#শিরোনাম-:কি নামে ওদের ডাকি? #কলমে-:মমতা শঙ্কর সিনহা(পালধী)

#শিরোনাম-:কি নামে ওদের ডাকি?
#কলমে-:মমতা শঙ্কর সিনহা(পালধী)

আমরা এত তৃতীয় লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডর নিয়ে কথা বলি।এত আলোচনা এত সমালচনা করি কিন্তু এই তৃতীয় লিঙ্গ শব্দের অন্তর্নিহিত মানে আমরা কেউ ঠিক করে অনুধাবন করতে পারি না।তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিসত্ত্বাকে আমরা অনেকেই আজও এই একবিংশ শতাব্দীর বুকে দাঁড়িও প্রায় বলতে গেলে নীচু নজরে বা ঘৃণার চোখেই দেখি।
তৃতীয় লিঙ্গ হলো এমন একটি মতবাদ যাদের এ সমাজে নারী পুরুষ কোনোটাই হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না।জীববিজ্ঞান মানুষের ক্রোমোজোম এবং যৌনতার হিসাবে তাকে নারী পুরুষ এই ভাগে ভাগ করে।এই দ্বি-যৌন চরিত্রের বাইরে আরও একটি অসাধারণ বৈচিত্র্যের মানব এ সমাজে লক্ষ্য করা যায় অন্তঃলিঙ্গ নামে পরিচিত।
তৃতীয় লিঙ্গ শব্দটি ভারত,বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ব্যবহার করা হয়।পশ্চিমা পন্ডিতরা বিশেষ করে
নৃতাত্ত্বিকবিদরা নেগেটিভ আমেরিকান এবং দক্ষিণ এশিয়ার “লিঙ্গ বৈপ্লবিক ” মানুষ সম্পর্কে লিখতে চেষ্টা করেছেন তারা আধুনিক সমাজের সভ্য সম্প্রদায়ের ভাষাতে “তৃতীয় লিঙ্গ” শব্দের যে ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তা কিছু কিছু আদিবাসী পন্ডিতদের মতে অনেকেই অনেক কিছু সাংস্কৃতিক বিষয় না বুঝেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বলে মত প্রকাশ করেছেন।
আমরা যদি বিভিন্ন দেশের পৌরাণিক ইতিহাস ঘাঁটি তাহলে এই তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে অনেক কিছুই আমরা জানতে পারি।মেসোপটেমিয়ার মানবিকতার ইতিহাসের প্রাথমিক কিছু লিখিত রেকর্ড থেকে নারীও নয় আবার পুরুষও নয় এমন ব্যক্তিসত্ত্বার কথা জানা যায়। সম্ভবত দ্বিতীয় সহস্রাব্দের এক প্রস্তরলিপির থেকে ইতিহাসবিদরা জানতে পেরেছেন যে সুমেরীয় কোনো এক কাহিনী অনুযায়ী দেবী নিনমা এমন ফ্যাশন করেছিলেন যেখানে কোন পুরুষ অঙ্গ এবং কোনো নারী অঙ্গ ছিলো না।যার জন্য তিনি Enki সমাজে রাজার আগে দাঁড়ানোর একটি অবস্থান খুঁজে পেয়েছিলেন। অ্যাট্রা-হাসিস এবং আক্কাডিয়ান পুরাণে খ্রীষ্টপূর্ব-১৭০০খ্রীষ্টাব্দে পুরুষ ও নারীদের পাশাপাশি জনসাধারণের মধ্যে আরও একটি জনজাতী বা তৃতীয় শ্রেণী প্রতিষ্ঠা করার জন্য এনকি জন্মের দেবী নিন্তুকে উপদেশ দেন,এছাড়া যারা নবজাতককে চুরি করে এবং যারা সন্তানের জন্ম দিতে অক্ষম এবং যে অভিভাবকরা যে সন্তানের লালন পালন করতে পারে না বা যে সন্তানের পালনে নিষেধ আছে সেই সকল সন্তানেরা ব্যাবিলনিয়া,সুমেরু ও আশেরিয়াতে ইস্তারের সেবায় ধর্মীয় কর্তব্য পালনকারী ব্যক্তিদেরকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিলো। তারা পবিত্র পতিতাবৃত্তি করে বা হিয়ারোডুলস হিসাবে কাজ করে,উৎসাহী নাচ-গান,নাটক রচনা করে,নারী-পুরুষের উভয়ের লিঙ্গগত বৈশিষ্ট্য তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিলো।সমসাময়িক লিঙ্গ শ্রেনীর ব্যবহার করে আধুনিক পন্ডিতরা তাদের বিভিন্ন ভাবে তাদের বর্ণনা করেছেন–যেমন–হেমমফ্রোডিট,নপুংসক, সমকামিতা,transvestite,প্রাণন্ত পুরুষ ইত্যাদি।
