাঁর স্ত্রী দুর্গাদেবীর জ্যেষ্ঠ পুত্র ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী ভগবতীদেবীর সন্তান রূপে।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৎকালীন সমাজে প্রচলিত বহুবিবাহ,বাল্যবিবাহের মত কু-প্রথা আইনত নিষিদ্ধ হয় এবং নারী শিক্ষার জন্য তিনি ব্রতী হন– স্ত্রী শিক্ষার প্রসার করে ও বিধবা বিবাহ প্রথাকে আইনত স্বীকৃতি দিয়ে।শোনা যায় লোকমাতা জানবাজারের রানী রাসমনীর জ্যেষ্ঠা কন্যার স্বল্পবয়সী বিধবা পুত্রবধূর সাথে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত এক ব্রাক্ষ্মণ সন্তানের বিবাহ হয় লর্ড বেন্টিক কর্তৃক বিধবা বিবাহ আইন পাশ করার পর। বাংলার নবজাগরণের পুরোধা ,অসামান্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে “দয়ার সাগর” নামে পরিচিত ছিলেন। দরিদ্র, আর্ত,পীড়িত সকলকে তিনি কখনোই শূন্য হাতে ফিরাতেন না।এমন কি নিজের চরম অর্থ সংকট কালেও নিজে চড়াসুদে ঋণ নিয়ে তাদের সাহায্য করতেন।তাঁর পিতামাতার প্রতি অগাধ ভক্তি শ্রদ্ধা,ঐকান্তিক ভক্তি,বজ্র কঠিন চরিত্রবল সত্যিই অসামান্য ও অনন্য করে তুলেছিল এই প্রবাদপ্রতীম স্বত্ত্বার মানুষটিকে।
১৮২৮ সালে নিজ গ্রামের পাঠশালার পাঠ শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য ছোট্ট ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর বাবার সাথে কলকাতায় চলে আসেন।পদব্রজে কলকাতায় আসার সময় রাস্তার ধারে পোঁতা বাটনা বাটা শিলের মত প্রস্তর খন্ডে ইংরেজি সংখ্যাগুলি দেখে অত্যুৎসাহী হয়ে তাঁর বাবার কাছে ঐ গুলি কি জানতে চান এবং যখন তাঁর বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় জানান ও গুলিকে মাইলস্টোন অর্থাত রাস্তার দূরত্ব পরিমাপের জন্য ব্যবহার করা হয় তখন শিশু ঈশ্বরচন্দ্র ও গুলির ওপর ইংরেজি শব্দগুলি অনায়াসে রপ্ত করে নেন।
কলকাতায় এসে সংস্কৃত কলেজে পড়াশুনা কালীন ১৮৩৪ সালে ক্ষীরপাই নিবাসী শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্যের কন্যা দীনময়ী দেবীর সাথে তাঁর বিবাহ হয়।১৮৩৬ সালে ঈশ্বরচন্দ্র মহাশয় অলঙ্কার শাস্ত্র পাঠ শেষ করেন।বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে রঘুবংশম, সাহিত্য দর্পণ,কাব্যপ্রকাশ,রত্নাবলী, মালতীমাধব,উওররামচরিত,
মুদ্রারাক্ষস,মৃচ্কছটিক প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ পারিতোষিক পান এবং সংস্কৃত কলেজ থেকে ঈশ্বরচন্দ্র মহাশয়ের ১৮৩৪ সালে প্রাপ্ত ৫টাকার মাসিক বৃত্তি বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল ৮টাকা।১৮৩৯ সালে ঈশ্বরচন্দ্র হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষাদেন এবং সেই পরীক্ষায় তিনি যথারীতি সম্মানের সাথে উত্তীর্ণ হলে হিন্দু ল কমিটি তাঁকে “বিদ্যাসাগর” উপাধীতে ভূষিত করে।সেই থেকে ঈশ্বরচন্দ্র মহাশয়ের নামের সাথে বিদ্যাসাগর উপাধীটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
১৮৪১ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে পাশ করার পর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান পন্ডিতের পদে মাসিক ৫০টাকার বেতনে চাকুরি গ্রহন করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়।এরপর ১৮৪৬ সালে সংস্কৃত কলেজে ঐ একই বেতনে সহকারী সম্পাদকের ভার গ্রহণ করেন ও ১৮৪৭ সালে সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটার নামে একটি বই এর দোকান। বেতাল পঞ্চবিংশতি ঈশ্বরচন্দ্র এর প্রথম গ্রন্থ।এরপর ১৮৪৭ সালে অন্নদামঙ্গল কাব্যগ্রন্থের দুটি খন্ডের সম্পাদনর পর সংস্কৃত কলেজের সেক্রেটারি রসময় দত্তের সাথে মতবিরোধের ফলে তিনি সংস্কৃত কলেজের সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের পর ,অনেক চড়াই উৎড়াই অতিক্রম করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় ১৮৫১ সালে ২২শে জানুয়ারি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।ঐ বছরই এপ্রিল মাসে রুডিমেন্টস অফ নলেজ অবলম্বনে রচিত বোধোদয় পুস্তকটি প্রকাশিত হয়।বর্ণপরিচয়,শকুন্তলা, আখ্যানমঞ্জরী, কথামালা,বোধোদয়,ভ্রান্তিবিলাস, অসংখ্য কাব্য গ্রন্থের জন্মদাতা,নারী শিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার অগ্রদূত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অবদান বাংলা সাহিত্য তথা সমাজে অবিস্মরনীয়।
১৮৭৫ সালে বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজের উইল তৈরী করেন এবং তিনি হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ডের ট্রাস্টি পদ থেকে ইস্তফা দেন।ঐ বছর কাশীতে তাঁর পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয় এবং বিদ্যাসাগর মহাশয় কলকাতার বাদুবাগানে নিজ গৃহ নির্মাণ করেন।১৮৭৭ সাল থেকে এই বাদুবাগানের বাড়িতে বিদ্যাসাগর মহাশয় স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন এবং ঐ বছর বাংলার গভর্নর কর্তৃক তাঁকে সম্মাননা লিপি প্রদান করা হয়।১৮৮২ সালে ৫ই অগাস্ট বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাদুবাগানের বাড়িতে শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব এসেছিলেন এবং তাঁদের দুজনার মধ্যে এক ঐতিহাসিক বাক্যালাপ হয়েছিল সেই সময়।
১৮৮২ সালের ৫ই আগস্ট শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার —
৫ই আগস্ট, ১৮৮২। শনিবার। তিথি‚ শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণাষষ্ঠী। সময়‚ বিকেল চারটে। স্থান‚ কলকাতার বাদুড়বাগান। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস জানেন‚ সাগরদর্শনের এ এক পরমলগ্ন।
এ সাগর যে সে সাগর নয়। বিদ্যার সাগর। শ্রীরামকৃষ্ণ একটি ঠিকে গাড়ি ভাড়া করেছেন। কলকাতার রাজপথ পেরিয়ে তিনি চলেছেন বাদুড়বাগানের দিকে। তাঁর সমস্ত মন সাগরময় হয়ে আছে। তিনি অনন্তের চৈতন্যে নিমগ্ন। দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো ? সাগরদর্শনের সঠিক সময় যে বিকেল চারটে ! ঘোড়া আরও জোরে ছুটছে না কেন ? সাগরদর্শনের পরম লগ্নটি যে দীপ্যমান হয়ে উঠেছে ঠাকুরের ধ্যানের মধ্যে !
শ্রীরামকৃষ্ণের ঠিকে গাড়ি এইমাত্র পেরোচ্ছে আমহার্স্ট স্ট্রিটে রামমোহন রায়ের বাগানবাড়ি। চারটে বাজতে এখনও কয়েক মিনিট বাকি। গাড়ি ছেড়েছে দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়ি থেকে। অনেক দূরের পথ। পোল পার হয়ে‚ শ্যামবাজার পার হয়ে গাড়ি আমহার্স্ট স্ট্রীটে পৌঁছেছে। ঠাকুরের সঙ্গে রয়েছেন তিন ভক্ত‚ ভবনাথ‚ হাজরা আর মাষ্টার (মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত)। একজন বললেন‚ বাদুড়বাগান এসে গেল বলে। আর একজন ঠাকুরকে বললেন‚ দেখুন‚ দেখুন‚ রাজা রামমোহনের কত বড় বাগানবাড়ি ! শ্রীরামকৃষ্ণ বেশ বিরক্ত হলেন। বললেন‚ ও সব ভোগবিলাসের কথা ভাল লাগছে না গো। তিনি ভাবাবিষ্ট হয়ে আছেন সাগরচৈতন্যে। সাগর তো অনন্ত। তিনি অনন্তে ডুবে আছেন। রামমোহনের বাগানবাড়ি দেখার কোনও সাধ নেই তাঁর।
শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মভূমি হুগলী জেলার কামারপুকুর গ্রাম। আর বিদ্যাসাগরের জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রাম। কামারপুকুর থেকে বীরসিংহ খুব দূরের পথ নয়। সেই কারণেই হয়তো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে খুব কাছের মানুষ মনে হয় শ্রীরামকৃষ্ণের। শুধুই মনে মনে এই নৈকট্য বোধ। ঠাকুরের মনে ভারী ইচ্ছে‚ বীরসিংহ গ্রামের সিংহটির সঙ্গে একবার অন্তত দেখা করার। সেই সুযোগ এল‚ যখন মাস্টার বিদ্যাসাগরের স্কুলে মাস্টারি শুরু করলেন। ‘মাস্টার‘ অর্থাৎ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতের রচয়িতা শ্রী ম। পুরোনাম‚ মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত। ঠাকুরের পরম ভক্ত। ঠাকুরই মাস্টারকে জিজ্ঞেস করলেন‚ আমাকে বিদ্যাসাগরের কাছে একদিন নিয়ে যাবে ? আহা‚ দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়িতে থাকতে-থাকতে বিদ্যে আর দয়ার কথা কত শুনেছি। তিনি বিদ্যেরও সাগর‚ দয়ারও সাগর।
মহেন্দ্র গুপ্ত বিদ্যাসাগরকে বললেন‚ দক্ষিণেশ্বরের শ্রীরামকৃষ্ণ আপনার সঙ্গে একদিন দেখা করতে চান। ভারী ইচ্ছে তাঁর‚ আপনার সঙ্গে আলাপ করার। বিদ্যাসাগর হেসে বললেন‚ তুমি তো জানো মাস্টার‚ আমি নাস্তিক মানুষ। ঈশ্বর সত্যিই আছেন কি না‚ সে-বিষয়ে আমার গভীর সন্দেহ। সত্যি কথা বলতে‚ ভগবানের ব্যাপারে আমার কোনও আগ্রহই নেই। সুতরাং সাধুসন্ন্যাসীদের কাছ থেকেও আমি দূরে থাকি। মাস্টার বিদ্যাসাগরের কথা শুনে নীরব রইলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বুঝলেন তিনি মহেন্দ্রকে আঘাত করেছেন। জিজ্ঞেস করলেন‚ বলতো মাস্টার‚ ইনি কীরকম পরমহংস ? তিনি কি গেরুয়া পরা সন্ন্যাসী ? মাস্টার এবার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চোখে চোখ রেখে কিঞ্চিৎ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন‚ আজ্ঞে না। তিনি এক অদ্ভুত পুরুষ। লালপেড়ে কাপড় পরেন। জামা পরেন। বার্নিশ করা চটি জুতো পরেন। রাসমণির কালীবাড়িতে একটি ঘরের ভেতর বাস করেন। সেই ঘরে তক্তাপোশ পাতা আছে। তার ওপর বিছানা। মশারিও আছে। সেই বিছানায় তিনি শয়ন করেন। তিনি যে সন্ন্যাসী‚ তার কোনও বাহ্যিক চিহ্ন নেই। তবে ঈশ্বর বই আর কিছু জানেন না। অহর্নিশি তাঁরই চিন্তা করেন। বিদ্যাসাগর মহেন্দ্রনাথের কথায় হেসে ফেললেন। বললেন‚ বেশ বেশ ! তাহলে তাঁকে নিয়ে এসো একদিন।
আপনি কবে যাবেন ? বিদ্যাসাগর আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে বললেন মহেন্দ্র। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের মধ্যে ডুব দিলেন। তাঁর চোখেমুখে ফুটে উঠল দৈব উদ্ভাস। শ্রীরামকৃষ্ণ মধুর কণ্ঠে বললেন‚ এই শনিবার‚ সেদিন শ্রাবণের কৃষ্ণাষষ্ঠী। সাগরদর্শনের লগ্ন বিকেল চারটে।
বিদ্যাসাগরের বয়েস ঠিক বাষট্টি। শ্রীরামকৃষ্ণ ষোল বছরের ছোট। তিনি ছেচল্লিশ। বিদ্যাসাগরের প্রতি তাঁর হৃদয়ে বড় শ্রদ্ধা আর ভালবাসা।
বিকেল ঠিক চারটে। শ্রীরামকৃষ্ণের ঠিকে গাড়ি এসে দাঁড়াল বিদ্যাসাগরের বাড়ির সামনে। ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হয়ে আছেন। মহেন্দ্র বললেন‚ এবার নামতে হবে। আমরা এসে গেছি। ঠাকুর ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নামলেন। মাস্টার পথ দেখিয়ে বাড়ির মধ্যে নিয়ে যাচ্ছেন। উঠোনে ফুল গাছ। ঠাকুর মুগ্ধ হয়ে বাড়িটি দেখছেন। কী সুন্দর বাড়ি ! শান্তির নীড়। সমস্ত বাড়িটি যেন ধ্যানের মন্দির‚ মনে হল শ্রীরামকৃষ্ণের। তিনি শুনেছেন ঈশ্বরচন্দ্র নাকি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না ! মৃদু হাসি ফুটে উঠল শ্রীরামকৃষ্ণের মুখে। চলতে-চলতে হঠাৎ তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। মহেন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন‚ কী হল‚ থামলেন কেন ? ঠাকুর নিজের জামার বোতামে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। বালকের সারল্য তাঁর মুখে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন‚ মাস্টার‚ আমার জামার বোতামটা যে খোলা রয়েছে‚ এতে কোনও দোষ হবে না তো ? শ্রীরামকৃষ্ণের গায়ে একটি লংক্লথের জামা। পরনে লালপেড়ে কাপড়। কাপড়ের কোঁচাটি কাঁধে ফেলা। পায়ে বার্নিশ করা চটিজুতো। মাস্টার বললেন‚ আপনি খোলা বোতাম নিয়ে ভাববেন না। আপনার বোতাম দেবার দরকার নেই। আপনার কিছুতে দোষ হবে না। বালককে বুঝালে যেমন নিশ্চিন্ত হয়‚ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস তেমনি নিশ্চিন্ত হলেন। তিনি চলতে শুরু করলেন মহেন্দ্রর পিছন পিছন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাড়িটি দোতলা। অধিকাংশ বাঙালী বাড়ির মতো নয়। এ-বাড়ি দেখলে ইংরেজের পছন্দ হবে। তবে বাড়তি বিলাসিতার চিহ্নও কোথাও নেই। বাড়িটি দেখলেই মনে হয়‚ বাড়িটি যাঁর‚ তিনি বিলাসবিরোধী। তাঁর আত্ম প্রত্যয় ও সংযম এতই বেশি যে তিনি নিজেকে কোনওভাবে জাহির করতে চান না। তিনি পছন্দ করেন নিভৃতি। উপভোগ করেন নির্জনতা। তিনি কাজের জীবন ও ব্যক্তিগত জীবনকে আলাদা করে রাখতে চান। তিনি একাকীত্বপ্রিয়। বিদ্যাসাগরের বাড়ির চারপাশে অনেকখানি খোলা জমি। জমিটি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বাড়ির পশ্চিম দিকে সদর দরজা। বেশ বড় গেটওলা বাড়ি। পশ্চিমদিকের প্রাচীর আর বাড়ির মাঝখানে একটি ফুলের বাগান। শ্রীরামকৃষ্ণ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন সেই ফুলগুলির দিকে। বিদ্যাসাগর ফুল ভালবাসেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বুঝতে পারেন‚ মানুষটির ওপর যতই কঠিন হোক‚ ভেতরটা নরম।
মাস্টার বলেন‚ এই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে আসুন। পশ্চিম দিকে নীচে একটা ঘর আছে। সেই ঘর থেকে ওপরে যাবার সিঁড়ি। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রথম ধাপটিতে পা রাখলেন। মহেন্দ্র দেখলেন‚ তাঁর চোখ দুটি এক আশ্চর্য আলোয় ঝলমল করছে। শ্রীরামকৃষ্ণ জানেন কী হতে চলেছে। তাঁর তৃতীয় নেত্র দেখতে পাচ্ছে ভবিষ্যৎ !
দোতলায় থাকেন বিদ্যাসাগর। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই উত্তরে একটি কামরা। তার পুবদিকে হলঘর। হলঘরের দক্ষিণ-পুবে বিদ্যাসাগরের শোবার ঘর। তার দক্ষিণে আরও একটি কামরা। এই কামরাগুলি বহুমূল্য পুস্তকে পরিপূর্ণ। দেওয়ালের কাছে সারিসারি অনেকগুলি পুস্তকাধার। তাতে বাঁধানো বইগুলো কী সুন্দরভাবে সাজানো ! একসঙ্গে এত বই ! বালকের মতো অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন শ্রীরামকৃষ্ণ। এত জেনেও মানুষটি ‘এক‘-কে জানেনি ! ‘এক‘-কে জানাই তো সব জানা। তাঁকে না জানলে আর সব জানাই তো বৃথা। তিনি এগিয়ে চলেন বিদ্যাসাগরের ঘরের দিকে।
হলঘরটার পুবদিকে একেবারে শেষে একটি টেবিল ও চেয়ার। বিদ্যাসাগর যখন কাজ করেন তখন এখানে তিনি পশ্চিমাস্য হয়ে বসেন। টেবিলের চারধারে চেয়ার। যাঁরা কাজের সময় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন‚ তাঁরা সেই চেয়ারে বসেন। বিদ্যাসাগরের টেবিলে লেখাপড়ার অনেক সামগ্রী — কাগজ‚ কলম‚ দোয়াত‚ কালি‚ ব্লটিং-পেপার‚ হিসাব-পত্রের বাঁধানো খাতা‚ দু‘চারখানি বিদ্যাসাগর-প্রণীত পাঠ্যপুস্তকও আছে।
এই কাজের ঘরের ঠিক দক্ষিণে‚ বিদ্যাসাগরের কাঠের চেয়ারটির ঠিক পাশেই বলা যায়‚ তাঁর বিছানা। কাজের শেষে তাঁর বিশ্রাম ও নিদ্রার জায়গা। বিদ্যাসাগরের টেবিলে অন্যান্য জিনিসের মধ্যে ছড়ানো আছে অনেক চিঠিপত্রও। চিঠিগুলির দিকে এবার একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক — কোনও বিধবা লিখেছে‚ আমার অপোগণ্ড শিশু অনাথ‚ দেখবার কেউ নেই‚ আপনাকে দেখতে
হবে। আর একজন লিখছে‚ আপনি কার্মাটার চলে গিয়েছিলেন‚ তাই আমরা মাসোহারা ঠিক সময়ে পাইনি। বড় কষ্ট হচ্ছে। এক গরিব ছাত্র লিখছে‚ আপনার স্কুলে ফ্রি ভর্তি হয়েছি‚ কিন্তু আমার বই কেনবার ক্ষমতা নেই। কেউ বা লিখেছে‚ আমার পরিবারবর্গ খেতে পাচ্ছে না‚ আমাকে একটা চাকরি করে দিতে হবে।
বিদ্যাসাগরের স্কুলের এক শিক্ষকের চিঠিও আছে — আমার ভগিনী বিধবা হয়েছে‚ তার সমস্ত ভার আমাকে নিতে হয়েছে। এ বেতনে আমার চলে না। কেউ লিখছেন‚ অমুক তারিখে সালিসির দিন নির্ধারিত। আপনি সেদিন এসে আমাদের বিবাদ মিটিয়ে দিন। একটি ইংরেজি চিঠি এসেছে বিলেত থেকে। নির্ভুল‚ সুঠাম ইংরেজিতে পত্রদাতার বক্তব্য – আমি এই প্রবাসে বিপদগ্রস্ত‚ ঋণে আকণ্ঠ ডুবে আছি‚ উপবাসে কাটছে‚ আপনি দীনের বন্ধু‚ দয়ার সাগর‚ কিছু টাকা পাঠিয়ে বিপদ থেকে আমাকে রক্ষা করুন।
করুণাময় বিদ্যাসাগরের হৃদয় কাঁদে সকলের জন্য। কাউকে তিনি ‘না‘ বলতে পারেন না। সাহায্যপ্রার্থীর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারেন না কখনও।
শ্রীরামকৃষ্ণের মনে একটি প্রশ্ন — প্রথম দেখা হওয়ার সময় বিদ্যাসাগর দক্ষিণমুখী হয়ে বসবে তো ? সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। উঠে এসেই প্রবেশ করলেন উত্তরের ঘরটিতে। ভক্তেরাও এল সঙ্গে। ঠাকুর দেখলেন‚ বিদ্যাসাগর আজ দক্ষিণাস্য হয়েই বসে আছেন ! ঠাকুর একবার শুধু বললেন‚ জয় মা !
বিদ্যাসাগর ঘরের উত্তর কোণে দক্ষিণমুখী। তাঁর সামনে পালিশ করা চারকোণা লম্বা টেবিল। টেবিলের পুব দিকে একখানি বেঞ্চ। দক্ষিণে ও পশ্চিমে কয়েকটি চেয়ার। বিদ্যাসাগর কাজ করছেন না‚ তাই তিনি পশ্চিমাস্য নন। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের জন্য অপেক্ষা করছেন আর দক্ষিণাস্য হয়ে দু-একটি বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছেন।
ঠাকুর প্রবেশ করতেই বিদ্যাসাগর দাঁড়িয়ে উঠে তাঁকে অভ্যর্থনা করলেন। ঠাকুর একদৃষ্টে বিদ্যাসাগরের দিকে তাকিয়ে। তাঁরা যেন পূর্বপরিচিত। ঠাকুরের মুখে মধুর হাসি। বিদ্যাসাগর চুপ করে দাঁড়িয়ে। তাঁর পরনে থান কাপড়। পায়ে চটিজুতো। গায়ে একটি হাতকাটা ফ্লানেলের ফতুয়া। মাথার চারপাশ কামানো। তিনি একটু হাসলেন। দাঁতগুলি উজ্জ্বল। সমস্তই বাঁধানো দাঁত। বিদ্যাসাগরের মাথাটি অস্বাভাবিক বড়। উন্নত ললাট। বিদ্যাসাগর বেশ বেঁটে। গলায় মোটা উপবীত‚ ফতুয়ার পাশ থেকে বেড়িয়ে আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট। তিনি একইভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। আর ভাব সংবরণ করবার জন্যে মধ্যে মধ্যে বলছেন‚ জল খাবো। দেখতে-দেখতে বাড়ির ছেলেরা ও আত্মীয় বন্ধুরা এসে দাঁড়ালেন।
ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হয়ে বেঞ্চে বসে পড়লেন। আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শরীরে জ্বালা ধরল। একটি সতেরো-আঠেরো বছরের ছেলে সেই বেঞ্চিতে বসে আছে। বিদ্যাসাগরের কাছে পড়াশোনার সাহায্য প্রার্থনা করতে এসেছে ছেলেটি। ঠাকুর ভাবাবিষ্ট। ঋষির অন্তর্দৃষ্টি তাঁর। ছেলেটির অন্তরের ভাব তিনি বুঝে ফেলেছেন। তাই তাঁর শরীরে জ্বালা। ঠাকুর ছেলেটির কাছ থেকে দূরে সরে গেলেন। বললেন‚ মা‚ এ ছেলের বড় লোভ। সংসার ছাড়া কিছু বোঝে না। মা গো‚ তোমার অবিদ্যার সংসার ! এ অবিদ্যার ছেলে ! যে ব্যক্তি ব্রহ্মবিদ্যার জন্য ব্যাকুল নয়‚ শুধু চায় অর্থকরী বিদ্যা‚ ঠাকুর তাকেই বলছেন অবিদ্যার সংসারে অবিদ্যার ছেলে !
বিদ্যাসাগর ধাক্কা খেলেন। এক ধাক্কাতেই চিড় ধরল তাঁর প্রত্যয়ে। তিনি নিজেও তো ব্রহ্মবিদ্যার কথা ভাবেন না কখনও ! বিদ্যাসাগর ব্যস্ত হয়ে একজনকে জল আনতে বললেন। তারপর মহেন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলেন‚ মাস্টার‚ কিছু খাবার আনালে ইনি খাবেন কি ? মহেন্দ্র বললেন‚ আজ্ঞে‚ আনুন না। বিদ্যাসাগর নিজেই ভিতরে গিয়ে কতকগুলি মিঠাই আনলেন। বললেন‚ এগুলি বর্ধমান থেকে এসেছে।
ঠাকুর কিছু খেলেন। হাজরা‚ ভবনাথও কিছু পেলেন। বিদ্যাসাগর মহেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন‚ তুমি তো ঘরের ছেলে। ঠাকুর মিষ্টিমুখ করছেন আর বালকের মতো হাসছেন। দেখতে-দেখতে একঘর লোক হয়ে গেল। কেউ বসে। কেউ দাঁড়িয়ে।
ঠাকুর এতক্ষণ বিশেষ কথা বলেননি। এবার একঘর লোকের সামনে বিদ্যাসাগরের দিকে তাকিয়ে বললেন‚ আজ সাগরে এসে মিললাম। এতদিন খাল – বিল – হদ্দনদী দেখেছি। এইবার সাগর দেখছি।
ঠাকুরের এই প্রাণখোলা বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতায় সবাই হাসতে আরম্ভ করল। বিদ্যাসাগরও কম যান না। তিনি সহাস্যে বললেন‚ তবে নোনা জল খানিকটা নিয়ে যান।
ঠাকুর সঙ্গে সঙ্গে বললেন‚ না গো ! নোনা জল কেন ? তুমি তো অবিদ্যার সাগর নও। বিদ্যার সাগর। তুমি ক্ষীরসমুদ্র। ঘরের সকলে হেসে উঠলেন। বিদ্যাসাগর দেখলেন ঠাকুরের সঙ্গে কথায় পারবেন না। শুধু বললেন‚ ক্ষীর-সমুদ্র ! তা বলতে পারেন বটে !
বিদ্যাসাগর চুপ। কথা বলছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। বিদ্যাসাগর শুনছেন। মাঝে মধ্যে প্রশ্ন করছেন আগ্রহী ছাত্রের মতো। ঠাকুর একেবারেই লেখাপড়া জানেন না। নিজের নামটিও সই করতে পারেন না। তবু ঠাকুর বলছেন। আর শুনছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ! বিদ্যাসাগরের মনে হচ্ছে‚ বেদান্ত উচ্চারিত হচ্ছে ঠাকুরের কণ্ঠে ! অথচ কী সহজ সরল শ্রীরামকৃষ্ণের মুখের ভাষা !
শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন‚ তোমার কর্ম সাত্ত্বিক কর্ম। সত্ত্বগুণ থেকে দয়া হয়। দয়ার জন্য যে কর্ম করা যায়‚ সে রাজসিক কর্ম বটে‚ কিন্তু এ রজোগুণ সত্ত্বের রজোগুণ‚ এতে দোষ নেই। শুকদেবাদি লোকশিক্ষার জন্যে দয়া রেখেছিলেন। ঈশ্বর-বিষয় শিক্ষা দেবার জন্যে। তুমি বিদ্যাদান‚ অন্নদান করছ‚ এও ভাল। নিষ্কাম করতে পারলেই এতে ভগবান লাভ হয়। কেউ কেউ করে নামের জন্যে‚ কেউ করে পুণ্যের জন্যে। তাদের কর্ম নিষ্কাম নয়। আর সিদ্ধ তো তুমি আছোই।
বিদ্যাসাগর শ্রীরামকৃষ্ণের শেষ কথাটার অর্থ ঠিক ঠাওর করতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন‚ আমি সিদ্ধ ! কেমন করে ?
শ্রীরামকৃষ্ণ ভারি মিঠে করে উত্তর দিলেন‚ আলু পটল সিদ্ধ হলে তো নরম হয়। তা তুমি তো খুব নরম। তোমার অত দয়া ! সকলে হেসে উঠলেন।
বিদ্যাসাগর রসিক মানুষ। মুহূর্তে বললেন‚ কলাইবাটা সিদ্ধ তো শক্তই হয়। আবার সকলের হাসি। এবার ঠাকুর কী বলবেন ?
ঠাকুর বললেন‚ তুমি তা নও গো। ‘শুধু‘ পণ্ডিতগুলো দরকচাপড়া। তুমি তো শুধু পণ্ডিত নও। তুমি বিদ্যার সমুদ্র। শুধু পণ্ডিতগুলোর না এদিক‚ না ওদিক। শকুনি খুব উঁচুতে ওঠে। কিন্তু নজর ভাগাড়ে। যারা শুধু পণ্ডিত‚ শুনতেই পন্ডিত। কিন্তু তাদের কামিনীকাঞ্চনে আসক্তি — শকুনের মতো পচামড়া খুঁজছে। আসক্তি অবিদ্যার সংসারে। দয়া‚ ভক্তি‚ বৈরাগ্য বিদ্যার ঐশ্বর্য।
বিদ্যাসাগর নীরব। তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন এক আনন্দময় পুরুষের দিকে। পান করছেন তাঁর কথামৃত।
বিদ্যাসাগর মহাপণ্ডিত। তিনি ষড়দর্শন পাঠ করেছেন। জানতে চেয়েছেন ঈশ্বরকে। আর এইটুকু বুঝতে পেরেছেন যে‚ ঈশ্বরের বিষয়ে কিছুই জানা যায় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ তাকালেন বিদ্যাসাগরের দিকে। যেন বুঝতে পারলেন বিদ্যাসাগরের মনের কথা। বললেন‚ ব্রহ্মবিদ্যা ও অবিদ্যার পার। তিনি মায়াতীত। মহাপণ্ডিত বিদ্যাসাগর শুনছেন মুগ্ধ বিস্ময়ে।
বলে চলেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ — এই জগতে বিদ্যামায়া-অবিদ্যামায়া দুই আছে। জ্ঞান-ভক্তি আছে। আবার কামিনীকাঞ্চনও আছে। সৎ-ও আছে। আবার অসৎ-ও আছে। ভাল আছে। আবার মন্দও আছে। কিন্তু ব্রহ্ম নির্লিপ্ত। ভাল-মন্দ জীবের পক্ষে। সৎ-অসৎ জীবের পক্ষে। ব্রহ্মের ওতে কিছু হয় না।
বিদ্যাসাগর বললেন‚ একটু ব্যাখ্যা করে‚ আরও সহজ করে বুঝিয়ে দিন।
শ্রীরামকৃষ্ণ সহজ সরল হাসি হেসে বললেন‚ প্রদীপ যেমন নির্লিপ্ত‚ ব্রহ্মও সেইরকম। প্রদীপের সামনে কেউ ভাগবত পড়ছে আর কেউ বা জাল করছে। প্রদীপের তাতে কিছু যায় আসে না। কোনও কাজটির সঙ্গেই প্রদীপ যুক্ত হচ্ছে না। সে নির্লিপ্তভাবে শুধু জ্বলছে। যদি বলো দুঃখ‚ পাপ‚ অশান্তি এ সকল তবে কী ? তার উত্তর এই যে ওসব জীবের পক্ষে। ব্রহ্ম নির্লিপ্ত। যেমন ধরো সাপের মধ্যে বিষ আছে। অন্যকে কামড়ালে মরে যায়। সাপের কিন্তু কিছু হয় না।
বিদ্যাসাগরের মুখে রা নেই। তিনি ক্রমে বুঝতে পারছেন‚ এক নিরক্ষর ব্রাহ্মণের মুখে বেদান্ত কী সহজ সরল ভাষায় উচ্চারিত হচ্ছে !
শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন‚ ব্রহ্ম যে কী মুখে বলা যায় না। সব জিনিস উচ্ছিষ্ট হয়ে গেছে। বেদ‚ পুরাণ‚ তন্ত্র‚ ষড়দর্শন‚ সব এঁটো। থামলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তাকালেন বিদ্যাসাগরের মুখের দিকে।
বিস্মিত বিদ্যাসাগর প্রশ্ন করলেন‚ এঁটো কেন ?
শ্রীরামকৃষ্ণ হেসে উত্তর দিলেন‚ মুখে পড়া হয়েছে‚ মুখে উচ্চারণ হয়েছে‚ তাই এঁটো হয়ে গেছে। কিন্তু একটি জিনিস কেবল উচ্ছিষ্ট হয়নি গো ! সেই জিনিসটি ব্রহ্ম। ব্রহ্ম যে কী‚ আজ পর্যন্ত কেউ মুখে বলতে পারেনি।
বিদ্যাসাগরের বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে উঠল। আবেগে কাঁপছে তাঁর শরীর। শ্রীরামকৃষ্ণ বয়েসে অনেক ছোট‚ তবু বিদ্যাসাগরের ইচ্ছে হল তাঁর কাছে নতজানু হওয়ার। তিনি শুধু কম্পিত কণ্ঠে বললেন‚ আজ একটি নতুন কথা শিখলাম। ব্রহ্ম উচ্ছিষ্ট হননি !
ঘরে তখন অনেক মানুষের ভিড় হয়ে গেছে। সবাই শুনছে ঠাকুরের কথা। কী সহজ‚ কী প্রাণস্পর্শী‚ কী গভীর ! ঠাকুর কী অনায়াসে আড়াল সরিয়ে দিচ্ছেন ! ফুটে উঠছে নতুন আলো। জাগ্রত হচ্ছে নব চেতনা। উদ্ঘাটিত হচ্ছে সত্যের মুখ।
শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন‚ এবার একটা গল্প বলছি‚ শোনো। এক বাপের দুটি ছেলে। ব্রহ্মবিদ্যা শেখবার জন্যে ছেলে দুটোকে বাপ আচার্যের হাতে দিলেন। কয়েক বছর পরে তারা গুরুগৃহ থেকে ফিরে এল। এসে বাপকে প্রণাম করলে। বাপের এবার ইচ্ছে হল‚ এদের ব্রহ্মজ্ঞান কেমন হয়েছে একটু বাজিয়ে দেখবার।
বড় ছেলেকে জিগ্যেস করলেন‚ বাপ ! তুমি তো সব পড়েছো। ব্রহ্ম কীরূপ বলো দেখি। বড় ছেলেটি বেদ থেকে নানা শ্লোক বলে বলে ব্রহ্মের স্বরূপ বোঝাতে লাগল। বাপ শুনলেন। কোনও কথা বললেন না। বড় ছেলে বাপের মনের ভাব বুঝতে পারল না।
এবার ছোট ছেলেকে বললেন‚ তুমি বলো দেখি ব্রহ্মের কী রূপ ? ছোট ছেলের মুখে কোনও কথা নেই। সে হেঁট মুখে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকল। বাপ প্রসন্ন হয়ে ছোট ছেলেকে বললেন‚ বাপু‚ তুমি একটু বুঝেছো। ব্রহ্ম যে কী তা মুখে বলা যায় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ কিছুক্ষণ থামলেন। তিনি জানেন‚ সাধারণ মানুষকে তাঁর কথার মর্ম বুঝতে একটু সময় দিতে হয়। তারপর তাঁর গল্পের সূত্রটি ধরেই বললেন‚ মানুষ মনে করে আমরা তাঁকে জেনে ফেলেছি। কিন্তু সত্যি কি জানা যায় ? জানা গেলেও কতটুকুই বা জানা যায় তাঁকে ?
বিদ্যাসাগর নিবিষ্ট হয়ে শুনছেন। আর অপলক তাকিয়ে আছেন শ্রীরামকৃষ্ণের দিকে। আর কারও কথা শুনে কখনও এমন ঘোর লাগেনি তাঁর।
শ্রীরামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরের মুখের দিকে তাকিয়েই বললেন‚ আর একটা গল্প বলছি শোনো। একটা পিঁপড়ে চিনির পাহাড়ে গিছলো। এক দানা খেয়ে পেট ভরে গেল। আর এক দানা মুখে করে সে বাসার পথে চলেছে। যাবার সময় ভাবল‚ এবার এসে সব পাহাড়টা নিয়ে যাব। ক্ষুদ্র জীবেরা এইসব মনে করে। জানে না ব্রহ্ম বাক্যমনের অতীত ! যে যতই বড় হোক না কেন‚ তাঁকে জানা যায় না।
বিদ্যাসাগর হঠাৎ বলে ফেললেন‚ কেন শুকদেব ? তিনি তো …
শ্রীরামকৃষ্ণ হেসে বললেন‚ শুকদেবাদি না হয় ডেঁও পিঁপড়ে। চিনির আট-নটা দানা না হয় মুখে করেছে। তার বেশি নয়।
ঘরে এত মানুষ। তবু পিন পড়লে শব্দ পাওয়া যাবে। রোজ কত পণ্ডিত মানুষের আসা-যাওয়া বিদ্যাসাগরের বাড়িতে। কিন্তু এমন জীবন্ত বেদান্ত কখনও দেখিনি ! শ্রীরামকৃষ্ণের কথা শুনছেন আর ভাবছেন বিদ্যাসাগর।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলতে লাগলেন‚ তবে বেদে পুরাণে যা বলেছে‚ সে কী রকম বলা জানো ?
বিদ্যাসাগর বুঝলেন‚ ঘরের মধ্যে আর কেউ না বুঝুক তিনি অন্তত ধারণা করতে পারলেন‚ শ্রীরামকৃষ্ণের কণ্ঠে নতুনভাবে ব্যাখ্যাত হতে চলেছে বেদ ও পুরাণ ! তিনি উদগ্রীব হয়ে শুনছেন।
ঠাকুর বললেন‚ একজন সাগর দেখে এলে কেউ যদি জিগ্যেস করে‚ কেমন দেখলে‚ সে লোক মুখ হাঁ করে বলে‚ — ও ! কী দেখলুম ! কী হিল্লোল‚ কল্লোল। ব্রহ্মের কথাও সেই রকম। বেদে আছে তিনি আনন্দস্বরূপ। সচ্চিদানন্দ।
বিস্মিত বিদ্যাসাগর। শ্রীরামকৃষ্ণ বেদ পড়েছেন ! তিনি তো নিরক্ষর। বিদ্যাসাগর কী ভাবছেন‚ শ্রীরামকৃষ্ণ যেন বুঝতে পারলেন।
বললেন‚ শুকদেবাদি এই ব্রহ্মসাগর-তটে দাঁড়িয়ে দর্শন স্পর্শন করেছিলেন মাত্র। তাঁরা কিন্তু ব্রহ্মসাগরে নামেননি। এ সাগরে নামলে আর ফেরবার জো নেই গো।
ঠাকুরের কথায় চমকে উঠলেন বিদ্যাসাগর। এতো একেবারে নতুন কথা। অথচ কী অবলীলায় কথাটি বললেন পরমহংস !
বিদ্যাসাগর প্রশ্ন করলেন তাহলে ব্রহ্মাণ্ডজ্ঞান হওয়ার উপায় ?
ঠাকুর উত্তর দিলেন‚ সমাধিস্থ হলে ব্রহ্মজ্ঞান হয়। সেই অবস্থায় বিচার একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ চুপ হয়ে যায়। ব্রহ্ম কী বস্তু‚ মুখে বলবার শক্তি থাকে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ আর একটা গল্প বললেন — নুনের পুতুল সমুদ্র মাপতে গিছলো। কত গভীর জল সেই খবরটা সে দিয়ে চেয়েছিল। কিন্তু খবর দেওয়া আর হল না। যেই নামল জলে অমনি গেল গলে। কে আর খবর দেবে ?
একজন প্রশ্ন করলেন‚ সমাধিস্থ ব্যক্তি যাঁর ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে তিনি কী আর কথা কন না ?
বিদ্যাসাগরকে চমকে দিল ঠাকুরের বিদ্যুতের মতো উত্তর।
শঙ্করাচার্য লোকশিক্ষার জন্য বিদ্যার ‘আমি’ রেখেছিলেন। বিদ্যাসাগর এই কথার গভীর অর্থটুকু বুঝতে পারলেন। আপাত অশিক্ষিত একটি মানুষের জ্ঞানের ব্যাপ্তি ও গভীরতা দেখে তিনি স্তম্ভিত !
শ্রীরামকৃষ্ণ এবার আরও সহজ করে তাঁর বক্তব্যের সারাৎসার তুলে ধরলেন — ব্রহ্মদর্শন হলে মানুষ চুপ হয়ে যায়। যতক্ষণ দর্শন না হয়‚ ততক্ষণই বিচার তেমনি সমাধিত পুরুষ — লোকশিক্ষা দেবার জন্য আবার নেমে আসে আবার কথা কয়।
বিদ্যাসাগরের চোখে একইসঙ্গে ফুটে ওঠে মুগ্ধতা আর শ্রদ্ধা। তাঁর মন বলে ওঠে ‚ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস সেই পুরুষ তো তুমি নিজে। সমাধিস্থ হয়েও লোকশিক্ষার জন নেমে এসেছো‚ কথা বলছো !
শ্রীরামকৃষ্ণ এবার ব্রহ্মজ্ঞানীর স্বরূপ অন্যভাবে ফুটিয়ে তোলেন্ — যতক্ষণ মৌমাছি ফুলে না বসে ততক্ষণ ভনভন করে‚ ফুলে বসে মধুপান করতে আরম্ভ করলে চুপ হয়ে যায়। মধুপান করে মাতাল হবার পরে আবার কখনও-কখনও গুনগুন করে। পুকুরে কলসিতে জল ভরার সময় ভকভক শব্দ হয়। পূর্ণ হয়ে গেলে আর শব্দ নেই। তবে আর এক কলসিতে যদি ঢালাঢালি হয় তাহলে আবার শব্দ হয়।
একজন হঠাৎ বললেন‚ ঋষিদের কি ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছিল ?
শ্রীরামকৃষ্ণ উত্তর দিলেন‚ হ্যাঁ হয়েছিল। বিষয়বুদ্ধির লেশমাত্র থাকলে এই ব্রহ্মজ্ঞান হয় না। ঋষিরা দেখা-শোনা-ছোঁয়া এসবের বিষয় থেকে মনকে আলাদা রাখত। সমস্ত দিন ধ্যান করে কাটত। তবে ব্রহ্মকে বোধে বোধ করত।
এবার সরাসরি বিদ্যাসাগরের দিকে তাকালেন ঠাকুর। বললেন‚ কলিতে অন্নগত প্রাণ। দেহ বৃদ্ধি যায় না। যারা বিষয় ত্যাগ করতে পারে না‚ তাদের ‘আমি’ কোনওভাবে যায় না। তাদের বরং ‘আমি ব্রহ্ম’ না বলে বলা উচিত আমি ভক্ত‚ আমি দাস। এ অভিমান ভাল। ভক্তিপথে থাকলেও তাঁকে পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগরকে যেন সরাসরি বলছেন ঠাকুর — জ্ঞানীর পথও পথ। আবার জ্ঞান-ভক্তির পথও পথ। আবার ভক্তির পথও পথ। জ্ঞানযোগও সত্য। ভক্তির পথও সত্য। সব পথ দিয়েই তাঁর কাছে যাওয়া যায়। কিন্তু যতক্ষণ তিনি ‘আমি’ রেখেছেন আমাদের মধ্যে ততক্ষণ ভক্তিপথই সোজা।
শ্রীরামকৃষ্ণ এবার যেন শুধু বিদ্যাসাগরকেই দেখছেন। তিনি এই মহাপণ্ডিতকে বললেন‚ বিজ্ঞানী কী বলে ? বিজ্ঞানী বলে‚ যিনি ব্রহ্ম‚ তিনিই ভগবান। অর্থ বুঝিয়ে দিচ্ছি। ব্রহ্ম নির্গুণ। তিনি গুণাতীত। ভগবান ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ। এই জীবজগৎ‚ মন বুদ্ধি‚ বৈরাগ্য‚ জ্ঞান‚ এসব তাঁর ঐশ্বর্য। দেখো না এই জগৎ কী চমৎকার। কত রকম জিনিস‚ চন্দ্র‚ সূর্য‚ নক্ষত্র। কত রকম জীব। বড় ছোট ভালমন্দ কারু বেশি শক্তি‚ কারু কম শক্তি। ব্রহ্মই ভগবান হয়েন।
১৮৮৩ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নির্বাচিত হন বিদ্যাসাগর মহাশয়।ঐ বছরই তিনি বাণভট্টের হর্ষচরিত নিজ সম্পাদনায় প্রকাশ করেন।১৮৮৪ সালে “কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য” ছদ্মনামে ব্রজবিলাস গ্রন্থ প্রকাশ করেন।”কস্যচিৎ তত্বান্বষিণ” ছদ্মনামে বিধবা বিবাহ ও যশোরের হিন্দুধর্মরক্ষিনীসভা পুস্তক প্রকাশ করেন।এছাড়াও আরও অনেক সমাজসংস্কার মূলক কাজের মাঝে তিনি তাঁর মা’য়ের নামে নিজ জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রামে ভগবতী বিদ্যালয় স্থাপন করেন নারী শিক্ষার জন্য।শ্লোকমঞ্জরী প্রকাশ করেন ১৮৯০ সালের ১৪ই মে।এরপর ১৮৯১ সালের ২৯শে জুলাই ৭০বছর বয়সে লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় পরলোক গমণ করেন ।