# সীমান্ত # পর্ব – ১৫ কলমে – অরণ্যানী

# সীমান্ত # পর্ব – ১৫
কলমে – অরণ্যানী

মিনুকে বাঁচানোর চেষ্টায় মেঘ :-
মেঘ মিনুকে নিয়ে তার বাসস্থানের কাছে এলো। ওদের দেখে এগিয়ে এলো কয়েকজন আদিবাসী মহিলা। মেঘ মিনুকে একটা গাছের নিচে শুইয়ে দিল।
এক মহিলা – কী হয়েছে? কাদের মেয়ে?
মেঘ – জানি না। বুকে তীর লেগে গেছে। ওকে বাঁচাতে হবে।
যে বস্ত্রখন্ডটা মেঘ মিনুর বুকে চেপে ধরেছিল, সেটা ততক্ষণে রক্তে ভিজে গেছে। মহিলারা অন্য বস্ত্রখন্ড এনে বেঁধে দিল। মেঘ জঙ্গলের মধ্যে বিশেষ ধরণের পাতা খুঁজছিল। এক মহিলা দেখিয়ে দিল লাল রঙের পাতাওয়ালা বুনোগাছ। মেঘ কিছু পাতা ছিঁড়ে নিয়ে এলো। মহিলারা মিনুর রক্তাক্ত জামাটা ছাড়িয়ে গায়ে একটা চাদর চাপা দিয়ে রেখেছিল। মেঘ পাতাগুলো জলে ধুয়ে দু’হাতে রগড়িয়ে রস বের করে তারপর মিনুর গায়ের চাদর সরিয়ে ক্ষতস্থানের বাঁধন খুলে পাতার রসটা দিতে থাকল। মিনু অচৈতন্য অবস্থায় শুয়েছিল। সকলে উৎসুক ও চিন্তিত মনে কী ঘটে তার প্রতীক্ষায়। মেঘ এরপর থেতলানো পাতাগুলো ক্ষতস্থানে আস্তে আস্তে চেপে ধরে থাকল একটু সময়। ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাত ধীরে ধীরে কমতে থাকল। বিকেলের পড়ন্ত সোনালি রোদ এসে পড়ল গাছতলায়। কলসি করে জল এলো। এলো আরো নানারকম ঘাস, পাতা, ও শেকড়। মহিলারা পাথরখন্ড দিয়ে সেগুলো থেঁতো করে রস বের করছিল। একজন একটা পরিষ্কার বস্ত্রখন্ড নিয়ে এলো। মেঘ মিনুর ক্ষতস্থান থেকে হাত সরিয়ে নিল। পাতার লাল রসে ও রক্তে মেঘের হাত রাঙা। পাতাগুলো হাত থেকে ফেলে মেঘ নিজের রক্তাক্ত হাতের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর কলসির জলে হাত ধুয়ে পরিষ্কার বস্ত্রখন্ড দিয়ে মিনুর ক্ষতস্থান আবার পরিষ্কার করে দিল। পরিষ্কার করতে দেখা গেল রক্তপাত বন্ধ হয়েছে। ক্ষতও খুব বেশি বিপজ্জনক নয়। এরপর ভিজে বস্ত্রখন্ড দিয়ে মেঘ মিনুর স্তনদুটিও পরিষ্কার করে দিল। অদ্ভুত এক শিহরণ তার শরীরে খেলে গেল। তাই দেখে মহিলারা লজ্জা পেল। এক বয়স্কা মহিলা এগিয়ে এলো।
– সর্ সর্, এই তোরা ওষুধটা এদিকে দে। মহিলারা তাদের থেঁতো করা রস একটি পাত্রে করে বয়স্কা মহিলাটির দিকে এগিয়ে দিল। কিন্তু মেঘ সেখান থেকে সরল না। মিনুর অচৈতন্য মুখ, উন্মুক্ত দুটি স্তন, ও ক্ষতস্থানের দিকে আবেগপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বয়স্ক মহিলা ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে মিনুর গায়ে চাদর চাপা দিয়ে দিল। মেঘ তখন মিনুর অচৈতন্য মুখের দিকেই একদৃষ্টে চেয়ে রইল। মহিলাটি মিনুর নাকের কাছে হাত দিয়ে নিশ্বাস পড়ছে কিনা দেখল।
মেঘ উদ্বিগ্ন ভাবে প্রশ্ন করল – বেঁচে আছে?
মহিলা – হ্যাঁ। এখন তো অজ্ঞান। দেখো কী হয়। অনেক রক্ত তো শরীর থেকে বেরিয়ে গেছে। তবে খুব বেশি করে তীর বেঁধেনি। কিন্তু তীর মারল কে? কী করেছিল ও? দেখে তো মনে হয় গাঁয়ের মেয়ে। আমাদের জাতি তো নয়।
মেঘ কোনো উত্তর না দিয়ে মিনুর মুখের দিকেই করুণ চোখে তাকিয়ে রইল।
মহিলা – কী হলো? উত্তর দিচ্ছ না? গাঁয়ের লোক তো এখানে এসে আমাদের সাথে ঝামেলা করবে। মানুষকে তীর মারতে গেলে কেন? তাও আবার মেয়েমানুষ!
মেঘ এবারও কোনো উত্তর দিল না। ওর চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে মাটিতে পড়ল।

এদিকে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আদিবাসী দলের সকলে ফিরে আসতে থাকল। মহিলারা গিয়ে তাদের কাছে সব খবর দিল। মেঘ একা চুপ করে বসে রইল মিনুর পাশে। দলপতি এগিয়ে এলো মেঘের দিকে – নদীর ওপারের গাঁয়ের মেয়ে মনে হয়। গাঁয়ের লোকেরা এলে কী জবাব দেবে?
মেঘ নীরবে চাদর ঢাকা অবস্থায় মিনুকে দু’হাতে তুলে নিয়ে মাচার উপর নিজের ঘরে এনে শুইয়ে দিল। আদিবাসীরা নিজেদের মধ্যে অনেক কিছু বলাবলি করতে লাগলো। ধীরে ধীরে আরো আধাঁর নামল। আকাশে চাঁদ উঠল। চাঁদের আলো ছাউনির ফাঁক দিয়ে মেঘের ঘরে এসে পড়ল। আবছা আলোয় মিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে মেঘ চুপচাপ বসে রইল। একসময় এক টুকরো চাঁদের আলো এসে মিনুর মুখে পড়ল। মেঘ হাতের আঙুল দিয়ে অতি সাবধানে মিনুর নরম গাল স্পর্শ করল। মিনুর মাথার অবিন্যস্ত কেশ হাতের আঙুল দিয়ে বিন্যস্ত করে দিল। প্রবল ইচ্ছা হলো দু’হাতে মিনুকে জড়িয়ে ধরার। তখনই মনে পড়ল ওর ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাতের দৃশ্যটা। ও চাদর সরিয়ে ক্ষতস্থানটা দেখতে গেল। পাতা নাতা, শেকড় বাটা লাগানো ক্ষতস্থান থেকে তখনও অল্প রক্ত চুঁইয়ে পড়ছিল। গায়ের চাদরটা দিয়ে তা মুছিয়ে দিল। চোখ পড়ল মিনুর উন্মুক্ত স্তনের দিকে। স্পর্শ করার খুব ইচ্ছে হলো। ডান হাতের আঙুলগুলো স্তনের খুব কাছে নিয়ে গেল। কিন্তু পারল না স্পর্শ করতে। হাত সরিয়ে নিল। গায়ে চাদর ঢাকা দিয়ে দিল। মিনুর নাকের কাছে আঙুল দিয়ে দেখল নিশ্বাস ঠিক মতো পড়ছে কিনা। মিনুর গরম নিশ্বাস আঙুলে লাগায় মেঘের আঙুলগুলো কেঁপে উঠল।

নিঃশব্দে জঙ্গলে এসে প্রবেশ করল মাস্টারদা ও তার দলবল। সকলে যুদ্ধের পোশাকে সজ্জিত ও সশস্ত্র। সাঁতরে নদী পার হওয়ার কারণে পোশাক ভিজে। ওরা নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে কথা বলছিল।
বিজয় – এখানে তো দেখছি একটা আদিবাসীদের দল।
মাস্টারদা – রাজতন্ত্রের লোকেরা যখন জঙ্গলে ঢোকে, তখন আদিবাসীদের ছদ্মবেশ নেয়। সরকার থেকে খবর আছে ওরা জঙ্গলে ঢুকেছে। কান্ডুয়ার জঙ্গলে দু’জন ধরাও পড়েছে।
অলোক – আমার ভীষণ ভয় করছে মাস্টারদা। এতক্ষণে নদীর ঘাটে কী পাওয়া গেছে – – –
অলোকের কন্ঠস্বর কান্নায় জড়িয়ে গেল।
মাস্টারদা অলোকের পিঠে হাত রেখে বললো – শান্ত হ। আমি দলপতিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি।
জবা – আমরাও কি যাব?
মাস্টারদা – হ্যাঁ, সবাই চল।
মাস্টারদারা টর্চ জ্বেলে আদিবাসী দলটির দিকে এগিয়ে গেল। ওরা তখন খাওয়া দাওয়া করছিল, আর আজকের বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল।
বয়স্কা মহিলা – মেয়েটা কেমন আছে দেখে আসতে হবে।
দলপতি – ছেলেটি বড়ই ঠ্যাঁটা। এতবার জিজ্ঞেস করলাম, কিছুই বললো না।
মাস্টারদাদের ওরা দেখতে পেল। মাস্টারদাকে দেখে দলপতি চিনল।
দলপতি – ওদের গাঁয়ের মেয়ে বোধহয়।
সকলে বলাবলি করতে লাগলো — কী হবে এখন?
মাস্টারদা দলপতির কাছে এগিয়ে গিয়ে পরিচয়পত্রটা বের করে মিনুর ছবি দেখাল।
মাস্টারদা – এই মেয়েটাকে এখানে আজ কোথাও দেখেছ? বা তোমাদের দলের কেউ দেখেছে?
দলপতি ছবিটা দেখেই চমকে উঠল। অনেকেই এগিয়ে এসে ছবি দেখার চেষ্টা করল। দলপতি ও দলের সকলের প্রতিক্রিয়া দেখে মাস্টারদা কিছু বুঝতে পারল।
মাস্টারদা – বলো তাড়াতাড়ি। কোথায় দেখেছ, কখন দেখেছ?
দলপতি কিছু বলার আগেই কয়েকজন লোক একটু দূরে মেঘের ঘরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো — ওইখানে।
মাস্টারদা দেখল, আদিবাসী দলের থেকে একটু দূরে মাচার উপর একটা ঘর।
মাস্টারদা – ওখানে আছে এখন? ওটা কার ঘর?
দলপতি – হ্যাঁ, ওখানেই আছে। ওটা আমাদের দলের কারুর ঘর নয়। অন্য এক শিকারীর।
অলোক ও অন্যান্যরা দ্রুত ছুটে গেল। মাস্টারদাও গেল ওদের সঙ্গে। আদিবাসীরা ভীত ও কৌতুহলী দৃষ্টিতে দূর থেকে ওদিকে তাকিয়ে রইল।

মাস্টারদারা জঙ্গলে ঢোকার পরও মেঘ কিছু টের পায়নি। সে মিনুর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বসে। হঠাৎই মিনুর চোখের পাতা খুলে গেল। অনেকক্ষণ পর জ্ঞান ফেরায় ও কিছু বুঝতে পারল না। ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো – মা – – –
মেঘ চমকে উঠল। প্রথমে কী করবে বুঝতে পারল না। তারপর বললো — জল খাবে?
মিনু — জল।
মেঘ তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেল জলের কলসিটার কাছে। কিন্তু গিয়েই ভাবলো, ও তো জল খায় কলসি থেকে সোজাসুজি মুখে ঢেলে। এই অবস্থায় মেয়েটাকে কীভাবে জল খাওয়াবে?
মিনু – জল।
মেঘ কলসিটা কাছে এনে, কলসি থেকে নিজের হাতের আঁচলায় জল ভরে মিনুর মুখের কাছে ধরল।
মেঘ – মুখ খোলো।
মেঘের হাত থেকে দু এক ফোঁটা জল মিনুর ঠোঁটে পড়তেই ওর ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল। মেঘ আঁচলা করে আস্তে আস্তে ওর মুখে জল দিতে লাগলো। মিনু খেল।
মিনু আবছা অন্ধকারে মেঘের দিকে চেয়ে।
মিনু – কে?
মেঘ – কোনো ভয় নেই। আমি তোমাকে কিচ্ছু করব না।
মিনু ক্ষীণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো – আমি কোথায়?
মেঘ – আমার ঘরে। খিদে পেয়েছে? কিছু খাবে? মিনু তার ক্ষতস্থানের ব্যথা টের পেল। ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো কাতর ধ্বনি – আহ্ – – –
মেঘ – খুব কষ্ট হচ্ছে?
মিনুর কপালে কাঁপা কাঁপা হাত রাখল।
– সেরে যাবে। ঘুমিয়ে পড়ো।
মেঘ মিনুর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মিনু ক্লান্ত চোখে মেঘের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখ বন্ধ করল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে অলোক, বিজয়, দেবু, ও জবা একসঙ্গে মাচার উপর উঠে এলো। মাচা নড়বড় করে উঠল।
মাস্টারদা – একসাথে এতজন নয়। তোরা নেমে আয়। সাবধান, এ্যাটাক করে দিতে পারে।
ততক্ষণে অলোক আর বিজয়ের টর্চের আলো গিয়ে পড়েছে মেঘের ঘরের মধ্যে। মিনুর মুখের উপর অলোকের টর্চের আলো। মেঘ হতভম্বের মতো চুপচাপ ওদের দিকে তাকিয়ে মিনুর পাশে বসে। জবা ও দেবু মাচা ভাঙার ভয়ে নিচে লাফ দিয়েছে।
অলোক চিৎকার করে উঠলো – মিনু – – – –
মিনু চিৎকার, মাচা নড়ে ওঠা, টর্চের আলো ও ক্ষতস্থানের ব্যথায় দুর্বল শরীরে ভয়ার্ত হয়ে পুনরায় সংজ্ঞা হারালো। অলোক এগিয়ে গিয়ে মিনুর গায়ের চাদর সরিয়ে দিয়ে যা দেখলো, তাতে সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেললো। বিজয় দু’হাতে মেঘের কাঁধ দুটো পাকড়ে ধরে ওকে টেনে মাচা থেকে নামিয়ে আনলো। অলোক মিনুকে দেখে ধর্ষিতা মনে করল। গায়ে চাদর চাপা দিয়ে বুকের কাছে কান পেতে হৃদস্পন্দন শোনার চেষ্টা করল। এতো উত্তেজিত অবস্থায় কিছুই শুনতে পেল না। নাকের কাছে হাত নিয়ে নিশ্বাস পরীক্ষা করতে লাগলো কাঁদতে কাঁদতে।
বিজয় মেঘকে নামিয়ে এনেছে।
মাস্টারদা – মিনু কোথায়?
বিজয় – এ ধরে এনে মিনুর ইজ্জত নিয়েছে।
জবা দ্রুত উঠে গেল মাচার উপর মিনুর কাছে।
মাস্টারদা মেঘকে সামনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলো – বল তুই কে?
মেঘের মুখে কোনো উত্তর নেই। বিহ্বল দৃষ্টিতে সকলের দিকে চেয়ে আছে। মাস্টারদা সজোরে এক ধাক্কা দিয়ে মেঘকে ছুঁড়ে দিল। একটা গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মেঘের কপাল ফেটে রক্ত বেরিয়ে এলো। সে গাছের তলায় লুটিয়ে পড়ল। আদিবাসীরাও ততক্ষণে সেখানে এসে জড়ো হয়েছে। অলোক ও জবা মিনুকে নিয়ে মাচা থেকে নেমে এসেছে। অলোকের কোলে শুয়ে সংজ্ঞাহীন মিনু। মাস্টারদা এগিয়ে গিয়ে মেঘকে টেনে মাটি থেকে তুলে আবার দাঁড় করিয়ে সপাটে গালে একটা চড় কষিয়ে দিল। সেই চড় খেয়ে মেঘ আবারও মাটিতে বসে পড়ল।
মাস্টারদা – এই তোরা ওর ঘর সার্চ কর। দেখ্ কী কী পাওয়া যায়। বিজয় ও তাপস ঘর সার্চ করতে মাচায় উঠে গেল। মাস্টারদা দলপতির কাছে এগিয়ে গেল – এতো বড় একটা অন্যায় হলো, আর তোমরা তার কিছু বিচার করোনি?
বয়স্কা মহিলাটি এগিয়ে এলো মাস্টারদার দিকে।
– ও যখন মেয়েটাকে নিয়ে এলো, তখন মেয়েটার সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। অনেক রকম ওষুধ পালা দিয়ে আমরা আর ওই ছেলেটা ওকে বাঁচিয়েছি। ওই ছেলেটার খুব মায়া পড়ে গেছে মেয়েটার উপর। ও সারাক্ষণ মেয়েটার পাশে বসে সেবা করে গেছে। আমরা যখন জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে, কোনো উত্তর না দিয়ে মেয়েটাকে নিজের ঘরে নিয়ে চলে গেল। দেখে তো মনে হলো মেয়েটার বুকে তীর লেগেছিল। ও ইচ্ছা করে নিশ্চয় মারেনি। তাহলে এতো দয়া মায়া করে বাঁচানোর চেষ্টা করত না। জঙ্গলে ফেলে তো পালিয়েও যেতে পারত। তাহলে তো কেউ জানতই না। হতেও তো পারে, যে আর কেউ মেয়েটাকে মেরে দিয়ে পালিয়েছে। ও সারাক্ষণই এতো ঘাবড়ে আছে যে কিছু বলতেই পারছে না।

বিজয় মেঘের ঘর থেকে ওর ঝুলিটা নিয়ে এসেছে। তার মধ্যে থেকে সেই মেলা থেকে কেনা বাক্সটা বের করে সবাই পরীক্ষা করতে লাগলো। হঠাৎই মেঘ এক লাফে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিজয়ের কাছ থেকে বাক্সটা কেড়ে নিল। সাথে সাথে মাস্টারদা লাফিয়ে পড়ল মেঘের উপর। দেবু, শ্যামল, তাপস, সবাই মিলে মেঘকে ধরল। মেঘও সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ওদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করল। ফলে ওদের হাতে আরো কিছু মার খেলো। তাই দেখে আদিবাসী মহিলা কয়েকজন এগিয়ে এলো।
বয়স্কা মহিলা – কী হয়েছে? কী আছে ওর বাক্সে? ওকে তোমরা অত মারছো কেন? ছেলেটা কোনো দোষ করেছে কিনা না জেনেই তোমরা ওকে মারছো?
মাস্টারদা মেঘের বাক্স খুলে তা থেকে সব জিনিস বের করে পরীক্ষা করতে লাগলো। মেঘ সেইদিকে হিংস্র দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। মাস্টারদা অবাক হয়ে দেখল, বাক্সে রঙিন কাঁচের চুড়ি, ফিতে, টিপ, এইসব মেয়েদের সাজের জিনিস। মাস্টারদার চোখ পড়ল মেঘের দিকে। মেঘের দু’চোখ তখন জলে ভরে উঠেছে। জল ভরা হিংস্র দৃষ্টিতে সে মাস্টারদার দিকে চেয়ে। মাস্টারদা একটুক্ষণ বিস্মিত চোখে মেঘকে দেখতে থাকল। দৃষ্টি পড়ল মেঘের কাটা কপাল থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্তের দিকে। মাস্টারদা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল মেঘের দিকে। মেঘকে তখন সবাই দড়ি দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে।
মাস্টারদা – কী হয়েছিল আমায় বল। বাক্সটা তুলে ধরে মেঘকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল – জিনিসগুলো কার? মাস্টারদার কন্ঠস্বর অনেক শান্ত ও নরম।
মেঘ গম্ভীর কন্ঠে উত্তর দিল – আমার। আমি কিনেছি।
মাস্টারদা – কার জন্য?
মেঘ মিনুর দিকে তাকিয়ে বললো – ওর জন্য।
সকলে বিস্ময়ে হতবাক! বিশেষ করে অলোক।
মাস্টারদা – ওর এমন হলো কী করে?
মেঘ – আমি বুঝতে না পেরে হরিণ মনে করে তীর মেরেছিলাম। ও ঝোপের মধ্যে ছিল। ওকে দেখতে পাইনি।
মাস্টারদা – তুমি ওকে চেনো?
মেঘ – হ্যাঁ।
এবার মাস্টারদাও খুব অবাক হলো।
মাস্টারদা – ওর সঙ্গে তোমার দেখা হলো কোথায়?
মেঘ – এই জঙ্গল ছাড়িয়ে নদীর ধারে।
মাস্টারদা – কবে?
মেঘ – আজকে।
মাস্টারদা অবাক হয়ে — আজকেই প্রথম দেখলে ওকে?
মেঘ – হ্যাঁ।
সবাই অবাক হয়ে কথাগুলো শুনছিল।
মাস্টারদা – আজকেই এইসব জিনিসগুলো কিনেছ ওর জন্য?
মেঘ – না, অনেক দিন আগে।
মাস্টারদা আরো অবাক হলো মনে মনে। দেখা হলো আজ – – – আর কিনেছে অনেক দিন আগে! মাস্টারদা বুদ্ধিমান মানুষ। কিছু বুঝল।
(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *