# সীমান্ত # পর্ব – ১১ কলমে – অরণ্যানী
# সীমান্ত # পর্ব – ১১
কলমে – অরণ্যানী
অস্ত্রশিক্ষার মাঠে মিনু :-
মাঠে তখন পুরোদমে অস্ত্রশিক্ষা চলছে। বিজয়, মাস্টারদা ও মিনু আসতেই জবা মাস্টারদার কাছে এগিয়ে এলো।
জবা – কিগো, মাস্টারদা, সেই কখন মিনুকে ডাকতে গেছ – – – ওকে কি ঘুম থেকে তুলে আনলে নাকি? এদিকে এতো বেলা হয়ে গেল, খিদে পেয়ে গেল যে। প্র্যাকটিস দেখবে কখন?
মাস্টারদা – কেন, বাড়ি থেকে ভালো করে পেট ভরে খেয়ে আসিসনি?
জবা – সে খাবার কখন হজম হয়ে গেছে। খিদেয় পেট চুঁই চুঁই করছে।
অলোক – থাম। মাস্টারদা আগে কারটা দেখবে? ওর যখন অত তাড়া, ওরটাই দেখে নিয়ে ওকে ছেড়ে দাও।
মাস্টারদা – খিদের মধ্যে পারবে কী করে? কিরে পারবি? না বাড়ি থেকে খেয়ে আসবি?
জবা – ঠিক আছে। তুমি ততক্ষণ ওদের গুলো দেখো, আমি বাড়ি থেকে চট করে কিছু খেয়েই চলে আসছি।
জবা যখন চলে গেল সূর্য তখন মধ্য গগনে। কটকটে রোদ। নীল আকাশ, আর মধ্যে মধ্যে সাদা মেঘ। মাঠে তখনও অনেকে গলদঘর্ম হয়ে প্র্যাকটিস চালিয়ে যাচ্ছে। একটা গুঞ্জনও উঠছে – কী হবে, মাস্টারদার সামনে যদি হাতের টিপ ফসকায় বা লাফ দিতে গিয়ে পা ফসকায়।
মাস্টারদা – বিজয়, তুই তবে প্রথমে আয়।
বিজয়ের দিকে কবিতার বার বারই চোখ পড়ছিল। বিজয়েরও চোখ পড়ছিল। বিজয় চোখ সরিয়ে নিয়ে মাস্টারদার সামনে এগিয়ে এলো। কবিতার বাকি বন্ধুদের চোখ এড়ালো না, যে কবিতা বার বার বিজয়ের দিকে তাকাচ্ছে।
পতু – কী রে, কী অত দেখছিস? ও তো সেনাদলে যাবে।
কবিতা – কে? কার কথা বলছিস?
পতু – কেন, যার দিকে দেখছিস?
কবিতা – কই, কার দিকে আবার দেখলাম?
পতু – হয়েছে, আর ন্যাকাস না।
সকলে হেসে উঠলো। কবিতা ফ্যাকাসে মুখে না বোঝার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে কিছু ভাবছিল।
পদ্মা – সেনাদলে গেলে কিন্তু সরকার থেকে অনেক টাকা পাবে। যেমন মাস্টারদা পায়।
শ্যামলী – জবাও পাবে?
পদ্মা – কী জানি। পাবে নিশ্চয়ই। নাহলে যাচ্ছে কেন?
মিনু মাঠে এসে চুপচাপ অন্যদের প্র্যাকটিস দেখছিল। সকলেই এতো ব্যস্ত, মিনুকে কেউ লক্ষ্য করল না। মিনু ওদের কথাগুলোও শুনছিল। ও কবিতার দিকে এগিয়ে গেল।
মিনু – কী রে, কী ভাবছিস?
কবিতা – তুই কোথায় ছিলি এতক্ষণ? প্র্যাকটিস তো করলি না। কিছু হবে না?
মিনু – একটু দেখা না, কী কী করতে হবে। মাস্টারদা তো এখন অন্যদেরগুলো দেখছে। তোর কি মন খারাপ?
কবিতা – চিন্তা হচ্ছে।
মিনু – জানি, আমার দাদাও তো যাচ্ছে।
কবিতা – কী হয়ে গেল বল তো। দু’দিন আগেও তো এমন ছিল না।
মিনু – তুই কি বিজয়দাকে খুব ভালোবাসিস?
কবিতা ছলছল চোখে জানালো –ওকে আমার খুব ভালো লাগে। ও খুব ভালো।
মিনুরও চোখ ছলছল করে উঠল।
মিনু – জানি। দাদার জন্যে, লুল্লুর জন্যে, বিজয়দার জন্যে, তোর জন্যে, সবার জন্যে আমার খুব চিন্তা হচ্ছে।
মিনুর দু’চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।
কবিতা – কাঁদিস না। তুই কি বাড়িতে বসে বসে কাঁদছিলি?
মিনু – না, লুল্লুর শরীর খারাপ করেছিল।
কবিতা – এখন ভালো আছে?
মিনু – হ্যাঁ।
ওদিকে মাস্টারদা একে একে বিজয়, অলোক, তাপস, শ্যামল, দেবু, ওদের প্র্যাকটিস দেখছিল। সবাই মোটামুটি ঠিকই পারছে। তারপর এলো জবা। ভীষণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে হাতের টিপগুলো লাগিয়ে ফেললো। মাস্টারদা আশ্চর্য দৃষ্টিতে জবার দিকে তাকিয়ে রইল।
জবা – কী, ঠিক পারছি তো?
মাস্টারদা জবার মাথায় হাত রেখে বললো – খুব ভালো।
জবা মাস্টারদাকে প্রণাম করল।
মাস্টারদা – কী রে, প্রণাম কেন?
জবা – বাঃ, সবই তো তোমার জন্য।
মাস্টারদা – ভালো করে প্র্যাকটিস কর তোরা। যেন গ্রাম বাঁচাতে পারিস, দেশকে বাঁচাতে পারিস। একে একে বিজয়, অলোক, দেবু, তাপসরা মাস্টারদাকে ঘিরে ধরে প্রণাম করতে লাগলো।
মিনু কবিতাদের প্র্যাকটিস :-
যারা প্রথম শ্রেণীর যোদ্ধা বলে গণ্য হচ্ছে, তাদের অস্ত্রশিক্ষার পরীক্ষা নিতে নিতে বেলা বাড়ছিল। ফলে মেয়ে বউরা বাড়ি থেকে খাওয়া দাওয়া সেরে এলো। এবার মাস্টারদা ওদের পরীক্ষা নেবে। একে একে অনেককেই ডাকা হলো। প্রচুর ধৈর্যের সঙ্গে ও কখনো ভীষণ বকাঝকার মাধ্যমে তাদের অনেকেরই পরীক্ষা শেষ হলো। মেয়েগুলো অনেকে মারও খেলো মাস্টারদার হাতে অস্ত্রশিক্ষা না পারার জন্য। তাদের আবারও সন্ধ্যা পর্যন্ত প্র্যাকটিস করতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো ওদিকের মাঠে। এরপর এলো কবিতার পালা। কবিতা ভীত ও ধীর পায়ে এগিয়ে গেল।
মাস্টারদা একটা মডেলকে দেখিয়ে বললো – এটার কপালে টিপ করার চেষ্টা কর।
কবিতা ভীত ভাবে জিজ্ঞেস করল – গায়ে লাগলে হবে না?
মাস্টারদা – তুই কপালেই চেষ্টা কর না।
কবিতার মুখ শুকিয়ে গেল। একটুক্ষণ মডেলটার দিকে তাকিয়ে মনটা স্থির করার চেষ্টা করল। কবিতা দেখল, বিজয় ওর কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে আছে। বিজয় কবিতার দিকে আশ্বাসের ভঙ্গিতে তাকাল। ওর চোখের তাকানো যেন বুঝিয়ে দিল, যে তুমি পারবে। কবিতা মনে কী যেন ভরসা পেল। গুলি ছুঁড়ল। লাগলো মডেলের কপালে। বিজয়ের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো – বাঃ। মাস্টারদা হাততালি দিল।
এরপর মিনু এলো মাস্টারদার সামনে। ওর চোখ মুখ উদ্ভ্রান্ত।
মাস্টারদা – মৃন্ময়ী, প্র্যাকটিস হয়েছে?
মিনু – জানি না।
মাস্টারদা – সে কী রে! জানি না বললে চলবে কেন? সবাই কত কষ্ট করে করছে। নে, টিপ কর এই মডেলটাকে।
মৃন্ময়ী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল মডেলটার দিকে। তাকাতে তাকাতে মডেলটাকে প্রথমে জামা প্যান্ট পরা মানুষ দেখতে লাগলো।
মাস্টারদা – কী রে, কী হলো? টিপ কর।
মিনু তাকিয়েই রইলো মডেলটার দিকে।
মাস্টারদা ধমক দিয়ে বললো – তাড়াতাড়ি কর। টিপ যেন না ফসকায়।
মিনু চমকে উঠল। ও দেখল যেন ওর দাদা অলোক দাঁড়িয়ে ওটা। কখনো দেখল বিজয়দা!
মাস্টারদা চেঁচিয়ে উঠল – কী হচ্ছে?
মিনু কেঁপে উঠল। ওর মনে হলো দূর থেকে কোনো সেনা যেন ওকে টিপ করেছে। মিনু মাটিতে বসে পড়ল। সবাই অবাক হয়ে ওকে ঘিরে ধরলো।
কবিতা – কী রে, কী হয়েছে?
মিনু কাঁদতে কাঁদতে বললো – আমি পারব না – – – আমি পারব না – – – তারপর কাঁদতেই থাকল। মাস্টারদা দু’হাতে টেনে মিনুকে দাঁড় করালো। নরম গলায় বললো – কী পারবি না? টিপ করতে? ঠিক আছে, কাছেরটাই কর।
মিনু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কাঁদতে থাকল – আমি পারব না।
মাস্টারদা – কেন? কী হয়েছে? আমাকে বল। ভয় করছে? আচ্ছা ফসকালে কিছু বলবো না। নে কর। মিনু করুণ মুখে মাস্টারদার দিকে তাকিয়ে রইল।
মাস্টারদা মিনুর পিঠে হাত রেখে বললো – যেমন পারিস কর। মিনুর দাদা অলোক এগিয়ে এলো।
অলোক – কী রে, কিছু তো কর। বলছে তো কিছু বলবে না।
মিনু দাদাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। অলোক হতভম্ব। কবিতা, বিজয়, অন্যরাও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না।
মাস্টারদা – ঠিক আছে। কাঁদিস না। চুপ কর। তোকে পারতে হবে না।
অলোক – মাস্টারদা, ওর কী হবে?
ততক্ষণে মিনুর বাবাও এগিয়ে এসেছে।
বাবা – আদরে আদরে ওর মাথাটা গেছে। ওর কিছুই হবে না। ও খুকি হয়ে থাকবে সারা জীবন।
অলোক বোনের দু’হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বললো – কী রে, অস্ত্রশিক্ষা নিতে তুই ভয় পাস?
মিনু কাঁদতে কাঁদতে – হ্যাঁ।
বাবা – এখন তো দেখছি বড় মেয়ের বদলে মিনুকেই বিয়েটা দিয়ে দিলে ভালো হতো।
অলোক – আহ্, বাবা, কী যে বলো। ও সংসার করতে পারবে? কী বুদ্ধি আছে ওর?
হীরন (মিনুর বাবা) – তবে কী হবে মাস্টার? আমার ছেলেটাও থাকবে না কাছে।
মাস্টারদা – দেখা যাক। এখনও তো সময় আছে। সবাই তো অস্ত্রশিক্ষা সেছাড়া পারবেও না। ছোটরা আছে, বয়স্করা আছে, তাদেরও তো রক্ষা করতে হবে। সন্ধে হলো। আজকের মতো অস্ত্রশিক্ষা শেষ করা যাক। মিনু, কাঁদিস না। যা, বাড়ি গিয়ে দেখ্ তোর লুল্লু কেমন আছে। মাস্টারদা মিনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। অলোককে বললো – যা, ওকে বাড়ি নিয়ে যা। মিনু তখনও কাঁদছিল। কবিতা এসে ওর হাত ধরল। মিনু আস্তে আস্তে শান্ত হলো। সকলে সেদিনের মতো বাড়ির দিকে চলে গেল।
(ক্রমশ)