৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ ~ শান্তনু ঘোষ পর্ব-১৫

৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ
~ শান্তনু ঘোষ
পর্ব-১৫

আগে যা ঘটেছে:
সকাল সকাল কুষ্টিয়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি দেখতে এসেছি। আজ রবিবার হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ দিন বলে কুঠিবাড়ি খোলা। সেসব দেখে এদিক ওদিক ঘুরে বেরিয়ে এসে রওনা দিয়েছি লালন ফকিরের মাজারের দিকে। শান্ত, সুন্দর সেই মাজার দেখে বেরিয়ে পড়েছি। এবার ফেরার পালা। পথে চৌড়হাস মোড়ে এসে সামনেই এক মিষ্টির দোকান চোখে পড়ল। বনফুল সুইটস। দোকানের ছবি তুলছি। তা দেখে মালিক কৌতূহলী হয়ে বলেন, সালাম আলাইকুম ভাইয়া। আপনি কে ? ছবি তুলছেন কেন ?

তারপর…

হঠাৎ এক অপরিচিত লোককে এমন ছবি তুলতে দেখে বনফুল সুইটসের মালিক বেশ আশ্চর্য হয়েছেন মনে হয়। তাই একটু সন্দেহ নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি এগিয়ে গিয়ে আমার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেই। তাতে উনি আশ্বস্ত হলেন।

মিষ্টির দোকান হলেও নানা রকমের মিষ্টি তেমন নেই। যেমন আমরা কলকাতায় পাই। অনেক দোকানেই এমনটা দেখেছি। এখানে কি মিষ্টির বেশী ভ্যারাইটি তৈরি করা হয় না! সব দোকানে অবশ্য পাতিল পাতিল দই সাজানো থাকে। ভাবছি বাংলাদেশের মানুষ মনে হয় সত্যি দই প্রেমী। দই কে সই বানিয়েছে। শুনেছি সিরাজগঞ্জে সরস্বতী পূজার সময় ঐতিহ্যবাহী দই মেলা বসে। ইচ্ছে আছে একবার যাবো। এবার অবশ্য হবে না। পরে আবার বাংলাদেশে আসলে চেষ্টা করব। তবে এর মধ্যেই কয়েকটা দোকানে দই খেয়ে দেখেছি। বলতে দ্বিধা নেই, কলকাতার পাড়ার দোকানের দই আরও অনেক বেশী সুস্বাদু লাগে।

বনফুল সুইটসের মালিক আমার কথা শুনে বলেন, আমাদের অনেক আত্মীয়স্বজনরা কলকাতায় ও আশেপাশে থাকে। এই তো কদিন আগেই আমার মাকে নিয়ে গিয়েছিলাম চিকিৎসার জন্য।

বাংলাদেশে অনেকের মুখে এই কথাগুলি আমি শুনেছি। এর পেছনে একটি খুব সাধারণ কারণ আছে।

মুক্তিযুদ্ধের আগে বাংলাদেশের এক বিরাট জনগোষ্টী আমার ঠাকুরদাদার মত রাতারাতি প্রাণ হাতে করে সপরিবারে বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। উদ্বাস্তু হয়ে একরকম পথে নামতে হয়েছিল এই কলকাতা শহরে। তারপর শুরু হয়েছিল কঠিন জীবন সংগ্রাম।

অন্যদিকে হিন্দুদের কেউ কেউ মাটি কামড়ে কোনরকমে বাংলাদেশে থেকে গিয়েছিলেন। যদিও তার সংখ্যা খুবই কম। হয়ত বাংলাদেশের ওপর তাঁদের অগাধ বিশ্বাস ও ভরসা ছিল। ছিল নিজের দেশের জন্য ভালোবাসা, নিজের ভিটের প্রতি টান। হয়ত বা অন্য কোন উপায়ও ছিল না তখন। তাই ভগবান ভরসা করে তাঁরা থেকে গিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে অনেককেই তার জন্য অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। এখনও দিচ্ছেন।

এখন তো বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা প্রায় নগণ্য পর্যায়ে নেমে এসেছে। প্রতিদিন তাঁদের ভয়ে ভয়ে কাটে, যা তাঁরা কখনই প্রকাশ করার সাহসটুকু পায় না। কোনরকম প্রতিবাদ তো দূরের কথা। তাঁদের নিজের দেশে, চৌদ্দ পুরুষের ভিটেয় যে একদিন এমন বিভাজন হবে তা তাঁরা হয়ত স্বপ্নেও ভাবেননি। অনেক হিন্দুঘরের যুবতী মেয়েদের বল প্রয়োগ করে, ভয় দেখিয়ে, ভুলিয়ে, বা প্রেমের ফাঁদে ফেলে মুসলমান ছেলেরা শাদী করে নিচ্ছে। আর শাদী করা মানেই তো ধর্মান্তকরন। বড় শহরে হয়ত এই অত্যাচার একটু কম, কিন্তু গ্রামের দিকে তা প্রবল।

এখনো অনেকে নিঃশব্দে বাংলাদেশ থেকে পালাচ্ছেন। আর অনেকেই চেষ্টা করছেন বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে যেতে। আমি অনেকের কাছ থেকে ফোন পাই। তারা খুব চেস্তে করছেন ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করার। আজকের দিনে বাংলাদেশের সাধারণ কোন হিন্দু পরিবারের যুবতী মেয়ের বাবা মা খুব চেষ্টা করে যদি ভারতের কোন হিন্দু বাঙ্গালীর ঘরের ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায়। তাতে তারা খুব নিশ্চিন্ত হতে পারেন। যদিও আপাত দৃষ্টিতে যেন সবই ঠিক চলছে মনে হবে। তাই যদি হয়, তাহলে এই অদৃশ্য চাপা ভয় কেন চেপে আছে ?

সেই কারনেই, বাংলাদেশে বসবাসকারী অনেকেই বলেন যে তাঁদের কোন না কোন আত্মীয়রা পশ্চিমবঙ্গে বাস করেন, যারা হয়ত কোন এক সময় দেশ ছেড়ে এপারে চলে এসেছেন।

শ্রী ঘোষ অবশ্য তাঁর মিষ্টি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে কেমন চলছে, কতদিন চালাতে পারবেন, এসব আর জিজ্ঞাসা করিনি।

আমার কথা শেষ হলে এক ভাঁড় দই দিতে বলি। দই খেতে খেতে দু-একটা সাধারণ প্রশ্ন করি। কিন্তু ভদ্রলোক, না জানি কোন কারণে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিচ্ছিলেন, বা দিচ্ছিলেন না। বুঝতে পারছি, উনি বেশী কথা বলতে চাইছেন না। কেন তা উনিই জানেন। দই শেষ করে দাম মিটিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। দই এর দাম অবশ্য দুটাকা কম নিলেন।

একটা টোটোতে চেপেছি। এখান থেকে আবার যাব মজমপুর। ১০ টাকা ভাড়া। ওখান থেকে বাস ধরে যাব পাবনা রূপপুর।

অনেকটা বেলা হয়ে এসেছে। মজমপুরে এসে একটু পরেই একটা বাস পেয়েছি। প্রায় ৫০ মিনিট লাগবে। বাসের ঝাঁকুনিতে তন্দ্রা আসছে। একটু ঢুলছি। ঢুলতে ঢুলতে এসে পড়েছি রূপপুর নির্মীয়মান পারমাণবিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তবুও আকাশে হাল্কা আলো আছে। ভালই হয়েছে। এখন কৌস্তভের ছুটির সময়। ওর অফিসটা পারমাণবিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিতরে।

বাস থেকে নেমে কৌস্তভকে ফোন করি। ও একটু পরেই আসছে। ওর জন্য বাইরে রাস্তায় অপেক্ষা করছি। কিন্তু মুশকিল হল যে এই নির্মীয়মান পারমাণবিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ধারে কাছে দাঁড়ানো যাবে না। দাঁড়ালেই হাতে আধুনিক মেশিনগান নিয়ে মিলিটারি এসে তাড়িয়ে দেয়।

কন্সট্রাকশন সাইট। প্রচুর ধুলো। তা উপর হাইওয়ের পাশে। সব সময় গাড়ি যাচ্ছে আর ধুলো উড়ছে।
হাটাচলা করছি। বেশ কিছু সময় পরে দেখছি একটা গাড়ি আমার কাছে থেমেছে। ভিতর থেকে কৌস্তভ ডাকছে। উঠে পড়লাম গাড়িতে। উঠে দেখি আর এক ভদ্রলোক বসে আছেন। আলাপ হল। উনি কৌস্তভের সহকর্মী আর একজন অফিসার।

ওরা ঠিক করেছে আজকের সন্ধ্যাটা আমার “সম্মানে” একটু অন্যরকম করে কাটাবে। এই “অন্যরকম করে কাটানো” আমাদের দেশে খুবই সহজ। কাছাকাছি কোন ক্লাবে বা বারে ঢুকে যাওয়া যায়। বাংলাদেশে তা একদম সহজ নয়। অন্ততঃ সাধারণ ভাবে। ইসলামিক দেশ হবার জন্য প্রকাশ্যে ফরেন লিকার বিক্রি বা পান করা মানা। ফরেন লিকার বিক্রির জন্য বিশেষ লাইসেন্স নিতে হয়, এছাড়াও আরও অনেক শর্ত আছে। তবে বিদেশীদের লিকার সেবনের জন্য বাধা নিষেধ নেই। ঠিক হয়েছে সামনেই যে রাশিয়ান কলোনি আছে সেখানেই একটা ক্লাব কাম বারে যাওয়া হবে।

এখানে বলে রাখি যে, রূপপুর পারমাণবিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র রাশিয়ার সহায়তায় তৈরি হচ্ছে। সেই কারণে প্রচুর রাশিয়ান এখন বাংলাদেশে কাজ করছেন। বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ানদের থাকার জন্য সুব্যবস্থা করেছে। তৈরি হয়েছে অনেকটা জায়গা নিয়ে বিলাসবহুল বহুতল আবাসন। সব রকম সুবিধাযুক্ত। নাম দিয়েছে গ্রিনসিটি। পদ্মার পারে এমন সুউচ্চ আবাসনে বাস করার অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে অসাধারণ ও অতীব মনোরম। ভাবছি যদি এখানে থাকা যেত !

এই গ্রিনসিটির ভিতরে আছে ক্লাব-বার। যেখানে কেবলমাত্র বিদেশীরাই প্রবেশের অনুমতি পায়। আমাদের তিনজনেরই ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট। আমরা বিদেশী। তাই বুক ফুলিয়ে ঢুকে গেছি।

কি নেওয়া যায় ভাবা হচ্ছে। কিছু ওয়াইন আর হুস্কি দেখা হল। দাম দেখে মাথা ঘুরে যাবার যোগার। একটা চলনসই ভালো হুইস্কি যার দাম আমাদের কলকাতায় হয়ত হাজার তিনেক টাকা। বাংলাদেশে তার দাম প্রায় বারো থেকে পনের হাজার বাংলাদেশী টাকা। এতে ওরা অবশ্য তেমন আশ্চর্য হয়নি। এমনটা হয় এটা ওরা জানে। আমিই হাব ভাবে বুঝিয়ে দিলাম যে, এই মুহূর্তে আমাকে এতটা “সম্মান” জানানোর তেমন কোন প্রয়োজন নেই। আমার এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা যখন বই হয়ে প্রকাশিত হবে, তখন বড় কিছু ভাবা যাবেখন। আপাতত অন্য কিছু ভাবতেই পারি। তাই আমরা ওদিকে বিশেষ নজর না দিয়ে বিয়ার নিয়ে বসে গেছি। সঙ্গে আছে দারুণ স্ন্যাক্স।

ক্লাব কাম বার জায়গাটি কিন্তু খুব সুন্দর করে সাজানো। অনেক লম্বা জায়গা। প্রচুর আরামদায়ক বসার ব্যবস্থা রয়েছে। বেশী ভিড় নেই। কিছু রাশিয়ান এদিক ওদিক বসে সোমরস পান করছে। একটা বিষয় আবার আমাকে খুব নিভৃত আনন্দ দিচ্ছে । তা হল, বারে যারা কাজ করছে, ম্যানেজার থেকে ওয়েটার, সবাই বাংলায় কথা বলছেন। আমরাও প্রাণ খুলে বাংলা ভাষায় প্রশ্ন করছি, অর্ডার দিচ্ছি। ইন্ডিয়া হলে যা প্রায় অসম্ভব হত।

বেশ গল্প চলছে। কথায় কথায় জানতে পারি যে এই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুটি ইউনিট থাকবে। প্রতিটার ১২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ক্ষমতা থাকবে। প্রয়োজনীয় জল নেওয়া হবে পদ্মা থেকে। বিশালকায় চারটি কুলিং টাওয়ার বসেছে। পারমাণবিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য যা বিশেষ আবশ্যক। এই কুলিং টাওয়ারগুলি তৈরি করছে কৌস্তভদের কোম্পানী।

কিন্তু এত বিদ্যুৎ নিয়ে কি করবে বাংলাদেশ? বিদ্যুৎ তো আর কৌটায় জমিয়ে রাখা যায় না। তৈরি হওয়ার সাথে সাথেই তাকে ব্যবহার করতে হয়। মনে হচ্ছে অনেকটাই রপ্তানি হবে। হয়ত ভারতেও আসবে সে বিদ্যুৎ। কিন্তু কলকাতার এত কাছে এত বড় একটা পারমাণবিক চুল্লি তৈরি হচ্ছে দেখে একটা আশঙ্কা মনে এল। মনে পড়ল চেরনোবিল দুর্ঘটনার কথা। ভগবান না করুন, তেমন কিছু হলে কলকাতা ও আশপাশের এলাকাগুলি ভয়ঙ্কর ক্ষতির সামনে পড়তে পারে।

এবার উঠতে হবে। অনেকক্ষণ আড্ডা হয়েছে। দাম মিটিয়ে আমরা বেরিয়ে এসেছি। গাড়ি অপেক্ষা করছে। গাড়িতে করে আমরা চলেছি কৌস্তভদের গেস্ট হাউসের দিকে।

দেখতে পাচ্ছি, এই গ্রীন সিটিকে ঘিরে আশেপাশে তৈরি হয়েছে অনেক ধরণের দোকান, গজিয়েছে নানা ধরনের ব্যবসা। মুদির দোকান, মনিহারী, জামাকাপড়, মাছমাংস, ফল-ফুলের দোকান, রেস্তরা, সেলুন, ফার্নিচার সপ, ছোটখাটো বাজার ইত্যাদি। এক বড় শিল্পকে ঘিরে ছোট ছোট রুজির ব্যবস্থা। যেমনটা ভাবা হয়েছিল সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানাকে ঘিরে। কিন্তু আজ সেখানে শুধুই শ্মশানের হাহাকার।

রাশিয়ান খদ্দের ধরার জন্য দোকানের নামগুলিও বাংলার পাশাপাশি রাশিয়ান ভাষায় লেখা হয়েছে। তাহের মুদী স্টোরস, শাহীন পান ভাণ্ডার, কামাল ফলের দোকান, এইরকম আরো অনেক দোকানে বড় বড় হরফে বাংলার সাথে রাশিয়ান ভাষায় দোকানের নাম লেখা। এমনকি দোকানদাররা চলনসই রাশিয়ান ভাষা রপ্ত করে নিয়েছে।

বেশ রাত হল গেস্ট হাউসে ফিরতে। পাবনায় আজই আমার শেষ রজনী। কাল ভোরে রওনা দেব ঢাকার উদ্দেশ্যে।
কৌস্তভ আর আমি রাতের খাবার খাচ্ছি। ও আমাকে বলে, তোর ভাগ্য ভালো।
কারণ, ওর অফিসের একটা গাড়ি আগামীকাল সকালে ঢাকায় যাবে।
আমাকে বলল, তুই ওই গাড়িতে চলে যেতে পারবি। নইলে ট্রেনে যেতে হত। আর ট্রেনে আগামীকালের জন্য কোন রিজার্ভেশন পাওয়া যাচ্ছে না।

ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *