‘এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি : এক অসম্পূর্ণ জীবন’,৭ম পর্ব : গীতালি ঘোষ
‘এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি : এক অসম্পূর্ণ জীবন’,৭ম পর্ব : গীতালি ঘোষ
এ্যান্টনি আর সৌদামিনীর প্রেমকাহিনী অপরিণত বয়সের কোনো নারী পুরুষের নয়, দুজন অত্যন্ত আধ্যাত্মিক মানুষের একত্রিত যাপনের কাহিনী….এক আত্মা জাত দুই দেহধারী দুটি মানুষ যারা সেকালে নতুন ভাবধারার স্পন্দন তুলতে পেরেছিলেন আন্তরিক প্রচেষ্টায়। পরম প্রেমে, পরম ঐশ্বরিক ভাবসাধনায় এদের ভালোবাসার পৃথিবী গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সমাজ বড় নিষ্ঠুর — সেকালের বাঙালির বিদেশীদের প্রতি অবিশ্বাস, ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামী, পরশ্রীকাতরতা, জাতিবিদ্বেষ এই দুটি মানুষের যৌথ জীবনকে বিনষ্ট করে দিয়েছিল। স্তব্ধ করে দিয়েছিল একটি প্রস্ফূটিত যুগ্মজীবনকে। এই প্রেমকাহিনী রোমিও জুলিয়েটের কাহিনীর মত বিখ্যাত নয়, এ এক অকথিত কাহিনী… এও এক মর্মস্পর্শী কাহিনী, যা তার আধ্যাত্মিক মহিমায় কালোত্তীর্ণ হতে পারত। মানুষের চরম অমানবিকতায় কেমন করে দুটো নিষ্পাপ জীবন শেষ হয়ে যায় তারই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত এদের জীবনকথা।
সমাজের নৃশংস বিরোধীতায় এবং ব্রাহ্মণদের নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রে এ্যান্টনির অনুপস্থিতিতে সৌদামিনীর গৃহে চুপি চুপি অগ্নিসংযোগ করা হয়। সৌদামিনী জীবন্ত দগ্ধ হন… পুড়ে ছাই হয়ে যায় তাদের সাধের আশ্রম। এ্যান্টনি সেসময়ে কবিগানে এক বিপুল জয়ের অধিকারী হয়ে বাড়ি ফিরে আসছিলেন, সন্তানসম্ভবা প্রিয় স্ত্রীর কাছে। চোখে তার ছিল জয়ের আনন্দ, মনে ছিল ভাবীকালের স্বপ্ন… সেই সব স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ হয়ে গেল শুধু কিছু ধর্মান্ধ বিষাক্ত লোকের প্ররোচনায়। এ্যান্টনির প্রেম, তার স্বপ্ন, তার প্রাণশক্তি, তার ঐশ্বরিক চিন্তা সবকিছুর অবসান ঘটল অগ্নি প্রজ্জ্বলিত আপন গৃহটির দর্শনে। তারই চোখের সামনে তার সোনার সংসার ভস্মীভূত হয়ে গেল। তার উত্তরাধিকারীর আর এই পৃথিবীতে আসা হল না, দেখা হল না এক অনাগত শিশুর অদম্য প্রাণশক্তিসম্পন্ন এক ‘বাঙালি’ পিতাকে, জানা হল না তার পিতা-মাতার এমন ঐশ্বরিক প্রেমজীবনকে। সমাজের অকরুণ ঈর্ষায় জীবনের কী বিপুল পরাজয় ঘটল!! কী মর্মন্তুদ ও হৃদয় বিদারক এই পর্তুগালজাত বাঙালি কবিয়ালের জীবন !
এ্যান্টনি ফিরিঙ্গির লৌকিক জীবন সমাপ্ত হয় ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে কিন্তু তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন তার প্রাণপণ প্রচেষ্টায় ধরে রাখা বাঙালিয়ানায়, তার কবিয়াল পরিচিতিতে, আর তার স্ত্রীয়ের প্রতি অপূর্ব বিশ্বস্ত এক প্রেমের আলোকে। ফিরিঙ্গি কালীবাড়িতে তার রচিত যে শাক্ত স্তব আজও উচ্চারিত হয়, তারই মধ্যে অনুরণিত হয় এ্যান্টনি কবিয়াল ও সৌদামিনীর ঐশ্বরিক প্রেম, যা আজও স্পন্দিত হয়ে ওঠে মন্দিরের আনাচে কানাচে, ব্যক্ত করে এক বিদেশী বাঙালির প্রেমময় অস্তিত্বকে, তার স্ত্রীয়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসাকে। তার এই অসম্পূর্ণ জীবনের প্রতি রইল আমার বিনম্র শ্রদ্ধা এবং দুফোঁটা চোখের জল।। (শেষ)