** ট্রামের গল্প —পর্ব –১** নীলবৃষ্টি

** ট্রামের গল্প —পর্ব –১**

নীলবৃষ্টি

একদিন ট্রামে করে ধর্মতলা যাবার পথে আলাপ হয় সৌমিতার সাথে , খুব সাধারণ ভাবেই আর পাঁচজনের যেমন হয় আর কি , সময় টা বেশ আগেকার এখনকার নয় তখন অফিস করি ওই ট্রামেই ফিরিও তাই ,সেদিন ভাড়া দেবার খুচরো ছিলোনা আমার কাছে , ট্রামের কণ্ডাকটর নতুন ছোকরা বেশ মেজাজি ! উল্টোপাল্টা বলছিলো যা সাধারণত ট্রামে হতোনা খুব একটা , আমিও দু একটা কথা শুনিয়ে আরো কিছু বলার জন্য যখন রেডি হচ্ছি ওই সৌমিতা ই আমার টিকিট টা কেটে দেয় ! যারফলে অযথা বাক্যালাপ বন্ধ করে সৌমিতার দিকে এগিয়ে যাই , খুব সাধারণ গৃহবধু একজন অন্তত দেখে তাই মনে হচ্ছিলো , চাকরি করেন উনিও বাড়ি ফিরছেন আমার মতোই , আমি বললাম ,” অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ভাড়া টা ধার হিসেবে নিলাম শোধ করে দেবো “উনি হাসলেন অল্প তারপর বললেন ,” হম ঠিক আছে দেবেন রোজই ফিরি এই সময়েই অফিস থেকে” তারপর আর রোজকার যাঁতাকলে ভুলেই গেছিলাম ওই ঘটনাটা , হঠাৎ সেদিন কলেজস্রীটে ছেলের একটা বই খুঁজতে গিয়ে দেখা হয়ে গেলো ভদ্রমহিলার সাথে!! আমিই সামনে গিয়ে বললাম ,” চিনতে পারছেন ?” ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে ! আমি হেসে বললাম ,” আরে ধার দিয়ে ভুলে গেলে হবে?” ভদ্রমহিলা এবার মনে হয় চিনতে পারলেন অল্প হেসে বললেন ,” ওহ ! আপনি ! ধার শোধ না করে ছাড়বেন না দেখছি !” আমি ভাড়াটা গুনে গুনে ওনার হাতে দিয়ে বললাম ,” ধার রাখতে নেই শোনেননি ?” উনি অল্প হাসলেন, আমি বললাম ,” কফি ?” উনি বললেন ,” হতে পারে তবে শুধুই কফি যদি হয় ” কিছুক্ষণ বাদে আমি আর উনি কফি হাউজের দোতলায় কফি আর কিছু স্ন্যাক্সস নিয়ে মুখোমুখি বসে , উনি সৌমিতা হালদার , স্বামী নরেশ হালদার গত হয়েছেন চার বছর আগে , সৌমিতা চাকরি করে মানে নরেশের চাকরিটাই পেয়েছে , অসুস্থ শাশুড়ি মা , আর এক পঙ্গু মেয়ে কে নিয়ে সংসার! মেয়ের ছোটোবেলায় পলিও হয়ে পা দুটো নষ্ট হয়ে যায় ! নরেশ ও সৌমিতা অনেক চেষ্টা করেছে সাধ্য মতো কিন্তু পারেনি ! নরেশ মেয়ে অন্ত প্রাণ ছিলো , মেয়ের জন্য আস্তে আস্তে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলো ! তারপর হঠাৎ ই এক ধাক্কায় চলে গেলো!! এখন শাশুড়ী মা সৌমিতাকেই দায়ী করে এসব কিছুর জন্য !! বাড়ি ফিরলেই কথা শুনতে হয় , কিন্তু কি আর করবে !মেয়েও বাবা চলে যাবার পর গুম মেরে গেছে ! মনে হয় সেও সৌমিতাকেই দায়ী ভাবে ! কিন্তু সৌমিতা কে তো সব চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে ! তাইই করছে ,আজ মেয়ের একটা হুইল চেয়ার কিনতে এসেছে সৌমিতা আগের টা একদম খারাপ হয়ে গেছে !! মেয়ে এইচ এস দেবে এবার… তাইই … এসব বলে কফিতে চুমুক দিলো সৌমিতা , আমি দিপেন সমাদ্দার , বয়স চল্লিশের কাছে , বাড়িতে বৌ , মা ,বাবা, দুই ছেলে মেয়ে , ও এক অবিবাহিত বোন আছে, দাদা ও আছে সে বিয়ে করে আলাদা থাকে , তবে বাবা ,মা তার কাছে ও আমার কাছে মাস পাল্টে পাল্টে থাকে, আমার বোন ও আমার বৌ এ চিরকালীন সমষ্যা যে সমষ্যা আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতির ও মেটাবার ক্ষমতা নেই ! বোন কে দেখতে খুব একটা ভালো নয় , লেখাপড়া ওই মাধ্যমিক অবধি , তবে ঘরের কাজ , রান্না সবেতে পটু সে , টিউশানিও করে দু চারটে , বোনের একটা সমন্ধ এর ব্যাপারে যাবো কাল উত্তরপাড়াতে ঘর টা ভালো , পাত্র ও … সৌমিতা বললো ,” আমাদের দেশে এই এক সমষ্যা মেয়েদের নিয়ে বড় হলেই ধরে বিয়ে দিয়ে দাও ! আশ্চর্য ! কেন তাদের কি বাঁচার অধিকার নেই!! আমাকেও নরেশের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছিলো প্রায় জোর করেই , অথচ আমি আরো লেখাপড়া করতে চেয়েছিলাম !” আমি বললাম ,” এখনো করতে পারেন কিন্তু প্রাইভেটে তো এখন অনেকে কিছু করছে!” এরপর সৌমিতার সাথে ট্রামে মাঝে মধ্যেই দেখা হয় কথা হয় , এইভাবেই চলতে থাকে… এরপর ধীরে ধীরে পারিবারিক বন্ধু হয়ে উঠি আমরা একে ওপরের , সৌমিতার বাড়ি তে আমি বেশীবার না গেলেও আমার বাড়িতে সৌমিতা আসে , এমন কি আমার অবর্তমানে ও এসে গল্প করে যায় , আমার বোনের বিয়েতেও সে আমন্ত্রিত ছিলো , আমার স্ত্রীকে আমি অনেক ব্যাকডেটেড ভাবতাম কিন্তু সৌমিতাকে আপন করে সে বুঝিয়ে দিয়েছে সে এক সুন্দর মনের অধিকারীনি , সৌমিতার মেয়ে খুব ভালো রেজাল্ট করে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে , এর মধ্যে সৌমিতার শাশুড়ী মা বেশ ভুগে মারা যান ! এখন সৌমিতার বাড়িতে আমরা যাই প্রায়ই বিশেষত আমার স্ত্রী রুমি ও যায় খুবই , অদ্ভুত এক পারিবারিক বন্ধন গড়ে উঠেছে এখন আমাদের , এখন আমার থেকেও সৌমিতা আর রুমি দুজনে ভীষণ বন্ধু ! ওদের প্রায়ই দেখা যায় এদিক ওদিক , ট্রামে , বাসে অনেক জায়গায় ! সত্যি বলতে আমি বেশ এনজয় করি ব্যাপারটা !! এখন তো শুনি আমার বোনও নাকি যোগ দেয় ওদের সাথে মাঝে মাঝে আশ্চর্য লাগে খুব !!যতদিন বাড়িতে ছিলো রাম রাবণ সম্পর্কে পরিচিত ছিলো এখন নাকি তার চেয়ে ভালো ননদ আর তার চেয়ে ভালো বৌদি আর কেউ হয়না!! তবে এসবে মাঝে একজন আছে সে হলো সৌমিতা আশ্চর্য পরিণত এক অদ্ভুত সাধারণ গৃহবধু যে প্রায় সব ঝড়কেই অনায়সে পেরিয়ে যেতে পারে ! আমি জানি রুমি শিখছে তার কাছে অনেক কিছু সে আভাস পাই আমি সংসারে ! এরপর নাহ !! এরপর টা ছেড়ে দিই এরপরের হাতেই কিন্তু সেখানেও আমার ছেলে ও সৌমিতার মেয়ে দুজনে এক পারিবারিক বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় , দুজনেই এই কলকাতা তে থেকেই রিসার্চ করছে কলেজে পড়ায় দুজনেই , আমরা এখন অবসরপ্রাপ্ত বাবা মা ! সৌমিতা আমি আর রুমি ঘুরে বেড়াই অনেক জায়গায় , আমার মেয়েরো বিয়ে হয়েছে রিসেন্টলি !! এই সময় এই ট্রাম উঠে যাবার ঘটনাটা বড় মনে লাগে আমাদের !! ওই ট্রামেই তো আমাদের গল্প টা শুরু হয়েছিলো !! অসমাপ্ত ও হতে পারতো কিন্তু ঈশ্বরের কৃপায় সে গল্প আজ পূর্ণতা পেয়েছে , এরম হাজারো গল্প আছে ওই ট্রাম কে নিয়ে !! কোনোটা আধভাঙা , কোনোটা হবার আগেই শেষ , কোনোটা অন্যরকম !! সেই ট্রাম আজ বিলুপ্ত আমার শহর থেকে !! কেন বড়ই কি অপ্রাসঙ্গিক ছিলো সে এ শহরে !! উত্তর যতই না আসুক প্রশ্ন কিন্তু থাকবেই !! আর এ গল্প ও চলবে…

#নীলবৃষ্টি

স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *