আত্মজা **** অধ্যায় -১৪ সুদেষ্ণা সিনহা
আত্মজা
————-
ধারাবাহিক উপন্যাস
অধ্যায় -১৪
সুদেষ্ণা সিনহা
একদম শেষ মুহূর্তে ঠিক হয়েছিল স্বাধীনতার ডেলিভারি হবে জিয়াগঞ্জের লন্ডন মিশন হসপিটালে। এই ব্যাপারটা প্রথমে শশীকান্তের মাথায় আসে।পরে সে অলোকের সঙ্গে আলোচনা করে।অলোক স্বাধীনতাকে নিয়ে একদিন জিয়াগঞ্জের লন্ডন মিশন হসপিটালে যায়।
সাধারণত যে বয়সে মেয়েরা মা হয় সেই তুলনায় স্বাধীনতার বয়স অনেকটা বেশী। অতিরিক্ত খেলাধুলা করার জন্য শরীরে নারীসুলভ কমনীয়তাও কম। সব থেকে বড় কথা তাকে নিয়ে বহরমপুরের ডাক্তারবাবুদের মধ্যে কিছুটা আশঙ্কা তো আছেই।
শশীকান্ত তার বাবার মতোই রাশভারি মানুষ। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেন। উকিল হিসাবে এই শহরে এবং শহরের বাইরেও তার বেশ নামডাকও আছে। এক মক্কেলের কাছে সে শুনেছিল বহরমপুর জেলা হাসপাতালের চেয়ে লন্ডন মিশন হসপিটালের চিকিৎসা ব্যবস্থা বেশ ভাল।
রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর প্রতিদিন বাবা,শ্যামাকান্তের কাছে গল্প শুনতেন শশীকান্ত —জীবন্ত ইতিহাসের গল্প।ইংরেজ বণিকদের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের মিশনারীরাও আসছেন তখন এদেশে।মূল উদ্দেশ্য আর কিছু নয় খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচার এবং ধর্মান্তর। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলায় এলেন রেভারেন্ড মে। তিনি বুঝলেন,ধর্মপ্রচার করতে গেলে সব থেকে আগে চায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা। চুচূড়া ও তার আশেপাশে বেশ কিছু প্রাথমিক স্কুল স্থাপন করেছিলেন তিনি। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে মুর্শিদাবাদ জেলায় লন্ডণ মিশনারী সোসাইটি নামে এক মিশনারী সংস্থা এল। সেই সংস্থা উপলব্ধি করেছিল মুর্শিদাবাদে প্রসূতি আর শিশুদের চিকিৎসার তেমন কোন সুযোগ নেই। প্রসূতি আর বাচ্চাদের জন্য হাসপাতাল করার খুব প্রয়োজন এই চত্বরে।সুতরাং জিয়াগঞ্জের স্থানীয় জমির মালিকের কাছে ৪২ বিঘা জমি কিনে নিল লন্ডন মিশনারী সংস্থা। সেই জমিতেই লন্ডন মিশনারী হাসপাতালের ভিত খোঁড়া হল।
মিশনারী ডাক্তাররা সেখানে চিকিৎসা করেন বটে ,তবে চিকিৎসা তাদের কাছে শুধু কাজ নয় সেবাও । নার্সরাও সেখানে রোগীনি ও বাচ্চাদের প্রতি বিশেষ যত্ন নেন।
সেদিন অলোকের কাছে শশীকান্ত কথাটা পেড়েছিল।
——অলোক স্বাধীনতার ডেলিভারির ব্যাপারে ভেবেছ কিছু?
—–দাদা বহরমপুর হাসপাতালটা কেমন?
—–ওই চলে যায় । আমি যতটুকু জানি খুব অপরিস্কার। তোমার বৌদির ডেলিভারির সময় যা দেখলাম।
—-হুম।
—-‘তাহলে ওই অবস্থায় ওকে কোথায় নিয়ে যাবে ভাবছ ?
—–নাহ্।আমার তো তেমন জানা নেই।
—–এক মক্কেলের কাছে শুনছিলাম, জিয়াগঞ্জের লন্ডন মিশন হাসপাতাল নাকি খুব ভাল হয়েছে।ভাল ভাল মিশনারী ডাক্তার আছেন ,পরিসেবাও ভাল।
শেষ তিন মাস লন্ডন মিশন হাসপাতালেই ডাক্তার দেখানো হয়েছে স্বাধীনতাকে।
ডাক্তারবাবু হেনরী আলফ্রেড বয়স্ক এবং সত্যিকারের অমায়িক মানুষ। তিনি নিজে অকৃতদার।তবুও অনাথ বাচ্চাদের নিয়ে একটি অনাথ আশ্রম আছে তাঁর। এখানেই হেনরীর জন্ম।জন্মের পর থেকে বাবা-মা হারা। কেউ তাঁকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে আলেকজান্ডার ডাফের অনাথ আশ্রমে রেখে যায়।সেখানেই বড় হওয়া,সেখানেই ডাক্তারী পড়া।
স্বাধীনতাকে দেখে মিস্টি হেসে আধা ইংরাজি,আধা বাংলায় তিনি জিঞ্জেস করেন,এখোন কেমন ফিলিংস করতেসো মাআ? বেবির মুভমেন্ট হতেছে?
মাথা হেলায় স্বাধীনতা। বাচ্চা বেশ নড়ছে।প্রথম প্রথম বুঝতে পারত না সে।বুদবুদের মতো কি যেন উঠে যাচ্ছে উপরে।আবার কিছুক্ষণ পর হুশ করে নেমে গেল। পেটের ভেতরে গ্যাস হলো না তো?
মাকে বলতেই সরমা হেসে ফেলেছিলেন।
—–না মা।এটা বাচ্চার চলাফেরা।সে আর এক জায়গায় স্থির থাকবে না।বড় হচ্ছে না!
সবার আড়ালে নিজের পেটে হাত বোলায় স্বাধীনতা,মিস্টি সোনা বড় চঞ্চল তুমি।এক দন্ড স্থির থাকতে পার না? এত দুষ্টুমি করলে হবে!মাকে চাকরি করতে হবে না?
সব দেখে শুনে ডাক্তার, হেনরি বললেন, ভেরি গুড।
স্টেথো দিয়ে পেটের চারপাশ দেখে ডাক্তারবাবু তাকান অলোকের দিকে , নাও হোয়াটস্ ইওর ফিউচার প্ল্যানিং মিস্টার সান্যাল ? ইট্স্ লাস্ট মান্থ,ভেরি ইম্পপর্টেনট ফ মাদার অ্যান্ড বেবি।দে নীড প্রপার নার্সিং।হামাদের হসপিটালে টোটাল অ্যারেজমেন্ট আছেএ। নাও ইউ ডিসাইড হোয়াট ইউ ওয়ান্ট টু ডু।
গাড়ীঘোড়া সাতসতের এত ভাবনার কি আছে?
সরমা বললেন,স্বাধীনতাকে শেষ মাসটা ওখানেই রেখে দাও।
স্বাধীনতাকে লন্ডন মিশন হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতাল তো নয় যেন মন্দির! খুব পছন্দ স্বাধীনতার।বাগানে মরসুমী ফুলের ছড়াছড়ি। বিকেলে পায়চারি করা যায়।ঘরের স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখে সে।মন আনন্দে নেচে ওঠে।
মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কি মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ।
সন্ধ্যেবেলায় প্রার্থনা সভা।যীশুখ্রীষ্টের ক্রুশবিদ্ধ ছবি।সব স্টাফ একত্রিত প্রার্থনা ঘরে।
Father,God,we bow before you and recognize our great need of a Savior.Today we want to lift our hearts and give thanks for Your Son,our Lord,Jesus Christ. We lift our hearts in praise to our Savior,and as your loved children and your redeemed servants we lay our lives before You in worship. Amen.
প্রভু যীশুর জন্মদিন আজ। পঁচিশে ডিসেম্বর। রাত বারোটায় ঘন্টাধ্বনি বেজে উঠল–ঢং ঢং।আজ উদযাপনের দিন।বেথেলহাম নগরীতে কুমারী মা মেরির কোলে এলেন যীশু।খ্রীষ্টানরা বিশ্বাস করেন,তিনি ঈশ্বরপুত্র।মানুষকে সবরকম পাপ থেকে মুক্তি দিতে তাঁর জন্ম।
বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে হাসপাতালের ওয়ার্ড,করিডর,অফিসরুম,মেটারনিটি ওয়ার্ড।দূর থেকে ভেসে আসছে গান–আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে…..
স্বাধীনতার তলপেটে ভীষণ ব্যথা শুরু হয়েছে।সে বসতে পারল না।বালিশে মাথা রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
ব্যথাটা বাড়ছে ক্রমশ।উহ্ আর সে পারছে না।বাথরুম পাচ্ছে বার বার। তবে কি এটাই প্রসব বেদনা!
মা বলেছিলেন ,খুব কষ্ট। আমরা মায়ের জাত।আমাদের যে সব সহ্য করতে হয় মা। ঈশ্বরের বাগান থেকে একটা শিশুকে নিজের করে নেবে মা,একটুও কষ্ট পাবে না,তাই কি হয়?
বিছানায় ছটফট করতে করতে স্বাধীনতা ক্ষীণ কন্ঠে ডাকতে লাগল, সিস্টারদিদি,সিস্টারদিদি,এদিকে একবার আসবেন?
ছুটে এলেন সিস্টার।পরীক্ষা করে বললেন,জল ভেঙে গেছে।ডক্টরকে ইমারজেন্সিতে কল দাও।ম্যাকিনজোস দাও।শিগ্গীর লেবাররুম রেডি কর।
হাসপাতালের করিডরে অনেকক্ষণ থেকে বসেছিল ওরা। অলোক,পাশে সরমা,শশীকান্ত আর তার স্ত্রী। এখনও কোন খবর আসেনি।
সরমার চিন্তা হচ্ছে।যতই হোক তিনি মেয়ের মা। মেয়েটার শরীরটা বেশ ভারী। তারপর “বিয়ে করব না ,বিয়ে করব না ” বলে অনেকটা বয়স বাড়িয়ে ফেলল।ভগবানের কি সৃষ্টি! এক শরীরের ভিতর আরেক শরীর দিনে দিনে বেড়ে বেড়ে এক পূর্ণাঙ্গ রূপ।ছেলে বা মেয়ে যা হবে হোক, যদি খবরটা আসত..
. একটু নিশ্চিন্ত হতে পারতেন তিনি।
একটু দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে শশীকান্তকে বললেন তিনি,একটু জিঞ্জেস করে দেখ না বাবা।অনেকক্ষণ তো মেয়েটাকে নিয়ে গেছে।এখনও কোন খবর এল না কেন?
শশীকান্ত বললেন,আচ্ছা দেখছি তুমি বস।
অলোকেরও চিন্তা হচ্ছে।বাড়িতে মা-টিঙ্কু-মুন্নিও বোধহয় খুব ভাবছে। খবর পেলেই কৃষ্ণনগরে একটা টেলিগ্রাম করতে হবে আজই।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে ।হাসপাতালের ভিতরের আলোগুলো জ্বেলে দিচ্ছে একে একে।
বনলতা সেন থেকে লাইনগুলো মনে পড়ছে অলোকের:
” সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী—-ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন।
থাকে শুধু অন্ধকার,মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”
খবর এল,স্বাধীনতা সান্যালের মেয়ে হয়েছে। বেডে দেওয়া হয়েছে মা ও শিশুকে। দু’জন করে ঢুকে দেখে আসতে পারে।
সিস্টার বললেন,পেসেন্ট কাহিল।বেশী কথা বলাবেন না।ঘুমের ডোজ দেওয়া হয়েছে।
শিশুটি বেশ ফর্সা,মোটাসোটা,গোলগাল। মাথাভর্তি চুল কপাল ও ঘাড়ে নেমে এসেছে। দুই হাতের মুঠি পাকিয়ে মুখে ভরছে।
পাশে আচ্ছন্নের মতো শুয়ে আছে স্বাধীনতা। মুখে একরাশ ক্লান্তি।
অলোক ডাকল,স্বাধীন,স্বাধীন….
একবার বোঁজা চোখ খোলার চেষ্টা করল স্বাধীনতা, পারল না।কপালে কিছুটা কুঞ্চন দেখা দিল যেন ।মুখে একবার’ উঁউঁ’ বলে আবার ঘুমিয়ে পড়ল সে।