মহাকবি কালিদাস বনাম মা কালী (ছোটগল্প) -অপর্ণা সিংহ
মহাকবি কালিদাস বনাম মা কালী (ছোটগল্প)
-অপর্ণা সিংহ
………………………………………………
অনেক দিন আগের কথা। সেই সময় আমাদের এই দেশে একজন তেজোদীপ্ত রাজা ছিলেন।রাজার নাম বিক্রমাদিত্য। নামের মতোই তিনি ছিলেন শক্তিশালী এবং বিশাল বিক্রমের অধিকারী।রাজা মশাইয়ের মা কালীর প্রতি অপার ভক্তি ও বিশ্বাস ছিল। তিনি দেশের মধ্যিখানে মা কালীর বিশাল এক মন্দির স্থাপন করেছিলেন। কথিত আছে রাজা বিক্রমাদিত্যের দেশের মা কালীও ছিলেন খুবই জাগ্রত। রাজা মশাই দেশের অপরাধীদের চিহ্নিত করার পর,সেই অপরাধীকে নিজে কখনও শাস্তি দিতেন না। সেই শাস্তি প্রদানের ভার ছিল স্বয়ং মা কালীর। যে কোন অপরাধের পরে বিচারে অপরাধীকে চিহ্নিত করে , সেই অপরাধীকে মায়ের মন্দিরে নির্দিষ্ট রাতে ঢুকিয়ে দিয়ে মন্দিরের দুয়ার বন্ধ করে দেয়া হত। পরদিন সকালে পূজারী দুয়ার খুলে দেখতে পেতেন অপরাধীর মাথা ধড় থেকে আলাদা হয়ে পরে থাকতে। স্বয়ং মা কালীই নাকি শাস্তি দিতেন অপরাধীকে তার শিরচ্ছেদ করে।
একদিন হলো কি,রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজ সভায় বহু দেশের পন্ডিতদের মধ্যে একটি তর্ক প্রতিযোগিতা চলছিল। সেখানে নানা ধরনের রাজকীয় কাজ কারবার চলছিল। যেমন রঙ বেরঙের ঝাড়বাতি জৌলুস ও বাদ্যযন্ত্রের তরঙ্গে সভাগৃহ কম্পিত । এসবের মাঝেই কেউ সুরা বা মদিরা পান করছে, কেউবা রাজভোগ পেয়ে গোগ্রাসে গিলছে, কেউবা কোন রাজ নর্তকীর সাথে রঙ্গ রসিকতা করছে। সেই মজলিসের মাঝেই পন্ডিত দেরও তর্কের বিরতি চলছিলো। অনেকটা এখনকার দিনের মিটিং এর পরে লাঞ্চ পার্টির মতো। সেই লাঞ্চ পার্টিতেই কালিদাস পণ্ডিত ধুম করে একটি বেফাঁস মন্তব্য করে ফেললেন ! তিনি সেই পন্ডিতদের এবং মহারাজা বিক্রমাদিত্য কে শুনিয়েই বললেন,
-আপনারা যাই বলুন “চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা। এইটা কিন্তু চিরন্তন সত্য!”
এতে সেই সভায় উপস্থিত পন্ডিতগণ যথেষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করলেন। কি করে একজন মহাপন্ডিত চুরির মতো ঘৃণ্য অপরাধকে মহাবিদ্যা বলেছেন! এমন কি স্বয়ং মহারাজ বিক্রমাদিত্যও কালিদাসের সাথে একমত হতে পারলেন না। ঠিক সেই সময় সভায় ভোজন পর্ব শেষে মুখ শুদ্ধির জন্য পান সুপারি মশলা সুগন্ধি সাজিয়ে অন্দরমহল থেকে রানী মা পানের থালা হাতে নিয়ে সেখানে হাজির হলেন। সেই পানের থালাটি ছিল এক কেজি ওজনের কাঁচা সোনা দিয়ে তৈরি। সভাকক্ষের পরিস্থিতি কিছুটা গম্ভীর হতে যাচ্ছিল কিন্তু অপরূপ সুন্দরী রানী মার সান্নিধ্য পেয়ে সকলেই যেন নব যৌবন লাভ করলেন। তার উপর সেই রানীর হাতের তৈরি পানখিলি! সভাসদ গণ হাসি আনন্দে পুনরায় কলরব করে উঠলেন।একে একে সকল পন্ডিতগণ থালা থেকে পান নিয়ে খেতে লাগলেন এবং নিজেদের মধ্যেই তর্কে মশগুল হয়ে পড়লেন। তারই ফাঁকে সবার অলক্ষ্যে পন্ডিত কালিদাস সেই স্বর্ণ-থালাটি তার ঝুলিতে ভরে নিলেন। সেটা সভার কেউ খেয়ালই করলো না।
পরদিন, যথারীতি সভার দ্বিতীয় দিনের সভার কার্য শুরু হল। আড্ডা,তর্ক,কাব্যরস,সুরা,রাজভোগ ভোজন সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু এরপরই পান সাজিয়ে আনতে গিয়ে রানী খেয়াল করলেন যে সেই বিশেষ স্বর্ণ-থালাটি কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।
চিন্তিত রানী’মা মহারাজাকে ডেকে কানে কানে বললেন,
-মহারাজ, আমাদের সোনার থালাটি যে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না !
মহারাজ বললেন,
-সে কি কথা? সভা কক্ষে কোথাও ফেলে আসা হয় নি তো? আচ্ছা আমি দেখছি ।
তারপর মহারাজ সভাকক্ষে সেই থালার খোঁজ করতে লাগলেন কিন্তু কোথাও সেই এক কেজি ওজনের সোনার থালাটি পাওয়া গেল না! তখনই হঠাৎ করে পন্ডিত কালিদাস বলে উঠলেন,
– মহারাজ বলেছিলাম না, চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা । দেখুন, চোর এই থালাটি চুরি করে নিয়ে গেছে কিন্তু যদি আমরা সেই চোরকে ধরতে না পারি তবে তো তার কিছুই ক্ষতি হবে না । তাহলে চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা সেটাই তো সত্যি হল।
এই কথা শুনে মহারাজ বিক্রমাদিত্য খুবই বিরক্ত এবং রাগান্বিত হলেন। সাথে সাথে শতাধিক গণক বা জ্যোতিষীদের ডেকে পাঠালেন এবং সেই থালাটি খোঁজের আদেশ দিলেন। দেশ বিদেশের বিভিন্ন জ্যোতিষীরা এসে নিজের নিজের পদ্ধতিতে সেই সোনার থালাটির খোঁজ করতে লাগলেন । কিন্তু গণকেরা গণনা করে দেখলেন যে প্রতি ক্ষেত্রে কালিদাসের দিকেই সন্দেহের তীর নির্দেশ করছে । বাটি চালান করলে বাটিটি গণক মহাশয়কে টেনে হিঁচড়ে নদীতে নেমে যায়,যদি সেইসময় কালিদাস নদীতে স্নান করে। এইভাবে তেল পড়া, জল পড়া ,ফুল পড়া সব কিছুতেই শুধু কালিদাস কেই ইঙ্গিত করছে চোর বলে। এমনকি সেই দেশের শিশুরা যখন রাস্তায় খেলা করে তখন কালিদাস কে দেখতে পেলে, তারাও হাতে থুতু দিয়ে তাতে একটা আঙ্গুল দিয়ে জোরে আঘাত করলেই সেই থুতুও ছিটকে কালিদাসের দিকেই যায়। তাহলে কালিদাসই চোর! এদিকে মহারাজ বিক্রমাদিত্যও পড়লেন মহা চিন্তায় !এবারে সভাকবির বিচার তিনি কিভাবে করবেন এই ভেবে।সভায় উপস্থিত দেশ বিদেশের পন্ডিতেরা কিন্তু মনে মনে খুশিই হলেন। তাঁরা সকলেই ভাবতে লাগলেন, এই কালিদাস কে তো আমরা তর্কে , বুদ্ধিতে কখনও হারাতে পারি না । এবার যদি কালিদাসই চোর বলে প্রমাণিত হয় তবে তো মা কালী,তার শিরচ্ছেদ অবশ্যই করবেন! সেই সাথে আমরা বারবার এইভাবে তর্কে হেরে অসম্মানিত এবং এমন লজ্জাস্কর পরিস্থিতি থেকে চিরতরে মুক্তিও পাবো। না থাকবে বাঁশ না বাজবে বাঁশি!
সেই অনুসারে মহারাজার আদেশে পরের দিন সন্ধ্যায় কালিদাসকে চুরির অপরাধে মা কালীর সেই প্রসিদ্ধ মন্দিরে বন্দী করে রাখার নির্দেশ দেওয়া হল। কালিদাস এতে মোটেও বিচলিত বা বিরক্তি প্রকাশ না করে । শুধু বললেন,
-মহারাজ, আপনি আমাকে শুধু কিছু শুকনো সিম বিচি নুন দিয়ে ভেজে একটি থলিতে ভরে দেবেন এবং সাথে কয়েকটি পানের খিলি সাজিয়ে রানীমা যদি তার সাথে পাঠিয়ে দেন তবে আমি সেই রাত্রে মা কালীর মন্দিরে আমার জীবনের শেষ রাত্রি আনন্দে কাটাতে পারব। কথা অনুসারে সিম বিচি ভেজে এবং রাণীমা পানের খিলি সাজিয়ে কালিদাসের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। দেশের তখন থমথমে পরিস্থিতি। আকাশ কালো করে মেঘ জমেছে। মা কালীর মন্দিরের আশপাশের বটবৃক্ষের সারিতে বিহঙ্গরা যেন মৌন ব্রত করছে। কোনো কলেবর নেই আজ সকাল থেকেই। তেমনি সারা দেশের প্রজাগণ চিন্তিত মনে নিজে নিজের গৃহকর্ম করছেন নিঃশব্দ ! কালিদাসকে সবাই খুব শ্রদ্ধা করতেন। সন্ধ্যা হতেই চিন্তিত মহারাজ বিক্রমাদিত্যের সৈন্যরা কালিদাসকে নিয়ে মা কালীর মন্দিরে গমন করলেন। পুরোহিত পূজার পর্ব সেরে কালিদাস কে তার ঝুলিতে সিম বিচি ভাজা এবং পানখিলি সহ মায়ের মন্দিরে ঢুকিয়ে প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দিলেন।
এদিকে কালিদাস মায়ের মন্দিরে ঢুকে, মায়ের দিকে পিছন ফেরে আসন করে বসে পড়লেন । তখনই আকাশে মেঘ গর্জন করে উঠলো।তারপর কালিদাস নিজের ঝুলি থেকে এক এক করে ভাজা সিম বিচি গুলি খেতে শুরু করলেন। রাতের এক প্রহর শেষ হয়ে দ্বিতীয় প্রহর শুরু হল।বাইরে অঝোর ধারায় বারি বর্ষণ ও মেঘেদের গর্জন চলছে। ভেতরে নিশ্চিন্তে কালিদাস রানীমার দেওয়া এক খিলি পান চিবিয়ে চিবিয়ে খুব মজা করে খেতে লাগলেন। ঠিক তখনই কালিমা, জাগ্রত হয়ে উঠলেন এবং কালিদাসকে ইঙ্গিত করে বললেন,
-বৎস ! এ তুমি কি করলে? কেন তুমি চুরির মত অপরাধ করলে ?এবার তো আমার হাতে তোমার মৃত্যু নিশ্চিত!
মা কালীর কন্ঠস্বরও কম্পিত ও বিমর্ষ লাগলো। কালিদাস মুখ ফিরে মায়ের দিকে চেয়ে মৃদু হাসি হেসে মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– না হলে যে আমি তোমাকে দেখতে পাবো না মা ! তোমাকে দেখার জন্যই তো চুরি করে তোমার মন্দিরে থাকার সুযোগ পেলাম। তবে মা,আমার কিন্তু একটা শেষ ইচ্ছা আছে। আমি তোমাকে একটা গল্প শোনাবো এবং সেই গল্প থেকে একটি প্রশ্ন করবো। সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর আমাকে তোমার হাতে থাকা খর্গ নিয়ে এক কুপে কিংবা শত কুপে কুপিয়ে আমার শিরচ্ছেদ করো তাতে আমার কোন দুঃখ হবে না। শুধু তুমি যদি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারো, তবে তুমি আমার রক্ত নিয়ে তোমার মন্দিরের দেয়ালে লিখে দিবে ,”আমি কালিদাসের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি।” কাজেই তুমি আগে আমার গল্পটি এবং আমার প্রশ্নটি শুনো এরপর অবশ্যই আমার শিরচ্ছেদ করবে মা। এরপর পন্ডিত কালিদাস মা কালি কে সেই গল্পটি শোনাতে লাগলেন।
গল্পটা হল, এক গ্রামে নরোত্তম নামে একজন গরীব কৃষক ছিলেন। তার ছিল একটি ফুটফুটে কন্যা ও একটি শিশু পুত্র। নরোত্তম এবং কৃষক পত্নী অঞ্জনা মেয়েটির নাম নীলাঞ্জনা এবং ছেলের নাম রাখলেন রাজা। একদিন হঠাৎ কোনো অজানা অসুখে কৃষকের গৃহিণী অঞ্জনা দুদিনের জ্বরে পরলোকগমন করেন। তারপর থেকে বহু কষ্টে নরোত্তম ধীরে ধীরে তার সন্তানদের বড়ো করতে লাগলেন। নরোত্তম একাই পিতা ও মাতার আদর দিয়ে নীলাঞ্জনা ও রাজাকে লালন পালন করতে লাগলেন। দিনে দিনে নীলাঞ্জনা খুব সুন্দরী একটি যুবতীতে পরিণত হলো । আশেপাশে গ্রামগুলিতে এই সুন্দরী যুবতীর সৌন্দর্য নিয়ে চর্চা হতে লাগলো । পার্শ্ববর্তী গ্রামের যুবকরা তাকে বিয়ে করার জন্য উদগ্রীব হয়ে পরস্পরের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে পরতে লাগলো। এসব কথা প্রায়ই নরোত্তমের কানে পৌঁছাতে লাগলো। সেই জন্যই নরোত্তম তাড়াহুড়ো করে দেখেশুনে তার পরমা সুন্দরী যুবতী কন্যা নীলাঞ্জনাকে পাশের গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সুপুরুষ সৎ যুবকের কাছে বিবাহ দিলেন। তারপর থেকেই নরোত্তম তার ছোট্ট ছেলেটিকে নিয়ে একাই বসবাস করতে লাগলেন। ছেলেটির বয়স তখন বারো বছর ।
একদিন নরোত্তম বাজার থেকে একটি বড় ইলিশ মাছ কিনে আনলেন । তিনি তার মাতৃহীন সন্তানদের খুব ভালোবাসেন।তাই ভালো কিছু খেতে গেলে মেয়েকে ফেলে খেতে চাইতেন না। ইলিশ মাছটি কিনেও নরোত্তমের মন কিছুতেই মেয়েকে ফেলে সেটি খেতে চাইল না। মেয়ের কথা মনে পড়তেই তিনি ছেলেকে বললেন,
– রাজু এই ইলিশ মাছটি রেখে দাও । কালকে তোমার দিদি জামাইবাবু কে নিয়ে এসে ভালোভাবে রেঁধে সবাই মিলে খাব। কি বলো?
ছেলেটিও খুশি হয়ে বলল,
-ঠিক আছে বাবা।আমি কাল তাহলে দিদি ও জামাইবাবুকে নিয়ে আসবো।
ঘুম থেকে উঠেই নরোত্তম ছেলেকে ডেকে বললেন,
-বাবা রাজু, ঘুম থেকে ওঠে পড়! দেখ সকাল হয়ে গেল যে বাবা,এবার যাও তোমার দিদি এবং জামাইবাবুকে নিয়ে এসো। তবে সাবধান, মাঠ পেরুতে গিয়ে কখনও জঙ্গলের দিকে একা যেওনা।
কথা অনুযায়ী ছেলেটি সকাল সকাল তার দিদিকে আনতে চলে গেল পাশের গ্রামে। নিজেদের গ্রামটা পেরিয়ে প্রায় দুই মাইল জায়গা হেঁটে ছেলেটিকে তার দিদির বাড়ি যেতে হবে। দিদির গ্রামে যেতে ছেলেটিকে সেই মাঠ পেরুতে হবে। সেই মাঠটির দক্ষিণ দিকে ঘেঁষে একটি উঁচু টিলা আছে। সেটি অত্যন্ত ঘন জঙ্গল ঘেরা । টিলা টির উপর থেকে একটি ঝর্ণা নেমে এসেছে সেই মাঠেই। অনেক দিন ধরেই সেই গ্রামে,ঐ জঙ্গল ও মাঠ নিয়ে লোক মুখে একটি ভয়ের কাহিনী প্রচলিত আছে । যে কারণে সেই মাঠে কেউ চাষবাস করে না অর্থাৎ মাঠের মাটি অনাবাদি । দীর্ঘ দিন, এই ভাবে পড়ে থাকায় তাতে অনেক আগাছা, ঝোপঝাড় ও জঙ্গল গজিয়েছে। সেই মাঠে কোনো গবাদিপশু চড়ে না। মাঠের মাঝে মাঝেই বেড়ে উঠেছে বাবলা, তেঁতুল অশ্বত্থ বৃক্ষ। যেখানে মাঠ ও টিলা মিশে আছে সেখানেই ঝর্ণার জলে একটি জলাশয় সৃষ্টি হয়েছে। প্রচলিত গুজব, সেই জলাশয়টি নাকি খুবই অভিশপ্ত! বয়স্কদের মতে সেই জলাশয়ে একজন দৈত্য বসবাস করেন । একেতো, দিনের বেলায়ও জলাশয়ের জলে সূর্যালোক পড়তে পারে না। তার কারণ টিলার উপর সুউচ্চ ঝাউ, দেবদারু,শাল, সেগুন, কড়ই,বট, ছাড়াও অনেক লতানো নাম না জানা উদ্ভিদের সমাবেশ। তাছাড়া মাঠের বেড়ে ওঠেছে গাছে ও ঝোঁপঝাড় । সেই দৈত্য নাকি কোনো এক ভালো দেবতাকে সেখানে বন্দী করে রেখেছেন। তাই সেই মাঠে কোন ফসল হয় না। কোনো পশু কিংবা পাখির দেখা মেলে না সেখানে! এমনকি শেয়ালের ডাক কোনো কোনো রাতে করুণ ভাবে শুনা গেলেও তা খুব কিঞ্চিৎ মাঠের দিক থেকে আসে। গ্রামের অন্য দিক গুলোতে কিন্তু ভোর হলেই পাখির কলকাকলিতে ভরে থাকে। বিভিন্ন পশু পাখি ঘুরে ফিরে। শেয়াল ডাকে রাতে। নদীতে হাঁস, পানকৌড়ির খেলা, গবাদিপশুরা দল বেঁধে চড়ে । ফুলে ফলে ভরপুর এই গ্রামে প্রজাপতি, ভ্রমরেরা উড়ে ফিরে। ব্যতিক্রম শুধু সেই মাঠ! সেখানে কেবলই নিঃশব্দতা বিরাজিত। সেই মাঠের উত্তর দিকের পথ ধরেই গ্রামবাসীরা চলাচল করে। তবে এতে গ্রামবাসীদের কোনো অসুবিধা হয়না। অনেকেই মনে করেন শুধু গুঞ্জন বা গুজব থেকেই হয়তো তাদের পূর্বপুরুষেরা এই মাঠে চাষবাস ছেড়েছেন। সেই কারণেই এত জঙ্গল ও ঝোঁপ জার । তবে এই অভিশপ্ত জলাশয় নিয়ে প্রচলিত যে,কেউ ওই জলাশয়ের দিকে গেলেই দৈত্য তাকে মেরে ফেলেন। ওই জলাশয়ের জল কাউকে ছুঁতেই দেন না । কারণ, কোন মনুষ্য যদি সেই জলাশয়ের জল ছুঁতে পারে তবে ওই দানবের মৃত্যু তৎক্ষণাৎ হবে এবং সেই সঙ্গে ভালো দেবতাও মুক্তি পাবেন। কাজেই ,এই সব গুজবের কারণেই হোক বা ভয়ের কারণেই হোক মানুষেরা সেই জলাশয়ের দিকে যান না। যেহেতু এই প্রচলিত কথাটি অনেকদিন আগের, তাই গ্রামের বয়স্করা এই গুজব যতটা বিশ্বাস করেন বা মানেন অল্প বয়সের ছেলে মেয়েরা ততটা বিস্তারিত জানে না বা আমল দেন না।
যাই হোক, সেই দিন বালকটি দুপুরের চড়া রোদে তার দিদি এবং জামাইবাবুকে নিয়ে ফিরছিল। তার দিদি ছিল অন্তঃসত্ত্বা। তার উপর রোদ এতটাই প্রখর ছিল যে হাঁটতে হাঁটতে নীলাঞ্জনার খুব জলের পিপাসা পেল। সেই মাঠের কাছে এসে দিদিকে পিপাসায় অস্থির হয়ে পড়তে দেখে বালক রাজা বললো,
-দিদি,তোমরা একটু বসো আমি জল নিয়ে আসছি। জামাইবাবু আপনি দিদিকে দেখবেন।
অতঃপর , একটি বড় শাল পাতা নিয়ে থলি বানিয়ে রাজা তার দিদির জন্য চারিদিকে জলের খোঁজ করতে লাগলো। ঠিক তখনই তার চোখে পড়ল সেই জলাশয়টি।
ছেলেটি জলের জন্য জলাশয়ের দিকে ছুটে যাচ্ছিল ঠিক তখনই পেছন থেকে দৈত্য হুংকার দিয়ে বলল,
– এই ছোকরা দাড়াও!
চিৎকার শুনে বালকটির পিছন ফিরে তাকাতেই তার মাথা কেটে মাটিতে পড়ে গেল ! অনেকক্ষণ ছেলেটিকে না ফিরতে দেখে এবার তার দিদি অস্থির হয়ে পড়ে। অগত্যা জামাইবাবুটি চললেন বালকটি এবং জলের খোঁজে। তিনিও চারিদিক ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পেলেন জলাশয়টি । জলাশয়ের দিকে এগিয়ে যেতেই তিনিও পেছন থেকে গম্ভীর গলার প্রশ্ন শুনলেন,
– এই মনুষ্য তুমি কোথায় যাচ্ছ ? জামাইবাবুটিও সেই গুরু গম্ভির গলার গর্জন শুনে হতচকিতে পিছন ফিরে তাকাতেই তারও ধড় থেকে মাথাটি আলাদা হয়ে গেল।
এদিকে তৃষ্ণায়, চিন্তায়, কষ্টে ভয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরেও যখন ভাই ও স্বামী কেউই ফিরল না তখন নীলাঞ্জনা নিজেই কাতর হয়ে জলের খোঁজে এদিক-ওদিক ছুটতে লাগলো। সেই সঙ্গে চিৎকার করে তার ভাইয়ের নাম করে ডাকতে লাগলেন । কিন্তু কোন সাড়া পেলনা। একেতো প্রচন্ড তৃষ্ণা এবং প্রখর রোদের কারণে তার চোখ দুটোই প্রায় অন্ধকার নেমে আসছিল । তার উপর এই মাঠে যেহেতু কেউ আসে না তাই তার চিৎকার কেউ শুনতে পেল না। সে ভাইয়ের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে জলের খোঁজে এগিয়ে যেতে লাগলো তখনই তার চোখের সামনে সেই জলাশয়টি পড়লো। তৃষ্ণার্থ পথিকের কাছে জলের চাইতে মূল্যবান অন্য কিছু নেই! তেমনি নীলাঞ্জনাও তৃষ্ণায় দিকবিদিক শূন্য হয়ে, জলাশয়ের দিকে দৌঁড়াতে লাগলো । তার পেছনে দৈত্যের সেই গুরু গম্বীর গলা শুনতে পেলও সে তা খেয়ালই করল না! পাত্তাও দিল না!পেছনেও তাকালো না! তার একমাত্র লক্ষ্য তখন জল।তাই নীলাঞ্জনাও কোনো দিকে না তাকিয়েই তাড়াতাড়ি গিয়ে জলাশয়ের জল অঞ্জলী ভরে পান করতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে একটা বিকট গর্জন করে দৈত্যের দেহ কালো ধোঁয়ায় পরিনত হলো! ভয়ঙ্কর আর্তনাদ করে দৈত্য শূন্যে মিলিয়ে গেল ।
তৎক্ষণাৎ সেই ভালো দেবতাও মুক্তি পেল এবং জাগ্রত হল। মেয়েটি জলাশয়ের জল পান করার পর দেখতে পেল জলাশয়ের ঠিক মাঝখানে একজন শুভ্র পোশাক পরিহিত সুপুরুষ জলের উপর দাঁড়িয়ে আছেন।
নীলাঞ্জনা জল পানের পর হন্যে হয়ে তার ভাই এবং স্বামীর খোঁজ করতে লাগলো। দেখলো সামান্য উত্তর দিকের একটি ঝোঁপের ভেতরে তার গায়ের ফতোয়া দেখা যাচ্ছে। সে সেদিকে ছুটে গিয়ে যা দেখলো তাতে তার পায়ের নিচের মাটি সরে গেল। সে দেখলো তার স্বামীর মুন্ডু হীন ধড় পড়ে রয়েছে। তার চোখ কপালে , ভয়ে,দুঃখে সে পাথর হয়ে চেয়ে রইলো! মাথা ঘুরছে,চোখে অন্ধকার! তবু সে পাগলের মতো চারিদিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। তখনই তার চোখে পড়ল খানিকটা দূরে তার ছোট ভাইটিরও মুন্ডু হীন শরীর পড়ে রয়েছে। তার সামান্য দূরেই সেই মুন্ডু দুটিও পড়ে রয়েছে। সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে মেয়েটি হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ল। কি করবে সে এখন! সময় যেন থমকে গেছে! কান্না থামিয়ে মুহূর্ত কাল পাথরের মতো চেয়ে রইল শূন্য দৃষ্টিতে। হঠাৎই মেয়েটি আকুল হয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো । তখন ভালো দেবতা এসে বলল,
– মা , তুমি কেঁদোনা! আজ এত যুগ পরে তোমার জন্যই তো আমার মুক্তি হল।আমি এখনই তোমার স্বামী এবং ভাইকে পুনঃ জীবিত করে দেবো। তুমি শুধু ওদের মাথা দুটো ধড়ে লাগিয়ে দাও।
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে তাই করল। তৎক্ষণাৎ ভালো দেবতা এসে জলাশয় থেকে কিছু জল তাদের গায়ে ছিটিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে দুজনেই পুনঃ জীবিত হয়ে উঠে বসলো। ভালো দেবতাও শূন্যে মিলিয়ে গেলেন। কিন্তু হায় ! ভাগ্যের এ কি নিদারুণ পরিহাস ! অন্তঃসত্ত্বা নীলাঞ্জনা দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে আর্তনাদ করতে করতে ভুল করে স্বামীর ধড়ে ভাইয়ের মুন্ডুটি এবং ভাইয়ের শরীরে স্বামীর মুন্ডুটি লাগিয়ে দিয়েছে।
দুজনকেই জীবিত দেখেও মেয়েটি আকুল হয়ে বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগলেন। বড় অসহায় ভাবে সে আর্তনাদ করতে লাগলো এবার। সেই ভালো দেবতাকে উদ্দেশ্য করে বিলাপ করতে লাগলেন,
-হে আমার ঈশ্বর! এখন আমার কি হবে? দয়া করুন আমাকে। আর একটি বার ফিরে আসুন। দয়া করুন, দয়া করুন ! কিন্তু ভালো দেবতা তো আর ফিরে এলেন না।
গল্পের এতটুকু বলে কালিদাস মা কালী কে প্রশ্ন করলেন,
-মা এবার তুমিই বলো,মেয়েটির কি উপায় হবে ? বলো, সে কাকে তার স্বামী ভাববে? কাকেই বা তার ভাই ? যে পূর্ণ সুপুরুষ যুবকের লোমশ শরীর যাকে সে এতদিন স্বামী বলে চিনত তার মুখশ্রী তো এখন এক বারো বছরের কিশোর বালকের। আর সেই বালক তারই আদরের ছোট ভাই! সে কি ছোট্ট ভাইটির মুখ দেখে তাকে স্বামী ভাবতে পারবেন? নাকি, এতদিন যে মুখ দেখে স্বামী বলে ভালোবেসে সহবাস করে এসেছে সেই দাড়ি গোঁফওয়াল যুবকের মুখ টিকে দেখে তাকে স্বামী ভাববে? যার শরীর বারো বছরের বালকের? নাকি তার ছোট্ট বারো বছরের বালক দেহটি দেখে তাকে তার ভাই মনে করবে? তবে, এই মেয়েটির কি হবে মা? তুমি আমার এই প্রশ্নের উত্তর দাও শুধু। যদি উত্তর দিতে পারো তবে উত্তর দাও । আমি তা জেনেই মরি! যদি না পারো তবে এখনই আমার শিরচ্ছেদ করে আমাকে মেরে ফেলো! কিন্তু এরপর আমার রক্ত দিয়ে অবশ্যই দেওয়ালে লিখে দেবে,”আমি কালিদাসের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি!”
এবার তো,মা কালী পড়লেন মহা বিপদে ! আকাশের মেঘ হঠাৎই আবারও গর্জে উঠলো । চিন্তিত চিত্তে কালিমা ভাবলেন,কি করে একজন দেবী হয়ে সামান্য একজন মানুষের কাছে হার স্বীকার করবেন! তার প্রশ্নের উত্তর না দিতে পেরে দেওয়ালে লিখে রাখবেনইবা কোন মুখে! এর কি উত্তরই বা তিনি দেবেন?
কালিদাস কিন্তু নিজের কথা বলে, মায়ের দিকে পেছন ফিরে আসন করে বসে মনের সুখে তার ঝুলি থেকে আবারও সিম বিচিগুলো বের করে চিবুতে লাগলেন। এদিকে মা কালীর তো গলদঘর্ম অবস্থা। তিনি এর কি জবাব দেবেন বুঝতে পারছেন না। সারারাত ধরে মন্দিরে পায়চারি করে গেছেন কালী মা। দৈব্য শক্তির দ্বারা কখনও মহাদেবের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন, কখনো বা বিষ্ণুর সঙ্গে আলোচনা করেছেন তো কখনো বা নারদ মুণির সঙ্গে কিন্তু কেউই কোন সদুত্তর দিতে পারেননি । এদিকে কালিদাস কখনো সিম বিচি তো কখনো রানী মায়ের দেওয়া পানির খিলি মহানন্দে চিবুচ্ছেন । মজা করে বসে বসে কালী মা কে দেখছেন আর চিবিয়ে চলেছেন।এমনি করে যে কতটা প্রহর পেরিয়ে গেছে । কখন বৃষ্টি থেমে গিয়ে ভোরের আলো ফুটে উঠল । তা তারা টেরই পাননি । কালিদাসও না মা কালীও না। ঠিক তখনই ভোরের কাক ডেকে উঠলো ,কা কা করে! পাখিদের কিচিরমিচিরে ভরে গেল চারিদিকে। পূর্ব দিকে রক্তিম আলোর রেখা ছড়িয়ে পরতেই মা কালী আবার পাথরের মূর্তি ধারণ করলেন। আকাশের রঙ ঘন নীল। চারিদিকের ঝলমলে সুন্দর পরিবেশ দেখেও প্রজারা গতরাতের ভয়াবহতার কথা ভেবেই শিউরে উঠলো! সকলেই সেই ভয়ঙ্কর পরিনীতির স্বাক্ষী হতে চাইছে। তাই সমস্ত কাজ ফেলে ছুটে এছেছে মা কালীর মন্দিরে। কিছুক্ষণ পরে পুরোহিত এলেন মন্দিরে পুজো দিতে এবং কালিদাসের শেষ কৃতকার্য সম্পন্ন করতে। সাথে রাজ্যের অগণিত জনগণ । স্বয়ং মহারাজা বিক্রমাদিত্যও তাঁর সভা সদরের নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। যতই হোক, কালিদাস পন্ডিত এতদিন তাঁর রাজসভার সভাকবি ছিলেন। আজ তাঁর অন্তিম যাত্রায় দেশের সকল জনগণও এতে যোগদান করার ইচ্ছায় এখানে উপস্থিত হয়েছেন। মন্দিরের প্রধান ফটক খুলতেই ভীড় উপচে পড়ল মন্দির চত্বরে। পুরোহিত মন্দিরের দরজা খুলতেই যে দৃশ্য তারা দেখতে পেল তার জন্য তারা কেউ প্রস্তুত ছিল না! তারা দেখল, কালিদাস তখনো দরজার দিকে মুখ করে এবং মা কালীর দিকে পেছন দিয়ে আসন করে বসে আছেন। এবং মনের সুখে ঝুলির শেষতম সিম বিচি চাবিয়ে ,রানী মা’র দেওয়া পানের শেষ খিলিটি মুখে পুরে নিয়ে চিবুতে লাগলেন। হৈচৈ এর শব্দে এবার দরজার পানে মুখ তুলে চাইলেন কালিদাস। সকলের মুখ হাঁ! হতবাগ বিষ্ময়ে হয়ে রাজা মশাই চিৎকার করে বলতে লাগলেন,
-তবে কি কালিদাস চোর নয়! (মহারাজ হুংকার করে বলতে লাগলেন) গনকরা এত বড় ভুল কি করে করলেন? 108 জন গণকের গণনায় তবে ভুল ? এত বড় প্রতারণা আমার সামনে? তাদের এত স্পর্ধা! আমি তাদের সকলকে মৃত্যুদন্ড দেব।
কালিদাস মৃদু হেসে বললেন,
-না মহারাজ, তাদের কোন ভুল নেই। আসলে চুরি তো আমিই করেছিলাম! তাই তাদের গণনাও সঠিক ছিল।
মহারাজ ততধিক বিস্মিত হয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে প্রশ্ন করলেন,
-তবে কি মা কালী আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেলেন? নাহলে তোমাকে মা কালি ……..
কথা শেষ না করেই হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে কাঁদতে লাগলেন। এতদিন যে মা তাঁকে তাঁর শাসন কার্যে সক্রিয় ভাবে পাশে থেকে দয়া করে আসছেন সে-ই মা তাইলে আজ থেকে আর তার সাথে নেই! অসহায় হয়ে মহারাজ আর্তনাদ করে কাঁদতে লাগলেন। দেশবাসীরা সকলে চিন্তিত হয়ে পরলেন। সবার চোখে জল! তখনই সবাইকে দুহাত উপরে তুলে অভয় দেখিয়ে,কালিদাস আবারো মৃদু হেসে বললেন ,
-না মহারাজ! আমাদের মা কালী এখনো খুবই জাগ্রত ! মা আমাদের সঙ্গেই আছেন, চিরদিন থাকবেন ! আসলে মা আমাকে ছাড়েননি, তিনি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিতে পাড়ায় আমার প্রাণটা বেঁচে গেল!
সকলে জয়জয়কার করতে লাগলো,’ জয় মহাকবি কালিদাসের জয়’।’ জয়কালিদাস পন্ডিতের জয়! ‘জয় পন্ডিত শ্রেষ্ঠ কালিদাসের জয়’ আর এইভাবেই কালিদাস জগতের শ্রেষ্ঠ কবি হয়ে রয়ে গেলেন যুগ যুগান্তরের জন্য ।
-অপর্ণা সিংহ। (বড়লুতমা),ধলাই, ত্রিপুরা।