আত্মজা ———- ধারাবাহিক উপন্যাস অধ্যায় -১২ *** সুদেষ্ণা সিনহা
আত্মজা
———-
ধারাবাহিক উপন্যাস
অধ্যায় -১২
সুদেষ্ণা সিনহা
প্রতি শনিবার স্কুল ছুটির পর বেরিয়ে পড়ে অলোক। কোন কোন শনিবার কৃষ্ণনগর যায়। কোন কোন শনিবার যায় বহরমপুরের ভট্টাচার্য্য পাড়ায়।কোন্ শনিবারে কোথায় যাবে তার ঠিক থাকে না।যেদিন কৃষ্ণনগর যায় সেদিন বেলডাঙ্গা থেকে কলকাতার স্টেট বাস ধরে।কৃষ্ণনগর মোড়ে নেমে রিক্সা নিয়ে নেয়।
যেদিন অলোক বহরমপুর ভট্টাচার্য্য পাড়ায় যায় সেদিন বহরমপুরের যে কোন বাস ধরে নেয়। বাসট্যান্ডে নেমে ভট্টাচার্য্য পাড়া অবধি রিক্সা করে ।পাড়ার মোড়ে রিক্সা দাঁড় করে এক হাঁড়ি রসগোল্লা কেনে।যতই হোক শ্বশুরবাড়ি বলে কথা ! স্বাধীনতার ডাক্তার দেখানো থাকলে তবেই সে শ্বশুরবাড়িমুখো হয়।
অলোকদের কৃষ্ণনগরের বাড়িতে এখন মা, টিঙ্কু আর মুন্নি থাকে। আর থাকে চায়নাদি।বাবা মারা যাবার পর থেকেই চায়নাদিকে তাদের বাড়িতে রাখা হয়েছে।ভদ্রমহিলা মধ্য চল্লিশের ।স্বামী মারা গেছেন।তার ছেলেপুলেও নেই। চায়নাদির বাড়িতে ভাসুর-জা,তাদের ছেলেপুলে মিলে যৌথ পরিবার ।কিন্তু সম্পত্তির অংশীদার বলে তারা অনায়াসে ভদ্রমহিলাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।চায়নাদিকে দেখার কেউ নেই। বেচারি মরিয়া হয়ে কাজ খুঁজতে খুঁজতে একদিন অলোকদের বাড়ির দরজায় এসে উপস্থিত।
তার দুঃখের কথা শুনে মা জেদ ধরলেন অলোকের কাছে , দেখ বাবা,তোর কাছে আমার একটা আর্জি আছে।আমি ভেবেছি চায়নাকে খাওয়াপরা দিয়ে রেখে দেব আমাদের বাড়িতে।
অলোক আপত্তি করেনি। মায়ের বয়স হচ্ছে।টিঙ্কু-মুন্নির বিয়ে হয়ে গেলে শ্বশুড়বাড়ি চলে যেতে হবে। বাড়িতে একটা লোক থাকলে মায়ের নিঃসঙ্গতা কমবে। এখন টিঙ্কু বাংলা অনার্স পাশ করে বাড়িতে বসে আছে।নদীয়া জেলার এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে দু’একটা ইন্টারভিউতে কল পেয়েছিল। এখন সব জায়গায় লোক ঠিক করা থাকে।কাজেই চাকরি হয়নি।মেয়ে হয়ে তার চাকরি পাওয়াও খুব জরুরী নয়। বরং লাবণ্য থাকতে থাকতে তাকে পাত্রস্থ করতে হবে। কোন কোন রবিবার টিঙ্কুকে দেখতে আসে ছেলের বাড়ির লোকজন। কয়েকটা পাত্রপক্ষ দেখে গেছে ।’পরে জানাব’ বলে কোন উত্তর দেয়নি। অলোক জানে এই সব পাত্রপক্ষ হয়তো টিঙ্কুকে বাতিলের তালিকায় রেখেছে।
সপ্তাহান্তে গিয়ে কৃষ্ণনগরের বাড়ির বাজার-হাট সামলায় অলোক। মাসের প্রথমেই চাল,ডাল,মসলা তুলে নেয় বাজারের হোলসেল দোকান থেকে।পরে টুকটাক কোন কিছু লাগলে পাড়ার দোকান থেকে চায়নাদি নিয়ে আসে। রবিবার কৃষ্ণনগর গেলে সবজির বাজারটাও সে তুলে দেয়।মাছ,ডিম বাড়ি থেকে কেনে চায়নাদি।তাদের বাড়িতে বাবা মারা যাবার পর মা নিরামিশাষী।এই বাড়িতে মুরগীর মাংস কোনদিন ঢোকেনি।কোন কোনদিন ইচ্ছে হলে অলোক কচি পাঠার মাংস কেনে দোকান থেকে।আলাদা বাসনেতে বারান্দার এক কোণে নির্দিষ্ট উনুনে পাঠার মাংস রান্না হয়। সেদিন কলাপাতায় খায় তারা চারজন।আর খাওয়ার পর জামাকাপড় কেচে ফেলে সকলে।
চায়নাদি বলে,দরকার কি!মাসিমা খান না যখন এসব খাবার না আনাই ভাল।
মা বলেন,আমি খাব না বলে তোরাও খাবি না নাকি?
এখন স্বাধীনতা ভরা পোয়াতি। জিয়াগঞ্জের হাসপাতালে ঘন ঘন দেখাতে যেতে হয়।
মা অলোককে বলেন, তোকে এখানে আসতে হবে না এখন।তুই বউমার কাছে যা। পোয়াতি মানুষ,শরীরটরীর কেমন থাকে!
অলোক জানে স্বাধীনতার জন্য তার মা ভীষন উদ্বিগ্ন ।তিনি তাদের পাঁচ ভাইবোনের মা। একটা মানুষের শরীরে আরেকটা মানুষ পলে পলে কিভাবে বড় হচ্ছে ,সবটাই তার জানা। কত বিপদ,কত ভয়,কত উত্তেজনার পর নবজাতকের মুখ দেখা!
বহরমপুরে ভট্টাচার্য্য পাড়ার শ্বশুরবাড়িতে স্বাধীনতার যে কোন অসুবিধা হবে না,সে কথা অলোক জানে। ওদের বাড়ির সকলেই বড় আধুনিকমনস্ক।
শ্যালক,শশীকান্ত বহরমপুর ফৌজদারী কোর্টের উকিল।তিনি বড় ব্যস্ত মানুষ। সাত সকালে ঘুম থেকে না উঠতেই তাদের বাড়িতে মক্কেলরা ভিড় জমায়। তবে তিনি বাড়ির লোকেদের ব্যাপারে দায়িত্বপ্রবণ। তার স্ত্রী আর শাশুড়ি মা প্রত্যেকেই স্বাধীনতার খেয়াল রাখেন সর্বক্ষণ।
তবুও অলোকের জন্যে মন খারাপ করে স্বাধীনতার।মন খারাপ করলেই অলোককে চিঠি লেখে স্বাধীনতা অলোকের স্কুলের ঠিকানায়:
প্রিয়তমসু,
এখানে কোন কাজ নেই।বই পড়ে কতক্ষণ আর সময় কাটানো যায়! তোমার কথা সবসময় মনে পড়ে।তুমি কি খাচ্ছ,নিজের খেয়াল রাখছ কিনা!কবে আবার আমরা একসঙ্গে থাকব!সময় যে কাটে না! এদিকে তোমার বাচ্চা তো বেরোবার জন্য ছটফট করছে।একবার আসলে দেখা হয়।কবে আসবে গো?তোমার জন্য অনেক ভালবাসা।
ইতি
তোমার স্বাধীন
চিঠিটা খুলে পড়ে অলোক।একবার।দুইবার।তিনবার। সে ভেবে পায় না, মেয়েরা কি সবাই একই চরিত্রের!ভালবাসা মানেই ঘর বাঁধা!
রেবতীবাবুদের বাড়িতে তার ঘরের সামনে বারান্দায় দুটো ঘুঘু ঘর বেঁধেছে।কাঠ-কুটো,গাছের সরুডাল,ঝাঁটার কাঠি,শুকনো ঘাস,লতাপাতার সংসারে দুটো সাদা ডিম।রাত দিন এক করে তা দিচ্ছে মা ঘুঘু। আর পুরুষ ঘুঘু উড়ে গিয়ে খাবার নিয়ে আসে ঠোঁটে করে।কখনো বা পুরুষ ঘুঘু পাহারা দিচ্ছে।মা ঘুঘু যাচ্ছে খাবারের সন্ধানে। কখনো বা পাশাপাশে দুই ঘুঘু বসে থাকে দিন যাপনের ভাবনায়।
প্রথমদিন এই বাড়িতে এসেই ঘুঘুদের বাসাটা চোখে পড়েছিল অলোকের।মীনা দাঁড়িয়েছিল পাশেই।
অলোক ডেকেছিল,মীনা একটা ঝাড়ু নিয়ে আয় তো।
—-কি করবেন স্যার?
—-বাসাটা ভেঙে দেব।
—–না না স্যার,ভাঙবেন না।
—-কেন?
—–ডিম নষ্ট করবেন না স্যার।ওদের সংসার এটা।মা বলেছে যে অযথা কারোর সংসার নষ্ট করলে পাপ হয়।
মীনা গ্রামের মেয়ে।সহজ ও সরল। ছোট থেকে পরিবারে শুনে শুনে ওদের যে ধারনা তৈরি হয়,সেই ধারনাকেই ওরা মন থেকে মানে।মীনাকে আঘাত করতে চায় না অলোক।
সন্ধ্যেবেলায় গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে শাঁখ বাজে।সন্ধ্যে নেমে আসতেই গাছগুলোর মাথায় কালো অন্ধকার। রাস্তায় রাস্তায় বাল্বের আলো জ্বলে ওঠে। রেবতীবাবুদের উঠোনে তুলসী গাছের সামনে ঘোমটা মাথায় প্রদীপ জ্বালিয়ে দেয় মীনার মা।ছাদে পায়চারি করতে করতে থেমে যায় অলোক।কি অপূর্ব দৃশ্য! ডান হাতে ধরা প্রদীপের আলোয় মীনার মায়ের লাল সিঁদুরপরা মুখটাকে দুর্গার মুখ বলে মনে হয়।
সন্ধ্যেবেলায় চা আসে রেবতীবাবুর বাড়ি থেকে। বেশীরভাগ সময় চা নিয়ে আসে রেবতীবাবুর স্ত্রী নিজেই।
—-মাস্টারমশাই আপনার চা।
ঘরের ভিতর থেকে অলোক সাড়া না দেওয়া পর্যন্ত কেউ ঘরে ঢোকে না।
ঘরে থাকলে অলোক বলে,আসুন বৌদি। চা টেবিলে রেখে ত্র্যস্তপায়ে নীচে নেমে যায় সে। চা খেতে খেতে খবরের কাগজে আর একবার চোখ বুলিয়ে নেয় অলোক।
ঘন্টাখানেকের জন্যে মীনা আর তার ভাই বইখাতা নিয়ে অলোকের কাছে পড়তে আসে।বারান্দায় গোল করে গোটানো থাকে তালপাতার মাদুর।মীনা বইখাতাগুলোকে টেবিলে রেখে প্রথমে মাদুর পাতে।দুই ভাইবোন বসে মাদুরে।অলোক চৌকিতে বসে বসে দ্যাখে।
মীনাকে মাথায় কালো ফিতে জড়িয়ে কলা বিনুনি চুল বাঁধা।পাতলা গড়ন।শ্যামলা রঙের মুখেচোখে খুব শিশুসুলভ ভাব। হাত-পা লম্বাটে সরু সরু। তবুও কেমন এক আকর্ষণ অনুভব করে অলোক। চোখে চোখ পড়ে গেলে জিঞ্জেস করে, কি বই বের করেছিস?
—–অঙ্ক বই,মীনা বলে।
—–আর তুই?মীনার ভাইকে জিঞ্জেস করে অলোক।
—-কি বই বের করব স্যার?
—-তুইও অঙ্ক কর।
—ঠিক আছে স্যার।
বাল্বের হলদেটে আলো মীনার মুখে পড়ে। মেয়েটার মুখে এখনও কমনীয় আভা। গ্রামের মেয়েদের মনে সহজে পাকামি ঢোকে না। খুব মন দিয়ে অঙ্ক কষছে মীনা। পেনের দাগে খাতার পাতা ভরে উঠছে। এক পলক তাকায় অলোক। মনটা যেন কেমন করে ওঠে।জীবনটা বড়ই বৈচিত্র্যময়।
মীনা বলে,স্যার আমার হয়ে গেছে।
—– সবগুলো করলি?
—–হ্যাঁ।
—– নিয়ে আয় দেখি।
মীনা উঠে আসে।অলোক অঙ্কগুলো সব দেখে দেয়।
—-বাহ্ সব ঠিক করেছিস।
অলোকের হাত উঠে আসে মীনার পিঠে। অলোক তার ডান হাত দিয়ে চাপ দেয় মীনার পিঠে। মীনা কি কিছু বুঝতে পারছে! সঙ্কোচ বোধ করে একটু পিছিয়ে যায় মীনা। অলোক হাসে।মীনার ভাইকে বলে,দেখ্ তোর দিদিকে ভাল বলছি বলে লজ্জা পাচ্ছে কেমন!
এখন অলোকের খুব ইচ্ছে করছে মীনাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে। মনের মাঝে কেন যে তার এইরকম ইচ্ছেগুলো হয়,বুঝতে পারে না সে।মাঝে মধ্যে সে নিজের কাছেই বড় অচেনা হয়ে যায়।
অলোক মনকে বোঝায়,অলোক শান্ত হয়ে যা।এমন কিছু করবি না যাতে ভবিষ্যতে বিপদে পড়তে পারিস।তুই এখন শিক্ষক।আর মীনা তোর ছাত্রী,কন্যাসমা।
অনেকক্ষণ মীনা আর তার ছোট ভাই চলে গেছে নীচে।মীনার মা তার রাতের খাবার দিয়ে গেছে। খাবার খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে অলোক।ঘুম আসে না।আকাশে রাতের তারাগুলো মিটমিট করে জ্বলছে।জানলা দিয়ে রাতের আকাশ দেখে অলোক।
বাহ্! পরবর্তী অপেক্ষায় রইলাম।