পুরানো সেই দিনের কথা…honeymoon ❤ কলমে / টিঙ্কু মুখার্জি

পুরানো সেই দিনের কথা…honeymoon ❤
কলমে / টিঙ্কু মুখার্জি

দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেল….আজ পুরানো গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসতে ইচ্ছে করছে, এক্কেবারে মধু মাখানো গপ্পো….মানে ইয়ে মধুও আছে আবার চাঁদও আছে। তখন তো আর সেল্ফি ছিল নাকো, তাই লাল টুকটুকে লজ্জা বা অভিমানি চেখের জল ধরে রাখতে পারিনি। শুধু মধু টুকু ভাগ্যিস যত্ন করে রেখে দিয়েছিলুম, এখন হুলের ভয়ে মধুও নাকি পাওয়া যায় না।
হানিমুনের কথা উঠতেই বেশ লজ্জা লজ্জা ভাব আমার, মনে কিন্তু ষোল আনা ইচ্ছে। আমার পতিদেব অত্যন্ত ভালমানুষ, লজ্জা টজ্জা না পেয়ে সরাসরি আমাকেই জিজ্ঞেস করল পুরী না গ্যাংটক? কথাটা পুরোপুরি উচ্চারিত হওয়ার আগেই লাফিয়ে উঠলুম পুরীইইই, আহা ! কত্ত গল্প শুনেছি সেই ছোট্ট থেকে, হানিমুন মানেই নাকি পুরী..গ্যাংটক কোন ছাড় ( ব্ড্ড ছেলেমানুষ ছিলুম কিনা…আরেকবার সুযোগ পেলে গ্যাংটকই হতো)। পতিদেব একটু মনঃক্ষুন্ন হলেন বোধহয়, ফেব্রুয়ারি মাসে গ্যাংটক সাথে কম্বলের উষ্ণতা কোন বর মিস করতে চায়…..। যাই হোক আমার কথাই শিরোধার্য, আফটার অল নতুন বিয়ে করা বউ।
মার্চের 7 তারিখ নবদম্পত্তি চলল হানিমুন করতে। স্টেশনে ছাড়তে এসেছে শাশুড়ি মা, দিদি ( ননদ), দাদা( ভাসুর)। আহা! কি আনন্দ, নিজেকে বেশ vip মনে হচ্ছে।
হঠাৎ মধুচন্দ্রিমায় রাহুর প্রবেশ, লিস্ট চেক করতে গিয়ে দেখা গেল ফাস্ট ক্লাস ডবল কূপ এর বদলে ফোর সীটার কূপ। হানিমুন কাপল, এটাও কি মানা যায়! বরমশাই রেলকম্পানির ষষ্ঠী পুজো করছেন আর দাদা আমার বরের। আমি দুঃখু দুঃখু মুখ করে ভাবছি আমাদের সঙ্গে যারা যাচ্ছে তারাও যেন হানিমুন কাপলই হয়। কিছু পরে টিটিমশায়ের প্রবেশ, আমার বরের সমস্ত ঝাল, দাদার অতীব মিষ্টি বাক্যবান অনায়াসে হজম করলেন ( যা কিনা ডাইজিনেও হজম সম্ভব নয়।)। শেষে হেসে বললেন, “লিস্টে টাইপিং মিসটেক, সব ঠিকই আছে। বাঁচা গেল, মধু এবং চাঁদ দুটোই পরিপূর্ণ। চন্দ্রগ্রহণ হতে গিয়েও হয়নি। লাগেজ রেখে গেটে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, ট্রেন ছাড়বে হঠাৎ চিৎকার আমাদের কূপ থেকে। দৌঁড়ে গিয়ে দেখি চোর মশাই পিছন দিক থেকে জানলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ক্যামেরা আর আমার সাধের ব্যাগভর্তি সাজুগুজুর জিনিস নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু টিটিমশায়ের চিৎকারে সে গুড়ে বালি পড়েছে। বেচারা হানিমুন কাপলের তখন কর্ণ লাল বর্ণ ধারণ করেছে।
এইভাবে মধু সংগ্রহ করতে করতে পুরী পৌঁছাল ট্রেন। সমুদ্রের ডাক শুনতে শুনতে ভোরবেলায় হোটেল। একটু ফ্রেশ হয়েই মধু আহরণে, থুড়ি সমুদ্র দর্শনে। একটু পা ভিজিয়ে একাত্ম হচ্ছি সবে দু জনে হাত ধরে, চোখে পড়ল সমুদ্রের মধ্যেই সুন্দর সাজানো রেস্ট্রুরেন্ট, ব্রেকফাস্ট তো ওখানেই করতে হবে। সবে অমলেট মুখে দিয়েছি দেখি বরমশাই হানিকে ছেড়ে পাঁই পাঁই করে ছুটছে। কিছু না বুঝে আমিও লাগালুম দৌঁড় পিছন পিছন, অমলেট প্লেটে হাততালি দিচ্ছে তখন। পরে শুনলাম প্রকৃতি অশেষ কৃপা বর্ষণ করেছিলেন।
পরদিন সাজুগুজু করে আগে থেকে বুক করা অ্যম্বাস্যাডার চড়ে চিল্কা। পাশে সুন্দরী বউ (?) বরমশাই আহ্লাদে আটখানা। শুরু হল ফটোসেশন, আমার নয় ডলফিনের। তবে তখন তারা বড্ড লাজুক, নেহাতই বাচ্চা কিনা, মুখ তুলেই টুপুস করে জলে। একটা রিল ডলফিনের ছবি শুধু, আমার নয়; কি হিংসেটাই হয়েছিল। তবে ছবি ওয়াশ করে আনতে গেছি বেশ আনন্দ করে ! যেমন তেমন ছবি নাকি, ডলফিনের ছবি বলে কতা – যেন যুদ্ধ জয়। ছবিগুচ্ছ হাতে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ” দাদা এতো জলের ছবি তুললেন, বৌদির ছবিও তো তুলতে পারতেন”। আমি তো ‘থ’! বরমশাইও বুঝতে পারে নি ব্যাটারা এমন বিট্রে করবে ।
এবার শুধু আমার ছবি। বললুম, “মুন ছাড়া হানি হয় নাকি”! ক্যামেরা হাতে নিয়ে বরমশাইকে দাঁড়াতে বললুল, বেশ পোজ দিয়ে দাঁড়াল। অভিজ্ঞ ফটোগ্রাফার নির্দেশ দিচ্ছে মানতে তো হবেই। পরে দেখলুম এতো মনোরম দৃশ্য, আমি প্রকৃতিপ্রেমিক হয়ে গেছি। ছবি জুড়ে শুধু বালিয়ারী মুনের (বরের) চিহ্ন নেই। সবই হানি আর মুনের মহিমা।
মধুযাপন চলতে লাগল। ঘুরেফিরে একদিন বেশ ক্লান্ত, খিদেও পেয়েছে বড্ড। হোটেলের নীচে রেস্টুরেন্টে গেলুম খেতে, বললুম- “আলুর পরোটা খাবো”।। বরমশাই বলল, “6টা অর্ডার দিই , হানি তুমি 2টো আমি 4টে।” আমি বললুম, ” একটা বেশি নিও যদি লাগে।” 7টা আলুর পরোটার অর্ডার শুনে ছেলেটা অদ্ভুতভাবে আমাদের দিকে তাকালো, জম্মে যেন হানি দেখেনি থুড়ি হানিমুন দেখেনি। কাচুমাচু স্বরে ছেলেটি বলল,” স্যার প্রথমে 3টে দিই লাগলে পরে দেবো”। ভাবলুম ভালোই তো গরম গরম পাওয়া যাবে। ওমা…..! তারপর আলুর পরোটা নামে যেটা এল- দেখে চক্ষু চড়কগাছ । বরমশাই কোনোরকমে দেড়খানা খেয়ে হাঁপাতে শুরু করেছে, আমি একটা পুরো শেষ করতে পারলুম না। কিন্তু স্বাদ লা-জবাব। ক্ষানিক পরে ছেলেটি জানতে চাইলো আর চাই কিনা…হানিমুনের মুখে তখন বোকা বোকা হাসি।
এবার একদিন সমুদ্রে ভালো চান তো করতে হবে, আহ্লাদ আর ধরে না। হাত ধরে দুজনে এগিয়ে চললুম বেশ খানিকটা গভীরে, সে এক মধুর সময় সমুদ্রটাও যেন বেশীই অসভ্য হল সেদিন, এমন ঢেউ কেউ তোলে……..ভেসে গেলুম দুজনে। কিছুপরেই হ্যাচকা টান, চোখ খুলে দেখি একজন মুশকো লোক, দুহাতে হানি আর মুনের চুলের মুঠি! হানি ও মুনের হাত কিন্তু তখনও ধরা, কি প্রেম!❤
নবজন্ম লাভ করে সেকি আনন্দ…বরমশাই বলল, “চলো আজ বিয়ার পার্টি”। আমি লাজুক হেসে সম্মত(বস্তুটি চেখে দেখবার লোভ সামলাতে পারলুম না ।) গদগদ চিত্তে বরমশাই গ্লাসে ঢালল সেই তরল বস্তুটি, ওমা! সেকি উৎকট গন্ধ, অন্নপ্রাশনের ভাতও যেন উঠে আসবে মুখে…পার্টি র দফারফা। আহা! হানির মুন যেন একটু বিষন্ন, কুছ পরোয়া নেহি আফটার অল হানি তো ভারি মিষ্টি কিনা..।
পরদিন জগন্নাথদেবের দর্শন, তাঁর ইচ্ছে তেই সকল কর্ম, তাঁকে অবজ্ঞা করে সাধ্যি কার। চান টান করে গেলাম মন্দিরে যদিও মুন তখনও প্রচণ্ড রোমান্টিক মুডে, ভক্তিরসে ভীষণ এলার্জি। আমি ভক্তিমতি হানি ইয়ে মহিলা। কিন্তু মন্দিরে ঢোকার মুহূর্তে সবার মাথায় জগন্নাথদেবের আশীর্বাদ স্বরূপ একটা করে দণ্ডাঘাত পড়তে দেখলুম। মনে মনে প্রশ্ন করলুম কেন এমন দয়া প্রভু, যদিও উত্তর এখনও পাইনি।ভয়ে ভয়ে ঢুকছি, কি জানি কত বড়ো আশীর্বাদতবে এবারও উদ্ধারকর্তা আমার সেই মুন মানে পতিদেব। খপ করে লাঠি ধরে ফেললে! আমার মাথায় আশীর্বাদ বর্ষিত হল না, তবে পাণ্ডামশায়ের মুখ থেকে বেশ কিছু অভিশাপ বর্ষিত হল বটে।
জগন্নাথদেবের পুজো সেরে এবারে পেট পুজো মানে কাকাতুয়ার গজার সন্ধানে..। মনে পড়ল দাড়িবুড়োর সেই গান, “সে যে চমকে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায় যায় না তারে বাঁধা…” সত্যিই সে চোখে ধাঁধাই লাগাল! পরে জানলুম আমাদের হোটেলের পিছনেই নাকি তেনার আস্তানা। এ যেন “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি” কেস। যাই হোক খাঁচাবন্দি কাকাতুয়ার সঙ্গে আলাপ করলুম, ভারি ভদ্রলোক।
এবার নাকি সাইড সিন দেখে দেখে হানিমুন করতে হবে, আহা কি আনন্দ! চলল হানি with মুন প্রাইভেট কার বুক করে। লিঙ্গরাজ টেম্পল, আবার ভক্তিরস গদগদ। “ঠুকো ঠুকো মাথা ঠুকো, এইখানে বসো, কোলে জগবন্ধু আসিবে।” আমি বাধ্য ছাত্রী, হঠাৎই পট পরিবর্তন…. চিলরূপী পতিদেবতা তখন ছোঁ মেরে আমাকে উদ্ধার করে অন্তর্ধান হল। ব্যাকগ্রাউন্ডে গান নয় কিছু বাক্যবান আর অভিশাপ, ঠিক সিনেমার নায়িকা উদ্ধার সিন…ভিলেনের বাড়া ভাতে ছাই।
অতঃপর ধৌলিগিরি, উদয়গিরি, খণ্ড গিরি , নন্দনকানন। তখন পেটে আগুন। ড্রাইভার কে বলা হল ভালো খাওয়ার হোটেল এ নিয়ে যেতে। সে সাধ্য মতো চেষ্টা করল বটে, যেখানে পৌঁছোলুম সেখানে যাই চাই, তাই নাই । ম্যানেজার শশব্যস্ত হয়ে আতিথেয়তায় নিযুক্ত হলেন। শেষে ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন দিয়ে লাঞ্চ এবং স্পেশাল একটা ডিস্ যত্ন করে হোটেলের তরফ থেকে আমাদের দেওয়া হল। বেশ
উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে জানলুম যে সেটা ‘অনিয়ন রায়তা’ ।
চন্দ্রভাগা নদী মোহনা….সমুদ্রের সাথে মিলনস্থল, এক স্বর্গীয় অনুভূতি। আমরা যেন হারিয়ে গেলুম, প্রেম বুঝি এমনই হয়! সেই দৃশ্য কল্পনা করে আজও আমার মুনের সাথে হারাতে রাজী, মানে হানিমুন করতে রাজী..।❤
এবারে সেই বিখ্যাত সূর্য মন্দির। স্বপ্নের মতো। স্বপ্নবন্দি করতে সবাই ব্যস্ত, হানি এবং মুনও। আরও ব্যস্ত ফটোগ্রাফার রা। একজনকে মুনের বেশ পছন্দ হল, শুরু হল ফটোসেসন। “হাথেরো তলে মন্দিরো রহিব” সব ফটোগ্রাফারের এক বিখ্যাত ডায়লগ। হাথেরো তলে কি করে মন্দিরো রহিব বুঝিলাম না তবে পরে দেখিলাম সত্যি মন্দিরো রহিল। আহা কি আনন্দ আবার! এ যে সত্যি হানিমুন কি জয়..। হাথেরো তলে মন্দিরো নিয়ে ধাইকিরিকিরি ( তাড়াতাড়ি) হোটেলে ফিরলুম।
এবার ফেরার পালা…অনেক মিষ্টি ভক্ষণ হয়ছে। কেনাকাটার বহরে মুনের ঔজ্জ্বল্য কমেছে, তার উপরে শাশুড়ি মায়ের ফরমায়েসি একবস্তা বাসন! কলকাতায় যেন কিচ্ছু পাওয়া যায় না, আদিখ্যেতা কি সহ্য হয় । ট্রেনে উঠে বসা মাত্র আর এক আপদ! কি সুন্দর পাথরের রুটি বেলন চাকি! মুনের ঔজ্জ্বল্য উত্তাপে পরিণত, তবুও হানিমুন বলে কতা…। মুনের মধু ঝরে ঝরে পড়ছে, দু খানা পাথরের রুটি বেলন চাকি,(যদিও বরমশাই বলেছে সিমেন্টের, রঙ করা; যেন যা দেখতে নাড়ি তার চলন ব্যাঁকা ) একটা লাল একটা সাদা দুই মায়ের পুরীর উপহার(শাশুড়ি মা, নিজের মা) । হাওড়াতে নাচতে নাচতে গিয়ে ট্যাক্সি, হানিমুনের শেষ হানিটাও তো চেটেপুটে নিতে হবে। বরমশাই এর বাসনের বস্তা টেনে মেজাজ তেতো…আমি বিন্দাস, সেই মহামূল্য জিনিস দুটি আমার হাতে…।
ট্যাক্সিতে জিনিসপত্র ঠিকমতো রাখা হল। এবার শুধু গদগদ প্রেম❤যেন শেষ পাতে আইসক্রিম।
বাড়ি ফিরে বরমশাই গাড়ি থেকে জিনিস নামাতে ব্যস্ত, আমি এক নিঃশ্বাসে আধঘন্টায় সমস্ত বলে ফেলার চেষ্টায় ব্রতী। বিশেষ করে ওই মহামূল্য সিমেন্টের থুড়ি পাথরের উপহারের কথা।
শাশুড়ি মা খুব খুশি। আমার আর তর সইল না, বাড়ি ঢুকেই খোঁজ পড়ল কিন্তু কোথায় সে…..আমার সিমেন্ট থুড়ি আমার পাথর! সে তখনও ট্যাক্সির পিছনের সীটে ঘুমোচ্ছে।
হায়রে! বুকটা বুঝি এখনও টনটন করে উঠল।
অতঃ হানিমুন কথা সমাপ্ত। ❤❤

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *