# সীমান্ত # পর্ব – ১২ কলমে – অরণ্যানী

# সীমান্ত # পর্ব – ১২
কলমে – অরণ্যানী

প্রেমিক যুগল :-
পশ্চিম দিগন্তে, নদীর ওপারের জঙ্গলের আড়ালে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। ভাঙাচোরা বকুলতলার ঘাটে পড়ে আছে কিছু শুকনো ও তাজা বকুল ফুল। কিছু দিনের চড়া রোদে ঘাটের শ্যাওলা এখন শুকিয়ে গেছে। নদীর জলে সূর্যাস্তের ছায়া, চারপাশে পাখির কলরব। অস্ত্রশিক্ষা শেষ করে ক্লান্ত শরীরে ঘাটের চাতালে প্রতীক্ষারত বিজয়। চুল উস্কোখুস্ক, মুখে চোখে ক্লান্তি ও চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। তবু শান্ত ভাবে বসে আছে কবিতার অপেক্ষায়। স্থির দৃষ্টি নদীর উপর লাল সূর্যাস্তের ছায়ার দিকে। ধীর পদক্ষেপে শান্ত, বিষণ্ণ মুখে কবিতা এসে দাঁড়ালো বিজয়ের পেছনে। নদীর জলে কবিতার ছায়া পড়তে বিজয় কবিতার দিকে ঘুরে বসল। কবিতাও বসে পড়ল বিজয়ের মুখোমুখি। একটুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ। তবে আগের মতো লজ্জা বা অস্বস্তি বোধ ওদের মধ্যে দেখা গেল না। চির পরিচিত দুটি মানুষ মুখোমুখি। দু’জনেরই চোখে মুখে চিন্তা ও বিষণ্ণতার ছাপ। বিজয় কবিতার ডান হাতটা জড়িয়ে ধরলো।
বিজয় – তুমি কি আমার জন্য খুব ভাবছ? ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। কবিতা নীরব। ওর চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রুকণা ঝরে পড়ল। বিজয় আর একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে কবিতার কাছে সরে এসে ডান হাত দিয়ে কবিতার চোখের জল মুছিয়ে দিল। বিজয়ের ডান হাতে তখন কবিতার চোখের জল লেগে। বিজয় সেই অশ্রুকণার দিকে বিহ্বল চোখে একটুক্ষণ চেয়ে রইল। কবিতা ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিল।
কবিতা কাঁপা ও বসা গলায় জিজ্ঞেস করল – অস্ত্রশিক্ষা কেমন হচ্ছে?
বিজয় – মাস্টারদা তো বলছে ভালোই হচ্ছে। চিন্তার কোনো কারণ নেই। আরো তো অনেকে যাচ্ছে।
কবিতা – তুমি তো প্রথম বার।
বিজয় – অলোকও প্রথম বার। সেছাড়া মাস্টারদা তো আছে আমাদের সঙ্গে।
কবিতা আবারও কাঁদতে কাঁদতে বললো – জানি। কিন্তু যারা যায় সবাই কি ফিরতে পারে? বিজয় কবিতাকে দু’হাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো – এরকম কথা ভাবতে নেই। ভালো কিছু ভাবো।
কবিতা – আচ্ছা, যুদ্ধ কি হবেই?
বিজয় কবিতাকে আর একটু দৃঢ় আলিঙ্গন করে বললো – সে কী, জানো না? কাল রাতেই তো জঙ্গলের সীমান্তে একপ্রস্থ যুদ্ধ হয়ে গেছে। আমাদের দেশের অনেক সেনা মারাও গেছে। কে জানে ওরা আমাদের জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে কিনা।
কবিতা – তুমি যুদ্ধে চলে গেলে আমি কী করব? বিজয় পরম স্নেহের সঙ্গে কবিতার ঠোঁটে একটা চুমু খেল।
– আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। যুদ্ধ শেষ হলে ফিরে আসব।
ধীরে ধীরে আবছা অন্ধকার নামল। একটা হরিণ ওপারের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে নদীর ওপারে জল খাচ্ছিল। ততক্ষণে বিজয় আর কবিতা নদীর দিকে মুখ করে বসেছিল। হঠাৎ ছপাং করে একটা আওয়াজ হওয়ায় দু’জনেই চমকে তাকাল নদীর ওপারে। দেখলো হরিণটা নদীর জলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আবছা অন্ধকারে হরিণের রক্তে নদীর জল কালো দেখালো। একজন আদিবাসী যুবক তার বলিষ্ঠ দু’হাতে হরিণটাকে তুলে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে চলে গেল। আর একটু অন্ধকার নামল। ঘাটের আশপাশের ঝোপ থেকে শিয়াল ডেকে উঠল। একটা শিয়াল ঘাটের পাশ দিয়ে ছুটে চলে গেল। বিজয় কবিতাকে হাত ধরে টেনে ওঠালো।
বিজয় – চলো, অন্ধকার হয়ে গেছে। আর এখানে বেশিক্ষণ আমাদের থাকা ঠিক নয়। ওরা দু’জনে হাত ধরে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে ফিরতে লাগলো।
বিজয় – মন খারাপ করো না। ভালো থেকো।
কবিতা – তুমিও ভালো করে অস্ত্রশিক্ষা নিও।
বিজয় – মনে জোর ধরো। আরো খারাপ সময় আমাদের জীবনে আসতে পারে। ভেঙে পড়ো না। যদি আমায় ভালোই বাসো, তবে মনে মনে আমার পাশে থেকো। ভরসা দিও। নিজের মনে ভরসা রেখো। তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট হবে।
ওরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে চুম্বনবদ্ধ হলো। শুক্ল পক্ষের আধফালি চাঁদের আবছা জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। ওরা কখন বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে। আবছা আলোয় বাড়িগুলো দেখা গেলে ওরা সচেতন হলো। পরস্পরকে আলিঙ্গন মুক্ত করে যে যার নিজের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। যেতে যেতে একবার থেমে পরস্পরের দিকে একবার তাকাল। তারপর চলে গেল।

জানলা দিয়ে সকালের রোদ এসে পড়েছে মিনুর বিছানায়। মিনু ঘুমোচ্ছে। বাইরে উঠোনে মিনুর মা যথারীতি কর্মরতা। উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে। বাবা বালতির জলে মুখ হাত ধুচ্ছে। রান্নাঘরে ঝিনুক সবার খাবার ব্যবস্থা করছে। পাশের ঘরে অলোক পোশাক পরে প্রস্তুত হচ্ছে অস্ত্রশিক্ষা নিতে যাওয়ার জন্য। মিনুর বিড়াল উঠোনে নিমগাছের তলায় চড়ুই পাখি, ফড়িং, প্রজাপতিদের সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলছে।
মিনু স্বপ্ন দেখছে :- সকালের সোনালি রোদ নদীর জলে। মিনু বটতলার ঘাটে। বটতলার ঘাটে নদীতে অনেক পদ্ম ফুটেছে (এটা স্বপ্ন। তাই নদীতে যত খুশি পদ্ম ফুটতে পারে।) দেখে মিনুর খুব আনন্দ হলো। ও নদীর শীতল জলে ধীরে ধীরে নেমে গেল। পদ্মফুলগুলোর চারপাশ দিয়ে সাঁতার কাটতে লাগলো। কত পদ্মফুল নদীতে! সোনালি রোদ পড়ে নদীর জল সোনার মতো ঝলমল করছে। এ নদী তো ওর গাঁয়ের নদী নয়! এ কোন নদীতে নাইতে এলো সে! এ তো বটতলার ঘাট নয়। নদীতে এতো পদ্মফুল? নদীর ধারে ধারে কত রঙ বেরঙের ফুল ফুটে আছে। কত ফুলের গাছ! অবাক দু’টি বড় বড় চোখে মিনু আনন্দের সঙ্গে চারিদিকে তাকাতে লাগলো। নদীতে সাঁতার দিতে দিতে পদ্মফুলগুলো ছুঁয়ে যেতে লাগলো। ধীরে ধীরে সিক্ত বসনে নদীর পাড়ে উঠে এসে একটি ফুলকে দু’হাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো।
ঘরের জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়ল মিনুর মুখে। অদ্ভুত কোন অনুভূতিতে চমকে উঠে মিনুর ঘুম ভাঙল। একটুক্ষণ ঘরের উপরের ছাদটার দিকে তাকিয়ে রইল। স্বপ্নের ঘোর তখনও ভালো করে কাটেনি। বিছানার চারপাশে তাকিয়ে দেখল লুল্লু নেই। মিনু বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে এলো। আজকের সকালটা যেন অন্যরকম লাগলো ওর কাছে। অলোক ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে অস্ত্রশিক্ষা নিতে। মিনুর মা ও দিদি ঘরে কাজ করছে। বাবা চাষের কাজে বেরোচ্ছিল। মিনুকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করল – কী রে, অস্ত্রশিক্ষা আর নিবি না? গেলি না যে?
মিনু – যাব, পরে।
বাবা বেরিয়ে গেল। মিনু দেখল লুল্লু আমগাছ তলার বুনোফুলগুলোর উপর বসে থাকা প্রজাপতিদের দেখে খুব উত্তেজিত ভাবে লাফালাফি করছে। দেখে মিনুর বেশ হাসি পেল।
মিনু – কী রে, প্রজাপতি ধরবি নাকি? একদম নয়। মিনু লুল্লুকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগলো। লুল্লু ছাড়া পাওয়ার জন্য কোলের মধ্যে ছটফট করতে লাগলো। মিনু কোল থেকে নামিয়ে দিল লুল্লুকে। ঘরের ভেতর থেকে ঝিনুক ডাকলো – মিনু, খাবি আয়। মিনু ঘরে এসে জিজ্ঞেস করল – দুধ আছে?
মা – আছে, কিন্তু বিড়ালকে খাওয়ানোর জন্য নয়।
মিনু – তবে ও কী দিয়ে ভাত খাবে?
ঝিনুক – ধুত, খিদে পেলে বিড়ালে শুধু ভাতই খেয়ে নেবে।
মিনু – তুই চুপ কর।
মা – তোর দাদার জন্য দুধ রাখা আছে। নিস না।
মিনু – আমার জন্য কেন নেই?
মা – আরে বাবা, ও তো অস্ত্রশিক্ষা নিচ্ছে। কত পরিশ্রম করছে।
মিনু ভাত ফেলে রেখে বাইরে চলে এলো।
মা – খাবি না?
মিনু কোনো কথার উত্তর না দিয়ে উঠোনের দড়িতে মেলে রাখা একটা গামছা নিয়ে দ্রুত পায়ে ছোটার ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল। চোখে মুখে কোনো রাগ, অভিমান বা দুঃখ নেই। বরং আনন্দই প্রস্ফুটিত।
মিনু চললো ওদের সেই বটতলার ঘাটের দিকে। ঘাটের কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেল কবিতার ভাই বাবলুকে। বাবলুর হাতে একটা ছিপ।
মিনু – এই বাবলু, তোর ছিপটা একটু দিবি? একটা দুটো ছোট মাছ উঠে গেলেই তোকে দিয়ে দেবো।
বাবলু – কেন, লুল্লুর জন্যে?
মিনু – হ্যাঁ।
বাবলু – চল, আমি ধরে দিচ্ছি।
মিনু – এই, তুই ভাত এনেছিস? আমি আনতে ভুলে গেছি। ক’টা ভাত জলে ছড়িয়ে দিলে মাছ আসবে। গামছা এনেছি। গামছা দিয়ে তাহলে ধরে নেবো।
বাবলু – এই ঘাটে হবে না। সবাই বাসন মাজতে, কাপড় কাচতে আসবে। ওই কেয়াফুলের ঝোপটার দিকে চল।
ওরা কেয়াফুলের ঝোপে গেল। মাথার উপর বটগাছের ছায়া। বাঁধানো কোনো ঘাট নয়। আগাছায় ভরা ঝোপ।
বাবলু – তোর গামছাটা পাত, বসবো।
মিনু – সেকী! গামছা দিয়ে তো আমি মাছ ধরবো। এই নোংরা ঝোপে কেউ গামছা পাতে?
বাবলু – কিছু হবে না। পাত না। নইলে বসবো কোথায়? এই দ্যাখ, আমি কেঁচোর টোপ, বোলতার টোপ জোগাড় করেছি। মাছ উঠবেই। আর উঠলে তোকেও দেবো।
বাবলু ওর হাতের ছোট একটা হাঁড়ি থেকে ঢাকা সরিয়ে মিনুকে টোপগুলো দেখাচ্ছিল। মিনু শেষ পর্যন্ত গামছাটা পেতেই দিল। তার উপর ওরা দু’জনে বেশ জুত করে বসল। মিনুর চোখ ভরা নদীর উপর। স্বপ্নের দৃশ্যগুলো চোখের সামনে একবার ভেসে উঠল। মুখে চোখে অদ্ভুত এক খুশির অনুভূতি ফুটে উঠল।
মিনু – এই জানিস, আজ না একটা খুব সুন্দর স্বপ্ন দেখেছিলাম।
বাবলু ততক্ষণে বঁড়শিতে টোপ পরাচ্ছিল।
বাবলু –কী স্বপ্ন?
মিনু তার স্বপ্নের বর্ণনা দিতে লাগলো। বাবলু মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুনতে নদীতে ছিপ ফেলল।
বাবলু – স্বপ্নটা কি তুই ভোরে দেখেছিস? ভোরের স্বপ্ন কিন্তু সত্যি হয়।
মিনু – যাঃ, তা কী করে সত্যি হবে? স্বপ্নটা খুব সুন্দর, তাই না?
বাবলু – কেন? নদী পদ্মফুলে কোনদিন ভরে যেতেও পারে। আর নদীর ধারেও তো ফুল আছে। কোনদিন অনেক ফুল তো হতেই পারে।
মিনুর চোখের সামনে আর একবার ভেসে উঠল স্বপ্নে দেখা নদী ও তার চারপাশ।

কথা বলতে বলতে ওরা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল।হঠাৎই বাবলুর ছিপে পড়ল খুব জোর টান। আর একটু হলে ছিপটা হাত ফসকে যাচ্ছিল। বাবলু দু’হাতে ছিপটাকে টেনে রাখার চেষ্টা করতে লাগলো।
বাবলু – মিনুদি রে, বড় মাছ খেয়েছে। খুব টানছে।
মাছের টানে বাবলু হাঁটু জলে নেমে গেল। মিনুও ছিপটা টানতে লাগলো।
বাবলু – মিনুদি, তুই একটু ছিপটা টেনে ধরে রাখ। খুব জোরে ধরবি। আমি জলে নেমে গিয়ে মাছটাকে ধরছি। নইলে মাছটা বঁড়শি ছিঁড়ে পালাতে পারে।
বাবলু মিনুর হাতে ছিপ দিয়ে একগলা জলে নেমে গেল। মিনু ছিপ টেনে রাখতে পারছিল না। ছিপের টানে মিনুও জলের মধ্যে নামতে লাগলো। বাবলু জলে ডুব দিয়ে দু’হাতে জাপটে একটা কেজি খানেকের কাতলা মাছকে তুলতে চেষ্টা করল। মিনুও ছিপ ছেড়ে দিয়ে বাবলুর সঙ্গে টানাটানি করে অতি কষ্টে দু’জনে মাছটাকে ডাঙায় তুলল।
বাবলু – খুব বড় মাছ, বল। আমাদের বাড়ি চল। দিদিকে বলবো মাছটা কেটে ভাগ করে দেবে।
মিনু – কবিতা তো এখন অস্ত্রশিক্ষা নিচ্ছে।
বাবলু – তাহলে মাকে বলবো। চল। বাবলু মাছটা দু’হাতে ধরে নিয়ে চললো। আর মিনু ছিপ, হাঁড়ি, গামছা নিয়ে চললো বাবলুর পেছনে।
(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *