# সীমান্ত # পর্ব – ১৪ কলমে – অরণ্যানী

# সীমান্ত # পর্ব – ১৪
কলমে – অরণ্যানী

সন্তর্পণে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে বনপথ ধরে মেঘ সন্ধ্যার আগে এগিয়ে চলল। নানান গাছপালার দিকে তাকিয়ে রাস্তাটা মনে রাখতে লাগলো। গাছের গায়ে ছুঁড়ি দিয়ে নানা চিহ্নও করে গেল। সূর্যের আলো ম্লান হয়ে এলো ধীরে ধীরে। কান খাড়া করে মেঘ শুনতে পেল নদীর কলধ্বনি। এগোতে লাগল ওই শব্দকে অনুসরণ করেই। নদীর কাছে যখন পৌঁছল, তখন সবে অন্ধকার নামছে। নদীটার দিকে তাকিয়ে দেখল বেশ চওড়া। চোখ পড়ল নদীর ওপারে। দুটি যুবক যুবতী আলিঙ্গনবদ্ধ অবস্থায় বসে(এরাই কবিতা ও বিজয়) । মুগ্ধ দৃষ্টিতে মেঘ সেদিকে চেয়ে রইল। আলিঙ্গনবদ্ধ মানুষ দু’জনকে যদিও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। আর একটু অন্ধকার নামল। মেঘ দেখল একটি হরিণ নদীতে জল খাচ্ছে। নিমিষে মেঘের ধনুক থেকে তীর গিয়ে লাগলো হরিণটার পিঠে। হরিণটা হুমড়ি খেয়ে পড়ল নদীর জলে। মেঘ এগিয়ে গিয়ে হরিণটাকে নদীর জল থেকে তুলে নিয়ে চলে গেল জঙ্গলে তার নতুন বাসস্থানের দিকে।

ততক্ষণে মেঘের প্রতিবেশী দলটা শিকার ও ফলমূল নিয়ে ফিরেছে। আগুন জ্বেলে অনেকে মাংস ঝলসাচ্ছে। মেঘকে হরিণ নিয়ে আসতে দেখে অনেকেই উৎসাহিত হলো। সেই লোকটি, অর্থাৎ এদের দলপতি এগিয়ে গেল মেঘের দিকে।
মেঘ – আমি তো একা মানুষ। কিছুটা মাংস খাব। বাকিটা তোমাদের দিয়ে দেবো।
দলপতি – ঠিক আছে। যেদিন তুমি শিকার পাবে না, সেদিন আমরাও তোমাকে মাংস দেবো। মেঘ ও দলপতির মধ্যে এরকম একটা চুক্তি হলো। তারপর মাংস ঝলসানো ও খাওয়া দাওয়ার পর যে যার ঘরে শুতে চলে গেল। মেঘও এসে শুলো তার নতুন আশ্রয়ে। অনেক দিন পর একটা নতুন আশ্রয়স্থল পেয়ে চোখের পাতা ঘুমে জড়িয়ে এলো। ঘুমের মধ্যে দেখল আলিঙ্গনবদ্ধ ও চুম্বন রত দুই নর নারীকে। ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকারে ঘরের কোণে রাখা ছোট কলসি থেকে জল খেল। ঘরের ছাউনির ফাঁক দিয়ে অস্তাগত শুক্লপক্ষের আধফালি চাঁদের হালকা জ্যোৎস্না এসে পড়েছে জঙ্গলের উপর। মেঘ একবার আকাশের চাঁদের দিকে চাইল। তারপর আশপাশে। চুপচাপ একটুক্ষণ এভাবেই তাকিয়ে বসে রইল। হয়তো কিছু ভাবছিল। ধীরে ধীরে চোখ তন্দ্রায় ঢুলে এলো। উঠে চলে গেল ঘরের ভেতর।

মিনু ও মেঘের প্রথম সাক্ষাৎ :-
মিনু হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছিল ডাক পাখির বাসা দেখবার আশায়। একটুখানি এগোতেই চোখে পড়ল এক যুবক ঝোপের ভেতর নদীর ধারে চুপচাপ বসে আছে। সুন্দর স্বাস্থ্য, মুখে চোখে অদ্ভুত লাবণ্য, খালি গা, গায়ের রঙ বেশ কালো। শান্ত ও অন্যমনস্ক চোখে চেয়ে আছে ভরা নদীর জলের দিকে। মিনুর চোখ আটকে গেল যুবকটির দিকে। যুবকটির মুখ, চোখ, দুই বাহু ও সমস্ত শরীরের দিকে মিনু বিস্মিত চোখে চেয়ে থাকতে থাকতে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। এই প্রথম কোনো পুরুষের শরীরের দিকে এভাবে চোখ পড়ল মিনুর। অনেকক্ষণ ধরে মিনু দেখতে লাগল যুবকটিকে। যুবকটি মিনুকে দেখতেই পেল না। একটু পর মিনুর খেয়াল হলো যে ও কোনো পুরুষ মানুষকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। হঠাৎই ওর খুব লজ্জা বোধ হলো। লজ্জায় মুখ লাল হয়ে উঠল। অর্ধ সিক্ত বসন শরীরের সঙ্গে সেঁটে আছে। নিজের শরীরের দিকেও মিনুর চোখ পড়ল। যুবকটি ওকে দেখার আগেই ও হামাগুড়ি দিয়ে দ্রুত ওখান থেকে সরে আসার চেষ্টা করল। তাতে ঝোপের মধ্যে একটা খসখস শব্দ হলো। সেই শব্দে ডাক পাখিরা ছানা সহ ঝোপের আড়ালে কোথায় সরে গেল। যুবকটি চোখ ফেরালো মিনু ঝোপের যে দিক দিয়ে প্রস্থান করছিল সেইদিকে। পালাতে গিয়েও মিনু পালাতে পারল না। শেষ বারের মতো একবার যুবকটিকে দেখার ইচ্ছা ওর মনে জাগল। তাই মিনু থামল। মুখ ফেরালো যুবকটির দিকে। ওর মনে হলো যুবকটি বোধহয় ওকে দেখতে পেয়ে গেছে। লজ্জায় বিহ্বল হয়ে একদৃষ্টে মন্ত্র মুগ্ধের মতো ও যুবকটির দিকেই চেয়ে রইল।
ওদিকে মেঘ ঝোপের ভেতর খসখস শব্দ শুনে তীর-ধনুক নিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকাল। প্রথমে কিছুই দেখতে পেল না। তারপর দেখল দুটি কালো চোখ। আর মুহূর্ত অপেক্ষা না করে মেঘ তীর ছুঁড়ল। মুহূর্তে মিনু আর্তনাদ করে ঝোপের মধ্যে লুটিয়ে পড়ল। তীর গিয়ে লাগলো ওর বুকের মাঝখানে। সেখান থেকে প্রচুর রক্তপাত হতে লাগলো। ঝোপের ঘাস রক্তে লাল হয়ে গেল। মেঘ দৌড়ে এলো মিনুর কাছে। মিনু ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে। মেঘ মিনুর বুক থেকে তীর খুলে নিল। তাতে আরো রক্তপাত হতে লাগলো। মেঘ নিজের বস্ত্র থেকে কিছুটা অংশ ছিঁড়ে নিয়ে চেপে ধরল মিনুর বুকে। তারপর ওভাবে বস্ত্রখন্ড বুকে চেপে ধরেই মিনুকে কোলে নিয়ে চলে গেল জঙ্গলের মধ্যে।

কবিতার বাড়ি :-
বিকেলের রোদ পড়ে এসেছে। অস্ত্রশিক্ষা নিয়ে ফিরে এসে কবিতা ঘরের কাজ সারছে। উঠোনের এক কোণে বসে খড় ও কলাগাছ কুঁচিয়ে গরুর জন্য জাব বানাচ্ছে। কবিতার মা বালতি ভরে গোবর নিয়ে ঘরের দেওয়ালে ঘুঁটে দিচ্ছে। কবিতার বাবা মাঠ থেকে গরু নিয়ে গোয়ালে ঢোকাচ্ছে। কবিতার ভাই বোনদের দেখা যাচ্ছে না। এমন সময় ঝিনুক এলো কবিতাদের বাড়ি। কবিতা খড় কাটতে কাটতে ঝিনুকের দিকে তাকাল। কবিতার মা-ও সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে।
ঝিনুক – কবিতা, মিনু আসেনি তোদের বাড়ি?
কবিতা – আমি এই তো সবে বাড়ি এসে কাজ করছি। কই, ও তো আসেনি। ও তো অস্ত্রশিক্ষা নিতেও যায়নি।
কবিতার মা – হ্যাঁ রে ঝিনুক, বিয়ে তো এসে গেল।বিয়ের কেনাকাটা কিছু হয়েছে?
ঝিনুক – না, দাদা যুদ্ধে যাবে। তাই নিয়ে বাড়িতে সবাই চিন্তা করছে। এরমধ্যে আর বিয়ে।
কবিতার মা – কিন্তু বিয়েটা তো হবে?
ঝিনুক – হ্যাঁ, তা হবে। কিন্তু মিনুর যে কী হবে – – – ও তো অস্ত্রশিক্ষা নিতেও চাইছে না।
কবিতার মা – আমাদের বাবলুটাও তো আজ যায়নি। ওদিকে সীমানায় যুদ্ধ হচ্ছে। যে কোনো সময় ওদেশের সেনারা ঢুকে পড়তে পারে জঙ্গল দিয়ে। পোটলা পুটলি বেঁধে রাখতে হবে। যে কোনো দিন পালাতে হতে পারে।
ঝিনুক – কী হবে কে জানে। ওদিকে যদি যুদ্ধ লাগে দাদা প্রথম বার যাবে যুদ্ধে। তার আগে বিয়ে হয়ে গাঁ ছেড়ে যদি চলে যাই, ফিরে এসে কী দেখব তা কে জানে। ঝিনুকের চোখ ছলছল করে উঠল। কবিতার মা কথা বলতে বলতেই ঘুঁটে দিয়ে যাচ্ছিল। কবিতা কাজ থামিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে কিছু ভাবছিল।
ঝিনুক – তাহলে মিনু কোথায় গেল? দুপুরে নাইতে গিয়েছিল নদীতে। বিকেল তো পড়ে গেল। সেই বেলায় ভাত খেয়ে বেরিয়েছে। দুপুরে তো এসে খায়ওনি।
বিকেল পড়ে আসছে দেখে কবিতা আবার তাড়াতাড়ি হাত চালাতে থাকল।
ঝিনুক – আমি তবে আসি গো কাকি।
কবিতার মা – হ্যাঁ, দ্যাখ, নদীর ঘাটে আশেপাশে মাছ টাছ ধরছে কিনা। সকালে তো বড় একটা কাতলা মাছ ধরে এনেছিল ও আর বাবলু।
ঝিনুক – হ্যাঁ, যাই।
ঝিনুক চলে গেল।

মিনুকে খোঁজাখুজি :-
সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে গাঁয়ে। হালকা জ্যোৎস্নাও উঠেছে। মিনুদের বাড়ির উঠোনে অনেক লোকের ভিড়। মিনুর বাড়ির লোকেরা তো আছেই, সেছাড়া মাস্টারদা, বিজয়, শ্যামল, দেবু, তাপস, জবা, পতু, পদ্মা, কবিতা, শ্যামলী, কবিতাদের বাড়ির লোকজন ও অনেক নারী পুরুষ।
মাস্টারদা – নদীর ঘাটগুলো, আশপাশের ঝোপ জঙ্গল, গাঁয়ের সকলের বাড়ি, সবই তো খোঁজা হলো। বাড়িতে ঝগড়া করে তো কোথাও চলে যায়নি?
বিজয় – ওদেশের সেনারা তো ধরে নিয়ে যায়নি? মিনুর মা ও দিদি চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল।
মাস্টারদা – সেনারা এদেশে এসে লুকিয়ে থাকবে এখন। শুধু শুধু ওইটুকু ধরে কী করবে?
বিজয় – ওইটুকু আর কই? মেয়ে তো, না। ওরা তো খারাপ চরিত্রের হয়।
সবার চোখে মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল।
অলোক – যেটা বলছিল, রাগ করে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল?
মিনুর মা আর দিদি তখন কাঁদছিল। বাবা হতাশ ভাবে দাওয়ায় বসে।
ঝিনুক – না, নাইতে গিয়েছিল নদীতে।
মাস্টারদা – সেকী! নাইতে গিয়ে ফেরেনি, সে তো আগে বলবি। বটতলার ঘাট, নদীতে আবার খুঁজতে হবে। দরকারে জাল ফেলতে হবে।
এক মহিলা – সে কী গো? ভরা নদী এখন। সাঁতার জানে তো।
আর একজন বললো – তাতে কী? একলা গিয়েছিল? কতরকম কী থাকে নদীতে।
কবিতার মা – ওরা নদীতে মাছ ধরছিল। মাছ তো সব সময় ভালো হয় না। অত বড় মেয়ে। এলো চুলে, একলা ভর দুপুরে নদীর ঘাটে গেলে – – – এই বাবলু, তুই ছিলি ওর সাথে?
বাবলু – মাছ ধরার পর আর সাথে যাইনি।
কবিতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে কাঁদছিল।
পতু – সমত্ত মেয়ে, দেখতে সুন্দর, দুপুরবেলা একলা নদীতে নাইতে গিয়েছিল। কোন বাজে পুরুষ মানুষ, বা ওদেশের ঢুকে পড়া সেনা তো টেনে নিয়ে যেতে পারে। পদ্মা, শ্যামলী, কবিতারা ওর দিকে ভীত ভাবে তাকাল।
মাস্টারদা কিছু লোককে নদীর ঘাটে জাল ফেলার নির্দেশ দিয়ে বিজয়, অলোক, দেবুদের সঙ্গে নিয়ে ওপারের জঙ্গলে খুঁজতে যাওয়ার ব্যবস্থা করল।
জবা – মাস্টারদা, আমিও যাব।
মাস্টারদা – ঠিক আছে চল। সঙ্গে অস্ত্র নিয়ে যেতে হবে সবাইকে। ওদের দলটা বেরিয়ে গেল মিনুর খোঁজে ওপারের জঙ্গলে।
(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *