জগন্নাথের নবকলেবর কলমে: গীতালি
জগন্নাথের নবকলেবর
কলমে: গীতালি
“বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা
ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহি।।”
শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের রণভূমিতে অর্জুনকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তার মধ্যে এই কথাটি ছিল– পুরানো জীর্ণ বস্ত্রকে পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরতে হয়। ঠিক তেমন করেই দেহ যখন জীর্ণ হয়ে যায়, তখন আত্মা সেই দেহ ছেড়ে নতুন দেহকে আশ্রয় করে। মহাপ্রভু শ্রীজগন্নাথদেব এমন ভাবেই নিজেকে প্রকাশ করেন। যদিও তিনি পরমব্রহ্ম, তিনি প্রকাশিত দারুব্রহ্মরূপে, তবু তিনি তাঁর জীর্ণ দেহ ত্যাগ করে নবকলেবর গ্রহণ করেন। পুরীধামে শ্রীজগন্নাথ বলরাম, সুভদ্রা ও সুদর্শন এর সঙ্গে নিজেদের পুরানো রূপ ত্যাগ করে নতুন দেহ পরিগ্রহ করেন — এই রূপান্তরকেই ‘নবকলেবর’ বলা হয়।
ভগবদ্গীতায় বলা হয়, সকল প্রাণীই ক্রমশ শৈশব, যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যে আসে এবং পরিশেষে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীর্ণ দেহ পরিত্যাগ করে নতুন শরীরে প্রবেশ করে। শ্রী জগন্নাথদেবের নবকলেবর এই গভীর সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করে।
‘নবকলেবর’ ঠিক কবে প্রথম শুরু হয়েছিল তা নিশ্চিত করে বলা যায় না কিন্তু যে প্রামাণ্য ‘বৃহদ্খণ্ডে’ এই মূর্তি নির্মাণের ব্যাপার নিয়ে লেখা আছে, সেখানে দেখা যায় যে নানা ধরনের মূর্তি নির্মাণের বিষয়ে বলা রয়েছে। নানা রত্ন দ্বারা নির্মিত মূর্তির আয়ু সাধারণত দশ হাজার বছর হয়, ধাতব মূর্তির আয়ু সাধারণত এক হাজার বছর হয়; কাষ্ঠ নির্মিত মূর্তিকে বারো থেকে আঠারো বছর রক্ষা করা যায়, এবং মৃত্তিকা নির্মিত মূর্তিকে সাধারণত একবছর কাল রক্ষা করা যায়। এই সূত্র ধরেই শ্রী জগন্নাথের দারু- মূর্তি ১৯ বছর পর পর নবকলেবর প্রাপ্ত হয়।
পুরাণে বলা আছে, শ্রী জগন্নাথ দেব প্রাথমিকভাবে ‘নীলমাধব’ নামে পূজিত হতেন, মূর্তি ছিল পাথরে খোদাই করা। কিন্তু পরে দারুব্রহ্মের পূজা শুরু হয়। স্কন্দপুরাণ ও ব্রহ্মপুরাণ অনুযায়ী রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন এই কাষ্ঠ নির্মিত মূর্তি তৈরি করেন…যে কাঠ ভেসে এসেছিল পশ্চিম থেকে পূর্ব সাগরের তীরে সেই কাঠেই তৈরি হয়েছিল মূর্তি। দেব সভার শিল্পী বিশ্বকর্মা কৃষ্ণ থেকে প্রাপ্ত স্বপ্নাদেশ অনুসারে এই মূর্তি তৈরি করেছিলেন।
মাদলাপঞ্জি অনুসারে,রক্তবাহু ভৌমকারা রাজ্যের শোভনদেবের শাসনকালে পুরী আক্রমণ করেছিলেন। সেই সময় পুরোহিতেরা জগন্নাথ বিগ্রহকে শোনপুর এ নিয়ে যায় এবং পাতালে লুকিয়ে রাখে। সোমবংশ রাজত্বের রাজা যযাতি কেশরী (১) ১৪৪ বছর পরে শ্রী জগন্নাথ দেবকে পুরীতে ফিরিয়ে আনেন এবং সর্বপ্রকার নিয়ম রীতি মেনে নতুন বিগ্রহ তৈরি করেন। তিনি বিগ্রহস্থ “ব্রহ্মা” ( আত্মা )কে নবকলেবরে স্থাপন করেন। সুতরাং এই মতানুযায়ী দশম শতাব্দীতেই প্রথম নবকলেবর অনুষ্ঠিত হয়। এরপরে বহু শতাব্দী কেটে গেছে, কিন্তু পারম্পর্য অনুসারে নব কলেবরের কোন ইতিহাস পাওয়া যায় না। পদ্মশ্রী সত্যনারায়ণ রাজগুরুর (জগন্নাথ দেব বিশেষজ্ঞ) রচনায় পাওয়া যায় যে ১৩৭০ সালে শ্রী জগন্নাথ দেবের ‘নবকলেবর’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাঁর মতে প্রথম ‘নবকলেবর’ অনুষ্ঠিত হয় ১৩০৮ সালে। কিন্তু প্রামাণ্য সূত্র বলে, প্রথম নবকলেবর অনুষ্ঠান হয়েছিল ১৫৭৪ সালে। ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয় নবকলেবর অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৫৯৩ সালে। কিন্তু সপ্তদশ শতকে ৫বার নবকলেবর হয়েছিল,যা ১৬০৪, ১৬২৭, ১৬৪৬, ১৬৬৫ এবং ১৬৮৪ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যথাক্রমে। উনিশ শতকে ১৮০৯, ১৮২৮, ১৮৫৫, ১৮৭৪ এবং ১৮৯৩ সালে জগন্নাথদেবের নবকলেবর অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিংশ শতকে ছয়বার নবকলেবর অনুষ্ঠান হয়েছে— ১৯১২, ১৯৩১, ১৯৫০, ১৯৬৯, ১৯৭৭, ১৯৯৬ এবং তারপরে ২০১৫ সালে শেষ নবকলেবর অনুষ্ঠান হয়েছে।
নবকলেবর চৈত্র শুক্লা দশমীতে অনুষ্ঠিত বাণযজ্ঞ যাত্রার আগে হয়। ৪ রকমের নির্দিষ্ট লক্ষণযুক্ত বৃক্ষের খোঁজে ৫০ জন পরিচারক দিকে দিকে যাত্রা করে। যেই বৃক্ষ থেকে বিগ্রহ তৈরি হবে তারই খোঁজে তারা যাত্রা করে। পুরীর রাজার অনুমতি সাপেক্ষে তারা কাকাটপুরে মঙ্গলাদেবীর মন্দিরে পুজো দিতে যায়। বৃক্ষের সঠিক অবস্থান সম্পর্কে সেখানেই তারা অবগত হয়।
নবকলেবর এর জন্য যে-কোনো রকম বৃক্ষ অচল। বিগ্রহের জন্য বিশেষ লক্ষণযুক্ত বৃক্ষের প্রয়োজন রয়েছে। জগন্নাথদেবের বিগ্রহের জন্য নিম কাঠ প্রয়োজন, যে নিমবৃক্ষ ৭-১২ হাত দীর্ঘ হবে ও গাঢ় রঙ- যুক্ত হবে। গাছের মধ্যে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম চিহ্ন থাকতে হবে। এই বৃক্ষের একটি প্রধান কান্ড থাকবে এবং একে আরও চারটি অপ্রধান শাখাযুক্ত হতে হবে। এখানে কোনো রকম পাখির বাসা অথবা লতা জাতীয় গাছ থাকতে পারবে না, অথবা বৃক্ষটি বজ্রপাত- দুষ্ট হতে পারবে না। এই নিম বৃক্ষটি শ্বেতশিমুল, বরুণ ও বিল্ব বৃক্ষ পরিবৃত হতে হবে। বৃক্ষটির পাদদেশে সর্পগৃহ বা পিঁপড়ের ঢিবি থাকা প্রয়োজন।বৃক্ষটির অবস্থান কোনো নদী বা সরোবরের পাশে থাকা দরকার। তিনপাহাড় বা তিন পথ বিশিষ্ট স্থানে এটির অবস্থিতি হতে হবে। শিব মন্দির অথবা কবরস্থান নিকটেই থাকা প্রয়োজন।
সুদর্শনের জন্য যে বৃক্ষ প্রয়োজন তা অপেক্ষাকৃত রক্তবর্ণ হওয়া উচিত। বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহের জন্য বৃক্ষ অপেক্ষাকৃত হালকা রঙের হওয়া দরকার।
বৃক্ষ চিহ্নিত করার পরে হোম যজ্ঞ করা হয় এবং বৃক্ষ কর্তন করা হয়। এই কর্তনও এক উৎসব বিশেষ। প্রথমে পতি মহাপাত্র সোনার কুঠার দারুতে স্পর্শ করান তারপরে দইতাপতি রুপার কুঠার দিয়ে দারু স্পর্শ করেন। এরপরে সূত্রধর পরিবার লোহার কুঠার দিয়ে বৃক্ষ কর্তন করেন। মাপ মতন কেটে নেওয়ার পরই কাষ্ঠ খণ্ড গুলিকে মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। কৈলি বৈকুন্ঠতে অভিজ্ঞ ছুতোর মিস্ত্রির দল অপেক্ষা করে থাকেন, যারা দইতাদের তত্ত্বাবধানে বিগ্রহ নির্মাণের কাজ করেন। বিগ্রহ সম্পূর্ণ তৈরি হলে জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমায় তাদের গর্ভগৃহের স্নান বেদীতে ১০৮ কলস জল ঢেলে স্নান করানো হয়। এই সময় জগন্নাথ দেব অসুস্থ থাকেন। ১৫ দিনের জন্য দর্শন থেকে বঞ্চিত হয় মানুষ। এরপরে বিগ্রহকে নানা ঔষধি দিয়ে লেপন করা হয়,অসুস্থতাকে প্রতিহত করার জন্য। সম্পূর্ণ কর্মটি সমাধা হলে নতুন বিগ্রহ এবং পুরানো বিগ্রহকে মুখোমুখি বসানো হয়। সম্পূর্ণ সুরক্ষার মধ্যে দইতাপতির পরিবারের সর্বপ্রাচীন তিন সদস্য চোখে,মুখে, হাতে,পায়ে বস্ত্র খন্ড বেঁধে, পুরনো বিগ্রহে অবস্থিত আত্মা বা ‘ব্রহ্ম’ কে নব বিগ্রহে স্থাপন করেন।ঠিক মানুষের মতনই জগন্নাথ দেবের লীলা। জীর্ণ দেহ পরিত্যাগ করে আত্মা নতুন দেহ পরিগ্রহ করেন। এভাবেই নবকলেবর গ্রহণ করেন তাঁরা। পুরানো মৃত বিগ্রহ কৈলি বৈকুণ্ঠতে পাতালিকৃত করা হয়।
নবকলেবর অনুষ্ঠিত হয় সেই বছরে, যে বছরে আষাঢ় মাসে ২টি চান্দ্র বা পূর্ণিমা সংঘটিত হয়। এই মাসে চারটি পক্ষ হয়। নবকলেবর অনুষ্ঠানের জন্য প্রত্যেকটি পক্ষই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম পক্ষে বিগ্রহকে ‘নির্মলা মন্ডপে’ খোদাই করা হয়। পরের দুই পক্ষকে মলমাস বলা হয়। দইতা পতিদের ঈশ্বরের বংশধর বলে মান্য করা হয়। তাঁরা দ্বিতীয় পক্ষ কে চিহ্নিত করেন ঈশ্বরের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য। তৃতীয় পক্ষতে ‘অনবসর’ কর্তব্য করা হয়, রেশমি কাপড়ে বিগ্রহকে জড়িয়ে রেখে। এর পরেই ঈশ্বরের নবকলেবরে প্রতিষ্ঠা (transformation) করা হয় আত্মা বা ব্রহ্মাকে, যা এতদিন পুরানো বিগ্রহের মাঝে অধিষ্ঠিত ছিল। এই হল জগন্নাথদেবের ‘নবকলেবর’ এর সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত।
নবকলেবর উৎসব উপলক্ষে পুরীতে বহু ভক্তের সমাগম হয়। নতুন বিগ্রহকে রত্ন সিংহাসনে স্থাপন করে, মন্দিরের দ্বার খুলে দেওয়া হয় ভক্তজনের জন্য। শেষ নবকলেবর টি অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১৫ সালে।
*********************************
তথ্যসূত্র :
https://frontline.thehindu.com/arts-and-culture/heritage/the-rebirth-in-puri/article6904778.ece
https://www.indiastudychannel.com/resources/167544-Nabakalebar-The-soul-transformation-of-the-Gods-at-Puri.aspx
https://socialscienceresearch.org/index.php/GJHSS/article/download/3378/3267/
Soul transfer from Old to New Deities in Jagannath Temple begins