‘এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি : এক অসম্পূর্ণ জীবন’, ৬ষ্ঠ পর্ব : গীতালি ঘোষ
‘এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি : এক অসম্পূর্ণ জীবন’, ৬ষ্ঠ পর্ব : গীতালি ঘোষ
এ্যান্টনি এবং সৌদামিনী দুজনেই একে অপরের প্রতি নিষ্ঠায় ও নিবিড় প্রেমে মগ্ন ছিলেন।সৌদামিনী তার স্বামীকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছিলেন জীবনে সফল হওয়ার পথে। এ্যান্টনিও সৌদামিনীকে বিবাহিত জীবনের সকল সুখ প্রদান করতে সর্বদাই তৎপর ছিলেন। তার সঙ্গে মিলেছিল এদের ঈশ্বরের প্রতি গভীর অনুরাগ। স্ত্রীয়ের সান্নিধ্যে এ্যান্টনি নিজের বিদেশী তকমা অনায়াসে বিসর্জন দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু গোঁড়া ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিশ্বাস এই অসম বিবাহকে ভয়ংকর ধাক্কা দিয়েছিল, তারই অভিঘাতে সর্বদাই তটস্থ ছিল এদের দাম্পত্য জীবন। এমনকি কবিগানের আসরেও বারবার এ্যান্টনিকে সহ্য করতে হয়েছে সৌদামিনী সম্পর্কে নানা রঙ্গ রসিকতা ও কটূক্তি। এ্যান্টনি স্বভাবতই অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ণ হতেন কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি এই সমস্ত চটুলতা, কদাচারকে উপেক্ষা করতে শিখে গিয়েছিলেন। এই আয়ত্ত করার শিক্ষা তাকে আরো অগ্রগতির দিকে এগিয়ে দিয়েছিল।
এ্যান্টনি এবং সৌদামিনী তাদের সৃজনশীল ও আধ্যাত্মিক প্রেমময় জগতে নিজেদের ভাবজীবন গড়ে নিয়েছিলেন। পরম সুখে নিবিষ্ট মনে তারা একযোগে ঐশ্বরিক সাধনায় জীবন অতিবাহিত করছিলেন। নিজেদের মধ্যে প্রায়শই এরা বেদ পুরাণাদির আলোচনায় মগ্ন থাকতেন। সে সময়ে এ্যান্টনি বহু আগমনী গান রচনা করেন যা ভাবে ও রসে অতুলনীয় হয়ে ওঠে। এই সব গান তাকে জনমানসে পরিচিত করে তোলে। দুর্গামায়ের পিত্রালয়ে আসায় জগতবাসীর খুশি তাকে মুগ্ধ করেছিল। সেই সূত্রেই তিনি আগমনী গীত রচনায় মন দিয়েছিলেন। তিনি তার স্ত্রীকে ভালোবেসে বাংলার সবকিছুকে আপন করে নিয়েছিলেন।
কিন্তু বাঙালি ব্রাহ্মণেরা মতাদর্শের দিক থেকে এতটাই সংকীর্ণ ছিলেন যে ইউরোপীয়দের ম্লেচ্ছ বা অস্পৃশ্য ভাবতেই অভ্যস্ত ছিলেন। তারা এ্যান্টনিকে জল অচল করে রেখেছিলেন আর এমন দুই বিজাতীয় নরনারীর মিলনে আঘাত লেগেছিল তাদের ব্রাহ্মণত্বের গর্বে। তাই তারা সবসময় এদের ক্ষতি চাইতেন। তার মাঝেই এ্যান্টনি সমাজের কাছে এক অপূর্ব প্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। কারোর কটূক্তি, কারোর ঈর্ষা, কারোর রোষকে গ্রাহ্য না করে আপন মনে সুখের নীড়ে বাস করতেন। জীবনের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে ঘর গড়েছিলেন তিনি সৌদামিনীকে নিয়ে। তাকে দিয়েছিলেন তার প্রাপ্য সম্মান। নিজেদের ছোট দল নিয়ে তিনি ঈশ্বরচর্চায় মগ্ন ছিলেন। গভীর সাধনায় তিনি পর্তুগীজ সাহেব থেকে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন পরিপূর্ণ এক বাঙালি মানুষে। এমন জীবনে চলার জন্য তার পুঁজি ছিল মহত্ব, উদারতা, সম্মানবোধ, জীবনের প্রতি নিবিড় প্রেম, গভীর ঈশ্বরানুরাগ এবং সৌদামিনীর প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা। সৌদামিনী তৎকালীন বাঙালি ঘরের ব্রাহ্মণ বিধবা হয়েও ভাগ্যজোরে এ্যান্টনির মত স্বামী লাভ করেছিলেন এবং পরম সুখী গৃহস্থালি উপভোগ করেছিলেন। উভয়ের মিলিত জীবন যেন নদীর স্রোতের মতোই জোয়ার ভাঁটায় বয়ে চলেছিল। (আগামীতে সমাপ্য)