মধ্যবর্তী ( ছোট গল্প) উত্তম কুমার দাস
মধ্যবর্তী ( ছোট গল্প)
উত্তম কুমার দাস
বকুল ফুলের গন্ধে চারিদিকটা ভরে গেছে কিন্তু চারিদিকে বকুল গাছের নামমাত্র নেই। ঘুমের মধ্যেই যেন ফোনের এলার্ম টা বেজে উঠছে বারবার, কিন্তু অনন্তের ঘুম ভাঙছে না। শারীরিক ক্লান্তি বারবার যেন শরীরটাকে জিততে চায়। অনন্ত হারার পাত্র নয়, উঠতেই হবে প্রচুর টাকা চাই। ঘর- সংসার তাকে কিছুই দেয়নি, সাময়িক সুখ শান্তির খোঁজে একমাত্র মেয়ে! তাও তাকেও তার মায়ের কাছে রেখে চলে আসতে হয়েছিল। এখন সে মাস মাইনের কর্মচারী। জার্মানে এসে কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে এক টুকরো সুখের সন্ধানে একটা বড় আকাশ ছুঁতে চেয়েছিল। যখন উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর ছাদ নির্মাণ হতো অনন্ত শুধু আকাশ দেখতো, মাঝে মাঝে বৃষ্টি ভিজিয়ে দিত। আজ অনন্ত টাকার মুখ দেখেছে। সাংসারিক পুরনো সব গ্লানি মুছে দিয়ে আজ একবার সে মেয়েকে দেখতে চায়। সেই কবে ছোট্ট মুন্নি কে রেখে চলে এসেছে দেশের ঘরে। জীবনটা একটু আগে শুরু করেছিল ঘর বাঁধার স্বপ্নে, বিয়ে টিকে গেল কিন্তু ঘর হলো না। তাই আর একবার পুরনো ভুলগুলো শুধরে নিতে বিদেশে পা রাখে অনন্ত। মেঘ জমা আকাশের মত তার অভিব্যক্তি। কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি। কিন্তু মানুষের জীবনে সব সময় প্রকৃতির খেলা চলে না। অনেক চেষ্টা করে অনন্ত উঠতে পারছে না। কতকালের ঘুম যেন অনন্তের চোখে বাসা বেঁধেছে। এখনতো ঘুমের সময় নয়, তাকে উঠতেই হবে।
অনন্তের ঘুম ভাঙলো। সামনে সেই ছোট্ট মুন্নি দাঁড়িয়ে। সেই কবে মেয়েটাকে ফেলে গেছে বউয়ের কাছে। বউয়ের টাকা ছিল, শরীর ছিল , রুপের দেমাগ ছিল, তবে মেয়ের প্রতি ভালবাসাতে একটুও ফাঁক ছিল না। তবু একটা ফাঁক বোধহয় ছিল কোথাও আর ওই ফাঁক দিয়েই অনন্ত চলে এসেছে জার্মানিতে।
এখানে শুধু কাজ আর কাজ। একটাও মনের মানুষ পেল না যার কাছে কিছু রাখা যায়। তাই ফিরে এসেছে অনন্ত তার মেয়ের কাছে। বাবার পাশে বসে মেয়ে কত কথা বলছে। বাবা আর মেয়ের সম্পর্কটা ঠিক মা আর ছেলের মত। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে মা হয়ে যায়। তখন মায়ের মত মেয়ের কত চিন্তা বাবাকে ঘিরে, বাবা কি করে ভালো থাকে। অনন্ত ঠিক এমনটাই মনে হতে লাগলো।সে মেয়ের জন্য কিছুই আনতে পারিনি ।
মুন্নি বাবার চোখের দিকে চেয়ে আছে। এ কি বাবা তুমি কাঁদছো কেন? তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার দিকে একটু তাকাও, দেখ… দেখনা, আমার চোখে এক ফোঁটাও জল নেই। সেই কবে আমার চোখের জল শুকিয়ে গেছে। মা যাওয়ার সময় বলেছিল মুন্নি একটুও কাঁদবি না। তুই কাঁদলে আমি কিন্তু খুব কষ্ট পাবো। তারপর থেকে আমি আর কাঁদিনি। আর তুমি কাঁদছো!
অনন্ত লক্ষ্য করল মুন্নির চোখ দুটো শুকনো খটখট করছে, এতটুকুও জল নেই। সবটা যেন ও সয়ে নিয়েছে।একটা মরুভূমিতে মরুদ্যানের মতো সেই চোখগুলো যেন সমস্ত টাকে বাষ্পের মত শুষে নিচ্ছে। কিন্তু মরুদ্যান তো মরুভূমিতে পথিকের একমাত্র আশ্রয়।দীর্ঘ পরিশ্রান্ত জীবনের সমাপ্তি হয়েছে আজ। অনন্ত মুন্নিকে আর একবার বলল আমি চলে গেলে তুই কাঁদবি না তো মা? মুন্নি বললো একটুও না, তুমি তো সেই কবেই চলে গেছো। সবটা আমার সয়ে গেছে বাবা। তুমি ভালো থাকলেই হবে। জানো! মাও খুব ভালো আছে। মা বলেছে আমি যেন কখনো কান্নাকাটি না করি। মা ওখান থেকে সব বুঝতে পারবে। আর তুমি?
আমার মুন্নি বড় হয়ে গেছে; তাহলে এবার আমি আসিরে মা। ওই ভোঁ বেজে গেল, দেরি হলে ওরা ঢুকতে দেবে না! এখনো অনেক কাজ বাকি… কি জানি হয়তো শেষ করতে পারবো কিনা! মুন্নি চোখ দুটো কেমন স্থির। আর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে মিষ্টি হাসি , সমস্তটাই যেন ঘুমের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে।
দূর থেকে সহকর্মীদের একগুচ্ছ অস্ফূট কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে, অনেকক্ষণ ধরে পড়ে আছে। এটাকে নিয়ে কি করবি কর, অফিসে খবর দে…