# সীমান্ত # পর্ব – ১৩ কলমে – অরণ্যানী
# সীমান্ত # পর্ব – ১৩
কলমে – অরণ্যানী
উঠোনের নিমগাছতলায় বসে মিনু আর লুল্লু মাছ ভাজা দিয়ে ভাত খাচ্ছে।
মিনু – দিদি, নাইতে যাবি না?
ঝিনুক – আমার চান হয়ে গেছে।
মিনু ও লুল্লুর খাওয়া শেষ। এঁটো বাসন দুটো মাজতে মাজতে মিনু বললো – তবে আমি নাইতে যাচ্ছি।
ঝিনুক – তুই অস্ত্রশিক্ষা নিতে গেলি না? মাস্টারদা কী বলবে?
মিনুর ভয় হলো মাস্টারদা না আবার সেদিনের মতো বাড়িতে চলে আসে।
মিনু – কাল থেকে নেবো।
মিনু দ্রুত পায়ে বাসনগুলো দাওয়ায় রেখে গামছা নিয়ে নদীর দিকে চলে গেল।
বটতলার ঘাটে এসে মিনু নদীর জলে পা ডুবিয়ে একটুক্ষণ বসে রইল। তারপর আশপাশের ঝোপে ফুটে থাকা ফুলগুলোর কাছে অন্যমনস্ক ভাবে ঘোরাঘুরি করতে লাগলো। নদীতে ফুটে থাকা জলজ ফুলগুলোর দিকেও চোখ পড়ল। ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে জলে নামল। সাঁতার দিয়ে গেল ফুলগুলোর কাছে। একটা ফুলে চুমু খেলো। জলের মধ্যে ডুব দিয়ে ভেসে উঠল একটু দূরে। আবার একটুক্ষণ সাঁতার দিল। বটতলার ঘাট ছাড়িয়ে মিনু ততক্ষণে অনেক দূর চলে এসেছে। একসময় হাঁপিয়ে গিয়ে পাড় খুঁজল। কাছাকাছি পাড় পেল নদীর ওপারের জঙ্গলের মধ্যে এক স্থানে। নির্জন জঙ্গল। মিনু পাড়ে উঠল। একটা বনমোরগ উড়ে চলে গেল। মিনু সেদিকে তাকাল। চারপাশে নিবিড় জঙ্গল। মধ্যাহ্নের রোদ মাথার উপর গাছের ডালে পড়েছে। গাছপালা রোদকে আড়াল করে রেখেছে। মিনু পাড়ে উঠলেও পুরোপুরি ডাঙা তখনও পায়নি। আগাছায় ভরা নদীর পাড়ে মিনু তখনও হাঁটু জলে। জল ভেঙে ডাঙার দিকে এগোবে কিনা দাঁড়িয়ে পড়ে ভাবছে। দু’চোখের দৃষ্টি ছায়া ঢাকা জঙ্গলের দিকে। হঠাৎই চোখে পড়ল দুটো ডাক পাখি ওই জলা আগাছার ঝোপের ভেতর ঢুকে গেল। পাখির ছানার কিচমিচ ডাক শোনা গেল। মিনু কৌতুহলী হয়ে সেইদিকে এগোল। দেখতে পেল আগাছা ও বনফুলের ঝোপের ভেতর এক জায়গায় ডাক পাখি দুটো ওদের দুটো ছানাকে কী যেন খাওয়াচ্ছে। মিনু থমকে দাঁড়াল। বুঝল, টের পেলেই পাখিগুলো হয়তো উড়ে পালাবে। ততক্ষণে মিনু জল ছেড়ে ডাঙায় চলে এসেছে। টুপ করে ঝোপের আড়ালে বসে বসে ডাক পাখিগুলোকে দেখতে লাগল। মিনু ভাবল — পাখির ছানাগুলো কি উড়তে পারে? যদি না পারে তো কাক চিলে ধরে নিয়ে যেতে পারে। অন্য পাখিরা তো গাছের ডালে বাসা বাঁধে। কিন্তু বুনো হাঁস, পানকৌড়ি, ডাক পাখি, এরা কোথায় বাসা বাঁধে? বাসা না বাঁধলে তো ছানা কিছুতে খেয়ে নিতে পারে। ওরা কি জলের ধারে আগাছার ঝোপে বাসা বানায়? কেমন হয় ওদের বাসা? এই ডাক পাখিগুলোরও কি কাছাকাছি কোথাও বাসা আছে?
মিনু চারপাশে তাকাতে লাগল। কোনো পাখির বাসা চোখে পড়ল না। মিনু খুব সাবধানে ঝোপের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে লাগল, যদি ডাক পাখির বাসা দেখা যায়।
নতুন দেশে মেঘ :-
একসময় রাত শেষ হয়ে আবারও ভোর হলো। অদ্ভুত কোন ঘোর আর উত্তেজনার মধ্যে মেঘের রাত কাটল। ভোর হতেই মেঘ ক্ষুধার জ্বালা টের পেল। তীর-ধনুক ও ঝুলি নিয়ে গাছ থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। খাবার মিলল না। ভোরের আবছা আলোয় পাখির কলরব শোনা গেল। জঙ্গলের মধ্যে ক্ষুধার্ত মেঘ এলোমেলো ভাবে খাদ্যের সন্ধানে ঘোরাঘুরি করতে লাগল। কাছাকাছি কোনো ফলমূলও মিলল না, শিকারও নয়। এমনকি জলও নয়। ধীরে ধীরে সকালের রোদ এসে গাছের ফাঁক দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে পড়েছে। ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত মেঘ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কোনো এক দিকে সোজা দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে থাকল।
কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর মেঘ বিস্মিত হয়ে দেখল মাচার উপর ঘর! মাচার নিচে ফাঁকা জমিতে বসে কিছু মানুষ খাওয়া দাওয়া করছে। কাছে একটা ফসলের জমিও আছে। মেঘের চিন্তা ভাবনাগুলো যেন কেমন গুলিয়ে যেতে লাগল। থমকে দাঁড়িয়ে কিছু ভাবল। মনে পড়ল কাল রাতে দৌড়ে সীমান্ত পার হওয়ার কথা, দু’দলের গোলাগুলির যুদ্ধের কথা। মেঘ মনে মনে ভাবল – তবে কোন দেশে এলাম আমি? অন্য দেশ এটা নয়? ক্ষুধার্ত অবস্থায় চোখের সামনে কিছু মানুষকে খাবার খেতে দেখে বেশিক্ষণ মেঘ স্থির থাকতে পারল না। ওই লোকগুলোও খেতে খেতে মেঘের দিকে তাকাচ্ছিল। মেঘ এগিয়ে এলো ওদের দিকে। ওরা প্রশ্নের দৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকিয়ে।
মেঘ – আমাকে কিছু খাবার দেবে?
একটি লোক প্রশ্ন করল – তুমি কোথায় থাকো? এই জঙ্গলে?
মেঘ – না, অনেক দূরে ।
লোকটি – তোমার দল? ওখানে খাবার নেই? নাকি হারিয়ে গেছো দল থেকে?
আর একটি লোক জিজ্ঞেস করল – তাড়িয়ে দিয়েছে দল থেকে?
মেঘ – আমার কোনো দল নেই। আমি একাই থাকি। অনেক দূরে। ওখানে কাল যুদ্ধ হচ্ছিল। পালিয়ে এসেছি।
লোকটি – ও, সীমানার ওখানে?
মেঘ – হ্যাঁ, দু’দিন কিছু খাইনি। এখন খেতে দাও। আমি ভালো শিকার করতে পারি। পরে শিকার করে তোমাদের খাবার এনে দেবো।
লোকটি একজনকে খাবার দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে মেঘকে জিজ্ঞেস করল – তুমি কি আমাদের দলে থাকবে?
মেঘ – না, একাই থাকবো। এখন থেকে এই জঙ্গলেই থাকবো।
একজন মহিলা একটি পাত্রে করে কিছু সেদ্ধ করা শস্যদানা এনে দিল। মেঘ মহিলাটির কাছ থেকে পাত্রটি নিয়ে খেতে শুরু করল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কয়েক মিনিটের মধ্যে খাবার শেষ করে ফেললো।
লোকটি – আর খাবে?
মেঘ – না, জল খাব।
একটি লোক জলের পাত্রে জল ঢেলে এগিয়ে দিল। মেঘ পাত্রের সবটুকু জল পান করে আবারও জল দেওয়ার ইঙ্গিত করলো। আবার জল দেওয়া হলো। তা পান করে মেঘ পাত্রটি রেখে মাটিতে বসল।
লোকটি – তুমি থাকবে কোথায়?
মেঘ – এখানেই একটা ঘর বানিয়ে নেবো আজ।
লোকটি সকলকে খাদ্যের সন্ধানে যাওয়ার নির্দেশ দিল। এক এক দল এক এক দিকে তীর-ধনুক নিয়ে বেরিয়ে গেল। কিছু মহিলা ও বাচ্চা রয়ে গেল। ক্লান্ত শরীরে বসে মেঘ চারপাশ দেখতে লাগল।
সবই তো একরকম। এটা অন্য দেশ!? মেঘের চোখের সামনে ভেসে উঠল ওর নিজের দেশের জঙ্গলে ওদের ঘর বাড়ি। আবার চোখ পড়ল এদের ঘরগুলোর দিকে। একবার ভাবলো নিজের দেশের জঙ্গলের মানুষগুলোর চেহারা। আবার তাকাল ওদের দিকে। মনে পড়ল ওখানে খাওয়া শস্যদানা সেদ্ধ। আবার এখানের একই খাবারের কথা। অবাক ভাবে ক্লান্ত চোখে সবকিছু দেখতে লাগল, আর আকাশ পাতাল ভাবনা মনের মধ্যে চললো।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর জঙ্গল থেকে বাঁশ, তালপাতা, হোগলা ইত্যাদি সংগ্রহ করে এনে সারাদিন ধরে ঘর বানালো। দুপুরের রোদ পড়তে ক্লান্ত শরীরে নতুন তৈরি করা ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। হঠাৎ ঘুম ভাঙতে তাকিয়ে দেখে সূর্য অস্ত গেছে। লালচে আলো ওর ঘরের সামনে এসে পড়েছে। চটপট উঠে পড়ল। ঝুলিটা খুলে বাক্সটা বের করে মেলা থেকে কেনা জিনিসগুলো আবারও দেখল। তারপর বাক্স বন্ধ করে ঝুলিতে ঢুকিয়ে, ঝুলিটা ঘরে রেখে তীর-ধনুক নিয়ে শিকারের সন্ধানে মাচা থেকে নামল। আবার কী মনে করে ঘর থেকে ঝুলিটা বের করে সেটা সঙ্গে নিয়েই চললো।
(ক্রমশ)