প্রাচীন মিশরের রাজধানী থিবেসর(এখন লুক্সোর মিশর) কাছে এক প্রাচীন মৃতপাত্রের ছায়াছবিতে তিনজন মানুষের তালিকা রয়েছে–একজন পুরুষ, একজন নারী ও একজন নপুংসক। এখানে নপুংসক ব্যক্তিদের নিন্দা করা হয় এই রকম সামান্য প্রমানই পাওয়া গেছে।
এবার আসি ভারতীয় সমাজ সভ্যতায় “তৃতীয় লিঙ্গ”/ট্রান্সজেন্ডারদের কথায়।হিন্দু দেবতা দেবাদী দেব মহাদেবকে আমরা অর্ধনারীশ্বর রূপে অর্থাত একই দেহে অর্ধেক নর ও অর্ধেক নারীর প্রকৃতি দেখতে পাই।অর্ধনারীশ্বর রূপে ডানদিকে পুরুষ ও বামদিকে নারী এই রূপে দেখা যায়।এছাড়া ভারতীয় পৌরাণিক মহাকাব্য মহাভারতে পান্ডবদের অজ্ঞতাবাসের সময় তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন বৃহন্নলার ছদ্মবেশে বিশালরাজার কন্যাকে নৃত্য ও সঙ্গীতের তালিম দিয়েছিলেন।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্মের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যবাহী গ্রন্থে তৃতীয় লিঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়।খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে ৫০০ খ্রীষ্টাব্দে ভারতীয় প্রাচীন ধর্ম শাস্ত্র বেদে তিনটি লিঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়।যেখানে একজন ব্যক্তিকে তার প্রকৃতি অনুযায়ী তিন শ্রেনীতে ভাগ করা হয়েছে। পুরুষ প্রকৃতি,নারী প্রকৃতি ও তৃতীয় প্রকৃতির মানুষ যিনি একই অঙ্গে পুরুষ ও নারী দেহবিশিষ্ঠ এবং অন্তযৌনাঙ্গের অন্তর্ভুক্ত যে বৈশিষ্ট্য গুলি শৈশব থেকেই তাদের শরীরে বিদ্যমান।
প্রাচীন ভারতে
আইন,ঔষধ,ভাষাতত্ব,চিকিৎসাস্ত্র,জ্যোতিষশাস্ত্রে এই তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।মনুস্মৃতিতে তিন লিঙ্গের জৈবিক ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়।ভারতীয় প্রাচীন ভাষাবিদ পতঞ্জলী সংস্কৃত ব্যাকরণ মহাভাষায় এই তিন লিঙ্গ সম্পর্ক বলেছেন এরা প্রাকৃতিক নিয়মেই সৃষ্ট। প্রাচীনতম তামিল ব্যাকরণে হেমমফ্রাডিটকে তৃতীয় ‘নিগূঢ়” লিঙ্গ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্রে নবগ্রহরে তিনটি পুরুষ গ্রহের মধ্যে একটি তৃতীয় লিঙ্গ বুধ,শনি ও কেতুর সাথে যুক্ত। পুরাণে তিন ধরনের দেবদেবীর গান-নাচের উল্লেখ আছে–অপ্সরা(নারী),গন্ধর্ব(পুরুষ),এবং কিন্নর(উভয় লিঙ্গ)।
খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের কাছাকাছি সময়ে প্লেটোর সিম্পোজিয়ামে অরিস্টোফেনসের সাথে জড়িত পৌরাণিকতা সম্পর্কিত তিনটি লিঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়–মহিলা,পুরুষ ও অরোজিনাস।প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে অনেকে “নপুংসক”কে তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন,যাদের নারী পুরুষ উভয়ই বোঝায়।বেশ কয়েকজন পন্ডিত যুক্তি দেন যে সেই সময় হিব্রু বাইবেল ও নিউ টেস্টামেন্টে নপুংসকে সাম্প্রতিক নিকৃষ্ট পুরুষ ও সতীত্বের রূপকের পরিবর্তিত তৃতীয় লিঙ্গের অন্তর্গত বলে ধরা হতো।
ইতিহাসবিদ ম্যাথিউ লোপারের মতে প্রাচীন মায়া সভ্যতা তৃতীয় লিঙ্গের সাথে পরিচিতি থাকতে পারে।লোপার লক্ষ্য করেছেন androgynous দেবতা মেইজ ও মায়া পুরাণের দেবী মৃত্তিকার মূর্তি ও অন্যান্য শিলালিপি যেখানে তৎকালীন শাসকেরা অন্য আরো সকল দেবদেবীর মূর্তির অঙ্গিভঙ্গি বা ছদ্দবেশ খোদাই করে রেখে ছিলেন তার সাথে তৃতীয় লিঙ্গের দুই আত্মা বিশিষ্ট বিশেষ ব্যক্তি হিলারস ও ডিভাইনারসের বিশেষ ভূমিকা থাকতে পারে।ক্লাসিক যুগের উচ্চতায় মায়া সভ্যতার শাসকরা পুরুষের মাধ্যমে নারী পরিচয়ের সামগ্রিক পরিচয় তুলে ধরেছিলেন মিশ্র পরিচ্ছদ প্রাচীন ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে নারী পুরুষের মিশ্র ভূমিকা পালন করার মাধ্যমে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে বিভিন্ন সমাজ সভ্যতা বিভিন্ন সময়ে তৃতীয়ত লিঙ্গের মানুষ ছিলেন এবং আজও তারা রয়েছেন এ সমাজ সভ্যতার বুকে ও ভবিষ্যতেও থাকবেন।অনেক অনেক যুক্তি তর্ক সংগ্রামের পর ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার অ্যালেক্স ম্যাকফার্নেলকে মাঝামাঝি লিঙ্গের ব্যক্তি হিসাবে নির্বাচিত করে জন্ম নিবন্ধনের রেকর্ডভুক্ত করা হয়েছে ও “এক্স” মার্ক দিয়ে তার পাসপোর্ট করা হয়েছে।বর্তমান সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরা আর পিছিয়ে নেই শিক্ষা,কর্মজীবনের মানচিত্র থেকে।মানবী বন্দোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর গভার্মেন্ট কলেজের প্রিন্সিপাল যিনি একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ।ভারতের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার ইনস্পেকটর পৃথিকা যশীনি।
এছাড়া ভারতের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার বিচারপতি জয়িতা মন্ডল।তাঁর বিচারপতি হওয়ার পথ মোটেও সুগম ছিলো না ।বহু বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে তিনি বিচারপতি হয়েছেন।জয়িতা মন্ডল একজন সমাজসবী।তিনি বেশকিছু বৃদ্ধাশ্রম পরিচালনা করেছেন।কিন্নর সমাজ ও রেডলাইট অঞ্চলের পরিবারগুলিকে নতুন করে বাঁচার আশা দেখিয়েছেন জয়িতা মন্ডল। তিনি তাঁর জীবনের কথা গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেন মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে টেডেক্স আয়োজিত একটি সভায়।
পদে পদে হেনস্থার শিকার এই মানুষগুলি ভারতবর্ষে ২০১৪ সালে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের ঐতিহাসিক রায় দানের ফলে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের সাথে মাথা উঁচু করে বাঁচার অধীকার লাভ করেছে।পাসপোর্ট থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স, উচ্চ শিক্ষা ,কর্মসংস্থান সর্বক্ষেত্রেই পেয়েছে নারী-পুরুষের সাথে সমান অধিকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *