জীবনবিজ্ঞান সম্পর্কিত কিছু কথা- পর্ব ৪ ✒️✒️ ডরোথী দাশ বিশ্বাস

জীবনবিজ্ঞান সম্পর্কিত কিছু কথা- পর্ব ৪

ডরোথী দাশ বিশ্বাস

শিক্ষক হবেন গুণের আধার। জীবনবিজ্ঞান শিক্ষক হলেন জীবনের বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা প্রদানকারী দক্ষ ও উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব যা সার্থক জীবনবিজ্ঞান শিক্ষার একটা প্রধান উপকরণও বটে। সুশিক্ষক শিক্ষার্থীর পূর্ণতম বিকাশে সাহায্য করেন। জীবনবিজ্ঞান শিক্ষাকে ফলপ্রদ করার জন্য উপযুক্ত শিক্ষণপদ্ধতির সঙ্গে উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক প্রয়োজন।

১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দে Dr. F.L. Clapp শিক্ষকের দশটি সাধারণ গুণের কথা উল্লেখ করেন, সেগুলি হল: ১) আচরণগত দক্ষতা (Address), ২) ব্যক্তিগত চেহারা (Personal appearance), ৩) আশাবাদিতা ( Optimism), ৪) গাম্ভীর্য (Reserveness), ৫) উৎসাহ (Enthusiasm), ৬) মানসিক সততা (Fairness of mind), ৭) আন্তরিকতা (Sincerity), ৮) সহানুভূতি (Sympathy), ৯) জীবনীশক্তি (Vitality), ১০) বিদ্যাবত্তা (Scholarship).

অধ্যাপক Bagley এবং Keith শিক্ষকের অতিরিক্ত তিনটি গুণের উল্লেখ করেছেন, যথা: ১) কৌশল (Tact), ২) সুন্দর বাচনভঙ্গী (Good voice), ৩) শিক্ষণের কৌশল (Method of teaching).

অধ্যাপক Bossing শিক্ষকের আরও দুটি গুণের উল্লেখ করেছেন। যথা: ১) রহস্যপ্রিয়তা (Sense of humour), ২) শিক্ষার্থীদের প্রতি ভালোবাসা (Friendliness towards pupils).

অর্থাৎ, একজন আদর্শবান বিজ্ঞানশিক্ষক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞ হবেন, শিক্ষাপরিকল্পনায়, নির্দেশনায় সচেষ্ট হবেন, শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব হবে প্রীতিময়, সৌহার্দ্যভিত্তিক ও আকর্ষণীয়। তিনি বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে চলবেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা: তাঁকে অবশ্যই স্নাতক, সাম্মানিক স্নাতক, স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী হতে হবে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারী নির্দেশনা অনুসরণ করে উপযুক্ত পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। শিক্ষকের এই সাধারণ গুণগুলি জীবনবিজ্ঞানের শিক্ষকের মধ্যে থাকবেই, এছাড়া যেগুলি বিশেষ গুণ থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয় সেগুলি পর্যায়ক্রমে আলোচনা করবো।

যেমন: জীবনবিজ্ঞান শিক্ষকের আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। গবেষণাগারে হাতে কলমে দক্ষতা সহকারে পরীক্ষা নিরীক্ষার যথাযোগ্য জ্ঞান থাকতে হবে। জীবনবিজ্ঞান শিক্ষকের পরীক্ষাগার পরিচালনা করা, প্রয়োজনে পরীক্ষাগার নতুনভাবে তৈরি করা, যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ করা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন।

উন্নত বিজ্ঞান শিক্ষণপদ্ধতি ও বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।

কিছুসময় পর পর জীবনবিজ্ঞানের পাঠ্যক্রমে পাঠ্যসূচির যে পরিবর্তন বা পরিমার্জন হচ্ছে সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা শিক্ষকের থাকতে হবে। প্রতিনিয়ত নিজেকে উন্নীত করতে হবে ঐ পরিবর্তিত পাঠক্রমের সঙ্গে। বিষয়ের সাথে ক্রমধারায় পরিচিতি বজায় রাখতে নিয়মিত অধ্যয়ণ অবশ্যই প্রয়োজন এবং সাথে সাথে সহজ সাবলীল ও সুষ্ঠু পাঠদানের জন্য নিজেকে সর্বদা প্রস্তুত রাখতে হবে।

একজন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদের (নামটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না) মতে— শিক্ষার্থীদের একঘন্টা পাঠদানের জন্য শিক্ষককে তিনঘন্টা পাঠগ্রহণ করা প্রয়োজন।

শিক্ষক শিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিক্ষকদের উপযুক্ত শিক্ষণের প্রয়োজন। সেখানে কোনোক্রমে পরীক্ষা উত্তীর্ণ শংসাপত্র পেলেই হবে না। যেহেতু আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনের একক, শিক্ষকের যে মহান দায়িত্ব— তাই শিক্ষককে মনে রাখতে হবে— নিজেকে ফাঁকি দেওয়া মানে ভবিষ্যতে ছাত্রছাত্রীদের ফাঁকে ফেলে দেওয়া- দেশ কাল সমাজের ক্ষেত্রে এর ফল কখনো ভালো হয় না—

জীবনবিজ্ঞান শিক্ষককে শিক্ষাদানে বা নতুনভাবে পড়াশোনা করানোর ব্যাপারে একটুও উদাসীন হলে চলবে না। শিক্ষককে সর্বদা মনে রাখতে হবে- শিক্ষার্থীরা ছোটো, ওদের জীবনবিকাশের দায়িত্ব শিক্ষকের ওপর অর্পিত। স্নেহ-প্রীতি-ভালোবাসার মাধ্যমে শিশুহৃদয় জয় করাই তাঁর কাম্য হওয়া বাঞ্ছনীয়।

গতানুগতিক বক্তৃতা পদ্ধতি জীবনবিজ্ঞান শিক্ষণ পদ্ধতিতে একেবারেই অচল। জীবনবিজ্ঞান অবশ্যই প্রদর্শন পদ্ধতিতে বা প্রয়োজনে হিউরিস্টিক মেথড, প্রকল্প পদ্ধতি ও পরীক্ষাগার পদ্ধতি-তে শিক্ষাদান করা উচিত। প্রসঙ্গক্রমে আবারও মনে রাখতে পুনরাবৃত্তি করছি যে- এইসকল উন্নত পদ্ধতিতে জীবনবিজ্ঞান শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষককে বিষয়বস্তু সম্পর্কে যথেষ্ট পড়াশুনো করতে হবে। নয়তো হিউরিস্টিক বা প্রকল্প পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানে তিনি সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হবেন। জানা কথা— শিক্ষকদের বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক ছাড়া উচ্চপর্যায়ের পুস্তক পড়তে হবে।

জীবনবিজ্ঞান বিষয়টিকে শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরার জন্য শিক্ষককে সবসময় ভাবতে হবে, বিষয় উপস্থাপনায় নতুনত্ব আনা যায় কিভাবে- ভাবতে হবে আর নিজ উদ্যোগেই তা শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপিত করতে হবে অর্থাৎ কার্যকর করতে হবে। যেমন: বিতর্কসভা, বুলেটিন, বিজ্ঞানসংক্রান্ত কবিতা প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন, ম্যাগাজিন প্রকাশ, বিজ্ঞান সংঘ, বিজ্ঞান মেলায় অংশগ্রহণ- ইত্যাদি সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলী সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের অবহিত ও উৎসাহিত করা। এর জন্য সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক ম্যাগাজিন, পত্রিকা, বিজ্ঞানভিত্তিক প্রবন্ধ, রচনা ও পুস্তকের সঙ্গে শিক্ষকের নিবিড় সংযোগ থাকা দরকার। বিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন বিজ্ঞানভিত্তিক প্রোগ্রামে যেমন: লাইফ সায়েন্স ওরিয়েন্টেশন, বিজ্ঞান শিক্ষক সম্মেলন, ডেঙ্গু সচেতনতা শিবির, প্রকৃতিপর্যবেক্ষণ শিবির, বিজ্ঞান শিক্ষক সমিতি ও স্বল্পকালীন জীবনবিজ্ঞান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সানন্দে ও আন্তরিকতার সাথে অংশগ্রহণে উৎসাহী হতে হবে। বিজ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন প্রদর্শনীতে শিক্ষার্থীদের সবসময় যাওয়া সম্ভব না হলেও জীবনবিজ্ঞান শিক্ষকের যাওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন বিদ্যালয়ের জীবনবিজ্ঞান শিক্ষক একত্রিত হলে নিজেরা পাঠ্যক্রম সম্পর্কে বা শিক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করলে পাঠদানের ক্ষেত্রে স্বীয় যোগ্যতার মান উন্নয়নে তা সহায়ক হতেই হবে।

এটা সহজেই অনুমেয় যে জীবনবিজ্ঞান শিক্ষককে স্বতঃপ্রনোদিতভাবে প্রতিনিয়ত বিজ্ঞান সাধনা ও অভ্যাসের দ্বারা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীসম্পন্ন হতে হবে, চোখ কান খোলা রেখে আন্তরিকভাবে যথেষ্ট পরিশ্রমী ও উৎসাহিত হতেই হবে, নইলে বলাই বাহুল্য, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় শুধু নম্বর তোলা নয়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে তোলার জন্য সঠিক প্রশিক্ষণ দিতে তিনি ব্যর্থ হবেন।

[শব্দ সংখ্যা: ৬৭৮]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *