জীবনবিজ্ঞান সম্পর্কিত কিছু কথা— পর্ব- ২ ডরোথী দাশ বিশ্বাস

জীবনবিজ্ঞান সম্পর্কিত কিছু কথা— পর্ব- ২

✍️ডরোথী দাশ বিশ্বাস

আজ আমরা প্রকৃতি থেকে অনেক দূরে… ছাত্রছাত্রীরা আজকাল আর কেউ দল বেঁধে খেলার মাঠে স্বেচ্ছায় খেলে না। খেলতে খেলতে অসাবধানে, অনিচ্ছাতেও গাছের পাতায় হাত ছোঁওয়ায় না, ভোরের আলো গায়ে মেখে কেউ আর ফুল চুরি করতে বের হয় না। প্রকৃতির অনন্য সৃষ্টি গাছপালা ও পশুপাখিকে চোখ ভরে দেখবার ও চেনবার মধ্যে এক অনাবিল আনন্দানুভূতি ও শিক্ষার মজা লুকিয়ে আছে, সেটা তারা জানলোই না। স্কুলের প্রথাগত পড়াশুনোকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে স্কুল টাইমেই প্রাইভেট টিউটরের কাছে শিক্ষালাভ করে। কেন এমন— একজন শিক্ষক হয়েও এর সদুত্তর মেলেনি আমার কাছে। প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ আস্বাদন করার সময় নেই তাদের। ‘প্রকৃতি আজ বিপন্ন’- এই বহুশ্রুত কথাটা তারাও জানে, শ্রেনীকক্ষের চার দেওয়ালের মাঝে জীবনবিজ্ঞান পড়ানোর ফাঁকে এসব বহু আলোচ্য বিষয়, স্কুলে এলে চিন্তার উদ্ঘাটন হয় এমন তথ্য মিলতে বাধ্য, যেটা নোটসর্বস্ব মিনি স্কুলে কখনোই পায়না তারা। সিসমোন্যাস্টি চলন পড়ানোর সময় লজ্জাবতীর প্রসঙ্গ আসে। স্পর্শ করলেই পাতা মুদে যায়, কেন যায়— ব্যাখ্যা করার আগে পাঠে রসসঞ্চারের জন্য শিক্ষক আরো বললেন— “এর ইংরেজী নাম ” Touch me not”, হলুদ বর্ণের তরুক্ষীরের প্রসঙ্গে যখন শিয়ালকাঁটার উদাহরণ সামনে এলো, তখন শিক্ষক বললেন, “শিয়ালকাঁটার ইংরেজী নাম ” Mexican popy”- নাম শুনে মনে হচ্ছে নিশ্চয় এটি মেক্সিকোর ফুল, বিদেশী, অথচ আমাদের গ্রাম-বাংলায় যত্রতত্র এটি জন্মায়— পপি ফুলের পাপড়ির সাথে এই ফুলের পাপড়ির সাদৃশ্য আছে, তাই বুঝি এমন নাম। পাপড়ির ন্যায় পাতার গঠনেও কত বৈচিত্র্য! বট জাতীয় গাছ Ficus krishni পাতার গঠনে পেয়ালার ধরণ, যা নিয়ে সুন্দর গল্প— কৃষ্ণ ননী খেয়েছেন এই পাতায়— তাই “কৃষ্ণের Butter cup” থেকে গাছটির বিজ্ঞানসম্মত নাম এমন। “Indian Butter Tree” তবে কি? মহুয়া…। বিশ্ব উষ্ণায়নের সাথে সাথে বায়ুদূষণ কমাতে বৃক্ষরোপণের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে— জীবনবিজ্ঞান ক্লাসে একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জানাতে সক্ষম সর্বাধিক বায়ুশোধক গাছ— নিম। কোনো প্রকৃতিপাঠ শিবির বা সামার ক্যাম্পে গিয়ে শিক্ষার্থীরা জীবনবিজ্ঞান শিক্ষকের সান্নিধ্যে জানতে পারে এটি কি গাছ, এর বৈশিষ্ট্য কি, এর অর্থনেতিক গুরুত্ব বা ভেষজমূল্য কি। একই গাছের স্থানীয় নাম, বাংলা নাম, ইংরেজী নাম ও বিজ্ঞানসম্মত নাম কি— তাও জানতে পারে। যেমন: ম্যাগনোলিয়ার বাংলা নাম- হিমচাঁপা, Bleeding heart— এর পরিচিত নাম Yesterday-today-tommrow,
Flower of the queen…. জারুল, কাজুআপেল- কাজুবাদাম সংলগ্ন রসাল ফল, মুসান্ডা-র বাংলা নাম “পত্রলেখা”, অড়হরের পরিচিত নাম পায়রামটর, উর্বরতার প্রতীক- অশোকফুল, পদ্মফুলের দোসর- স্থলপদ্ম, শ্রীকৃষ্ণের জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত- কদমফুল, পলাশের অপর নাম- কিংশুক, কিংশুক বললেই ‘নির্গন্ধা ইব কিংশুকা’- মনে আসে, ক্লাসে একঘেঁয়েমি কাটাতে এই কথাটির ছোট্ট ব্যাখ্যার জুড়ি নেই।
Victoria amazonica বা জললিলির পাতা খুব বড়ো ( ব্যাস 80 — 90 cm ) বলে এটি নৌকার মত কাজ করে। অর্কিডের কথা প্রসঙ্গে জানানো যেতে পারে “বিভিন্ন অর্কিড ফুল বিদেশে রপ্তানী করে ভারত সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে যা অন্য কোনো ফুল রপ্তানীতে হয়না”, গুলমোহর গুলমোহরই, এই গাছকে আমরা অনেকেই কৃষ্ণচূড়া বলে ভুল করি…। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শ্রেনীকক্ষের পাঠ বা শিক্ষকের সান্নিধ্যে প্রকৃতি পাঠ সবই অত্যন্ত ফলদায়ক হয়ে ওঠে এভাবেই যা স্কুলে না এসে শুধুমাত্র নোটসর্বস্ব প্রাইভেট টিউশনে সম্ভব নয়।

নেচার স্টাডি, সামার ক্যাম্প, হারবেরিয়াম, জুলজিক্যাল গার্ডেন, বোট্যানিক্যাল গার্ডেন দেখা— এসবের মাধ্যমে জীবনবিজ্ঞান বিষয়টি দলগতভাবে এবং এককভাবে অত্যন্ত আনন্দদায়ক বিষয়। এর ফলে শিক্ষার্থীদের বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটে। এ বিষয়ে শিক্ষা নিতে গিয়ে শিক্ষার্থী সমস্যার উপস্থাপন, সমস্যার অনুধাবন, সমস্যার সমাধানের জন্য বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ, সমস্যার সমাধান— করতে সক্ষম এবং সত্য সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে।

যেহেতু জীবনবিজ্ঞান সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, প্রতিনিয়ত বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে শিক্ষার্থীর ভিতরে তার অজান্তে সত্যনিষ্ঠা, আদর্শবোধ গড়ে ওঠে এবং নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত হয়।

জীবনবিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে বিচার ক্ষমতা, যুক্তিবোধ, চিন্তাশক্তি ও সৃজনীশক্তির বিকাশ ঘটে।

প্রথমতঃ জীবনবিজ্ঞানের ছাত্রী হবার সুবাদে, দ্বিতীয়তঃ শিক্ষকতার কল্যাণে জীবনে বহু ব্যবহারিক বিজ্ঞানভিত্তিক কাজ, বিজ্ঞান মেলা, বিজ্ঞান সমিতি, বিজ্ঞানমূলক প্রদর্শনী ও শিক্ষামূলক ভ্রমণের সুযোগ এসেছে। জীবনবিজ্ঞান বিষয়ে এসবের সুযোগ এখন আরো বেশি। এসবের দ্বারা শিক্ষার্থী-শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক খুব সৌহার্দ্যপূর্ণ হয়। এরকম শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে শিক্ষার্থী সহানুভূতি, সহযোগিতা প্রভৃতি নানা সামাজিক গুণের অধিকারী হয়। তাই জীবনবিজ্ঞান পাঠের সামাজিক মূল্য যথেষ্ট।

জীবনবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা যে সব সামাজিক গুণের অধিকারী হয় ও জীবনের শিক্ষা পায়, তার দ্বারা বৃহত্তর পরিবেশে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে সব বাধা-বিপত্তিকে জয় করতে পারে, অর্থাৎ এই বিষয়টি বিদ্যালয়ের শিক্ষাকে বৃহত্তর পরিবেশে সঞ্চালিত করতে পারে অর্থাৎ এর সঞ্চালনগত মূল্য আছে।

বিভিন্ন বর্ণের ও বিভিন্ন আকৃতির গোলাপফুল দেখে বিস্মিত হই আমরা। Keats বলেন— “Truth is beauty and beauty is truth”. গোলাপ ফুলের সৌন্দর্য— সেও তো ভীষণ সত্য একটি বিষয়। বৈজ্ঞানিকের সৌন্দর্যপিপাসু মন এই বৈচিত্র্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে Variation এর সূত্র আবিষ্কার করে ফেলেন। বিজ্ঞানও সত্য। প্রকৃতিবিদ Darwin প্রকৃতির মধ্যে সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছিলেন; উদ্ভিদ ও প্রাণীর বৈচিত্র্যে মুগ্ধ হয়ে সেই সব জীব সংগ্রহ করেছেন। এভাবেই তো তার পৃথিবীবিখ্যাত বই “The Origin Of Speceies By Means Of Natural Selection”- লেখা হয়ে গেলো। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হল “প্রাকৃতিক নির্বাচন”- মতবাদ। তাই বলা যায়— জীবনবিজ্ঞানের সৌন্দর্যগত মূল্য আছে।

আজকের আলোচনায় সবশেষে বলি— বর্তমান যুগ হল বিশেষীকরণের যুগ। যেমন: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ কৃষিবিদ, সুদক্ষ ইঞ্জিনীয়ার, জীবনবিজ্ঞানের শিক্ষক গড়ে তোলার মূলে সেই জীবনবিজ্ঞান তথা বিজ্ঞানের শিক্ষা ও জ্ঞান। তাই এই বিষয়ের বৃত্তিগত মূল্য অনস্বীকার্য।

(চলবে)

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *