# গল্প। # শিরোনাম-নিঃশব্দ আঘাত। # কলমে-ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
# গল্প।
# শিরোনাম-নিঃশব্দ আঘাত।
# কলমে-ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
সুমনা কবে থেকে কথা বন্ধ করে দিয়েছে অনলের সঙ্গে? অনলের আর মনে পড়েনা। সুমনার নাকি অনলের স্ত্রী হওয়ার যোগ্যতাই ছিলোনা। প্রথম দিনেই বধুবরণের সময় কানে মধু দিয়ে বড় ননদ বলেছিলো-“আমরা যা বলবো সব যেন তোমার কানে মধুর মতো মিষ্টি লাগে।”- মুখে মধু দিয়ে বড় জা বলেছিলো-“আমাদের যা বলবে মধুর মতো মিষ্টি করে বোলো, কেমন?”- অষ্টাদশী সুমনা কেবল ঘাড় কাৎ করে বাধ্য মেয়ের মতো সব কথাতেই নীরবে সায় দিয়ে যাচ্ছিল। মা তো তেমনই শিখিয়ে দিয়েছিলো-এই বাড়িটাই নাকি তার আসল বাড়ি। ঐ বাড়িটা বাপের বাড়ি।তা আপন করে নিচ্ছিলো সুমনা সবাইকে। দিদিভাই, বড়দি মা বলে ডাকতে ভালোও লাগতো। শাশুড়িমাতো নিজের মায়ের থেকে কম কিছু না। সুমনা সকলের চোখের মনি; শুধু যার চোখের মনি হওয়ার কথা…! সে তো ফুলশয্যার রাতে অবনতমুখি নববধূকে বলেছিলো-” এই যে, আমার চোখের দিকে তাকাও। এই যে আমার দুচোখের মনি দুটো দেখছো এর একটা আমার দিদি , আর একটা আমার বৌদি।”- সুমনার হাতটা নিজের বুকে চেপে ধরে বললো-” এখানে যে হৃৎপিণ্ডটা আছে সেটা মা। মনে থাকবে? “- সুমনা তাহলে কে?!! তারপর? একটা রক্তাক্ত যন্ত্রণাবিদ্ধ অনুভূতি!! ভোরবেলা দিদিভাই ঘুম থেকে ডেকে দিলো।-” দরজা খোল্ সুমনা। মা পুজোতে বসবে।”- সুমনার ঘরেই যে ঠাকুরের আসন পাতা। অতএব প্রতি ভোর চারটেয় দরজা খুলে দেওয়া, অনলের মায়ের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়া, সুমনার স্নান করে এসে শাশুড়ির পুজোর যোগান দেওয়া নিত্যকর্ম। খুব সাধারণ একটা অল্পবয়সী বাঙালি মেয়ের জীবন। শুধু সব মেয়ের যেমন নিজের কোনো বাড়ি না হলেও একটা নিজের ঘর তো হয়। সুমনার নিজের কোনো ঘর হলো না। ঐ ঘরটা তার বরের রাতের প্রমোদাগার, ভোরে শাশুড়ির পুজোর ঘর, দুপুরে বড়ো জা আর ননদের আড্ডার ঠেক। লুডো খেলতে হয় সুমনাকেও ওদের সঙ্গে ।হাসিমুখেই।সুমনার বাপের বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না। মা তাই নিজেই একদিন চলে এলো মেয়েকে দেখতে। শাশুড়ি ,জা , ননদ সবাই খুব খাতির করলো। শুধু অনল জোর গলায় বললো-“সুমনা, আমার জুতো জোড়া পালিশ করে দাও।”-বড়ো জা , বললো -“যা সুমনা,তুই জুতোটা পালিশ করে দে। আমি ঠাকুরপোকে ভাত দিচ্ছি।”- সুমনার মা চোখের জল চেপে ফিরে গেলো আর সুমনা হাসিমুখে বরের জুতো পালিশ করতে লাগলো। বেশ হয়েছে। সব দোষ তো মায়ের। মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করতেই বিয়ে দিয়েছিলো মা। সুমনার হাতে পয়সা দেওয়ার প্রয়োজনও নেই। ওর আবার হাতখরচা কিসের? ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছে? শাশুড়ি নিজে নিয়ে গিয়ে খাইয়ে আনছে। সিনেমা যাবে? খুব ভালো বই। দিদিভাই ভাসুরদার সঙ্গে দেখে ফেরার সময় শাশুড়ি আর ছোট জায়ের জন্য টিকিট কেটে এনেছে। সব দিকে খেয়াল বড়বৌমার শুধু সুমনার বরের সঙ্গে বেড়াতে যেতে, সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করে কিনা সেটাই কেউ জানতে চায় না। এটাও কেউ জানেনা সত্যিই সুমনারও সেই ইচ্ছেটা ফুলশয্যার রাতেই মরে গিয়েছিল।
এমন ভাবেই কেটে গেলো পঁচিশ বছর।সুমনার মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেলো। বড় ভাসুরের সঙ্গে সংসারটাও কতো বছর আগে থেকেই তো আলাদা হয়ে গিয়েছিলো।অনলের শাসনের ধারটার আর তেমন ধার নেই। অনলের আব্দার করার জন্য মা নেই, বৌদি নেই। অনলকে এখন কেউ মানেনা। অনল রাগে গর্জে ওঠে-” এক কাপ চা, এক গ্লাস জল কী পাবো?”- চা, জল সামনে নামিয়ে দিয়ে সুমনা পাশের ঘরে পাড়ার ছোটো ছোটো বাচ্চাদের পড়াতে বসায়। তার হাতখরচের জোগাড় সে এইভাবেই পঁচিশ বছর ধরে করে আসছে। অনল অশ্রাব্য ভাষায় চিৎকার করে। ঘরের মধ্যে সুমনা বাচ্চাদের সহজ পাঠ দেয়,-“ছোট খোকা বলে অ আ, শেখেনি সে কথা কওয়া।”–