আত্মজা ———– ধারাবাহিক উপন্যাস অধ্যায় -১১ সুদেষ্ণা সিনহা

আত্মজা
———–
ধারাবাহিক উপন্যাস
অধ্যায় -১১
সুদেষ্ণা সিনহা

স্বাধীনতা বাচ্চা হতে বাপের বাড়ি গেছে এখন ।বাচ্চা কিছুটা বড় হওয়া পর্যন্ত তাকে তার মায়ের কাছেই হয়তো থাকতে হবে। কয়েক মাসের ব্যাপার।এই কয় মাস অলোক স্কুলের কাছেই বাড়ি ভাড়া করে থাকবে,এটাই এখন পর্যন্ত ঠিক করা আছে।
স্কুলের বাউন্ডারির গায়ে কাজলের চায়ের দোকান।এই দোকানে চা,ডিম সিদ্ধ,কফি,চিঁড়ে,মুড়ি,চালভাজার প্যাকেট,সিগারেটের প্যাকেট –সব কিছুই পাওয়া যায়।সামনে দুটো বেঞ্চ পাতা থাকে।
স্কুলের অফ পিরিয়ডে টিচাররা এখানে এসে বসে। চায়ের অর্ডার দিয়ে জোর আড্ডা বসে।চা শেষ করে সিগারেট চায়।সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে নিয়ে হাত বাড়ায় কাজল।লাইটারটা কাজলের  দোকানের সামনেই দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে। মাস্টারমশাইরা প্রয়োজনমত লাইটারটা ফস্ করে জ্বালিয়ে সিগারেট ধরায়। সিগারেটের সুখ টানে গলায় ধোঁয়া ঢুকে নাক দিয়ে বেরিয়ে আসে গল গল করে।মাথা পরিস্কার হয়।তর্ক জমে ওঠে।
একদিন কাজলের দোকানে বসে একথা সেকথা বলতে গিয়ে অলোক বলেছিল,স্বাধীনতার স্কুলের কাছে যে বাড়িটা নিয়েছিলাম সেটা কাল ছেড়ে দিলাম।
মানববাবু বলেছিল,কেন?
—-স্বাধীনতার শরীর আর পারমিট করছে না।স্কুলের ধকল আর নিতে পারছে না।ডাক্তার রেস্টে থাকতে বলেছেন।ওকে ওর বাপের বাড়িতে রেখে আসলাম কাল।
রবীনবাবু জিঞ্জেস করলেন,তুমি কি বহরমপুর থেকে যাতায়াত করবে এখন?
—–না দাদা,এতদিন ধরে শ্বশুরবাড়িতে থাকা সম্ভব না। আর দূরত্বও কম কিছু নয়। ওভাবে যাতায়াত করতেও পারব না।দেখি এখানেই একটা বাড়ি খুঁজে নেব।
মানববাবুর সঙ্গে অলোকের খুব বন্ধুত্ব।মানববাবু বললেন,দাঁড়া খোঁজ নেব,রেবতী সরকারের বাড়ি ফাঁকা আছে কিনা। রেবতীদার বাড়িটা বেশ ভালো,খোলামেলা।আলো-হাওয়াও আছে। ওনার ছেলেমেয়েদুটোও আমাদের স্কুলে পড়ে তো।
—- খোঁজ নিয়ে জানাস তো আমাকে।

রেবতী সরকারের বাড়িটা পাওয়া গেছে।পরিবার নিয়ে রেবতী সরকার নীচের তলায় থাকেন। দোতলায় একখানা ঘর,রান্নাঘর করা আছে। মাস্টারমশাই এর প্রয়োজনে তিনি মিস্ত্রী ডেকে একটা পায়খানা বানিয়ে দিতে পারবেন। বলেছেন যে,উপরতলায় পায়খানা বানানো হয়ে গেলে  তিনি মাস্টারমশাইকে খবর পাঠাবেন।
অলোক জিঞ্জেস করেছিল,তা কত ভাড়া দিতে হবে আপনাকে?
রেবতী সরকার ভাড়ার কথায় বড্ড লজ্জা পেয়েছিলেন।বললেন,মাস্টারমশাই আপনারা গুরু।আপনাদের পায়ের ধুলো পড়বে আমার বাড়িতে,এতে আমি ধন্য।দয়া করে এর মাঝে টাকার কথা তুলবেন না। আমি কষ্ট পাব খুব ।

বাড়িটা বেশ ভালো।গ্রামের মধ্যে এরকম আলাদা ব্যবস্থার বাড়ি পাওয়া মুশকিল। আর যে কটা বাড়ি অলোক দেখেছে,সব কটাতেই বাড়িওলা আর ভাড়াটিয়াদের পায়খানা একটাই।এই সব বাড়িতে থাকতে খুব সমস্যা।
মানব বলেছিল,এক কাজ করিস তুই ওনার ছেলেকে আর মেয়েকে অঙ্ক আর ইংরেজিটা দেখিয়ে দিস।গ্রামে মাস্টারমশাই  পাওয়া যায় না।

মানবের কথামত স্কুলের কাছে  রেবতী সরকারের বাড়ীতেই থাকবে অলোক।রেবতী সরকার গ্রামের বিত্তবান লোক।গ্রামের সবাই তাকে এক ডাকে চেনে। একদিন গিয়ে অলোক কথাও বলে এসেছে। আগামী সোমবার থেকে মাস পড়ছে।  রেবতীবাবুকে বলে এসেছে সেদিন থেকেই থাকবে সে।

সোমবার খুব সকালে কৃষ্ণনগর থেকে বাস ধরেছিল অলোক। সরাসরি স্কুলে এসে  ঢুকেছিল সে।
কাজলকে শনিবার দিন বলে রেখেছিল,তোকে বলা থাকল।তোর বউকে বলে খান চারেক রুটি বানিয়ে  রাখিস তো আমার জন্য। স্কুলে টিফিনের সময় কাজল  রুটি-তরকারি দিয়ে গিয়েছিল অলোকের জন্য ।
রেবতীবাবুর স্ত্রী আগের দিন অলোককে বলেছে,মাস্টারমশাই আপনাকে রান্নাবান্নার ঝামেলা করতে হবে না।  আমাদের বাড়িতেই খেয়ে নেবেন।
সন্ধ্যেবেলায় মীনা অলোকের ঘরে চা নিয়ে এসেছিল। মীনা রেবতীবাবুর বড় মেয়ে ।অলোকদের স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে।
অলোক বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিতে নিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। রেডিওটা বাজছিল।
ঘরের বাইরে থেকে মীনা ডাকছিল,মাস্টারমশাই,মাস্টারমশাই?
—কে এ? অলোক সাড়া দিয়েছিল।
—-মা চা পাঠিয়ে দিয়েছে।
—ও আয় ঘরে।

হাত বাড়িয়ে দরজার পাশ থেকে  বাল্বটা জ্বালায় মীনা। একটা চিনা মাটির কাপে চা আর একটা কাঁসার বাটিতে মুড়ি নিয়ে ঘরে ঢোকে মীনা।
উপরের এই ঘরে একটা চৌকি পাতা ছিল আগে থেকেই। অলোক আসবে বলে রেবতীবাবু একটা চেয়ার-টেবিল দিয়েছেন ।চৌকির উপর বাড়ি থেকে আনা একটা তোষক আর চাদর পেতে নিয়েছিল অলোক।বালিশটায় নতুন ঢাকা পরিয়ে তোয়ালে দিয়ে নিয়েছিল। টেবিলে তার চশমা,ঘড়ি খুলে রাখা আছে।কিছু পড়বার বই আর জামাকাপড় স্যুটকেশে ঢোকানো আছে।এখনো বের করা হয়নি।
মীনা ঠক্ করে টেবিলের উপর চায়ের কাপ নামিয়ে অলোকের দিকে তাকাল, টেবিলে চা রাখলাম স্যার।
মীনা এইটে পড়ে।বয়স তেরোর এদিক ওদিক।তবে মেয়েটা বয়সের অনুপাতে বেশ লম্বা। হাঁটু অবধি পাতলা ছিটের ফ্রক।সরু থাই দেখা যাচ্ছে। অলোকের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মীনা চায়ের প্লেট নামিয়ে পিছনের ফ্রকটাকে টানে একবার। মীনার শীর্ণ শরীরে একটুকুও মেদ নেই। তবুও দুপাশে বুকের উঁচু অংশ পাতলা ছিটের জামা ভেদ করে যেন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অলোকের এক দৃষ্টে তাকানোতে মেয়েটার অস্বস্তি বোধ করে।
ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে এক সময় মীনা বলে,চা আর মুড়ি খেয়ে নেন স্যার। টেবিলে থাকল।
রাত্রে খাবার দিতে মীনা এল না।মীনার মা এল।আটপৌরে শাড়ি,মাথায় ঘোমটা,সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর,কপালে লাল সিঁদুরের টিপ —বেশ সুন্দরী।থালাতে রুটি আর বাটিতে তরকারী বেশ গুছিয়ে নিয়ে এল।
—–মাস্টারমশাই আপনার রাতের খাবার।
অলোকের মনে খটকা— মীনা এল না কেন? মীনা কি কোনো কথা বলে দিয়েছে তার মাকে? অলোক বোঝার চেষ্টা করল,বউদি মীনা কি করছে?পড়াশোনা নাকি?
—-না না মাস্টারমশাই ওরা দুই ভাইবোনে ঘুমিয়ে পড়েছে।ওরা খুব ভোরে ওঠে।কিছুতেই রাত জাগতে পারে না!
অলোক মনে মনে স্বস্তি পায়।যাক্ বাবা।বাঁচা গেছে।

চিরদিন নারী শরীর অলোকের মনে শিহরণ জাগায়। এই সাঁইত্রিশ পেরিয়েও আজ মীনার শরীরের দিকে তাকাতে তাকাতে কৈশোরের দিনগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল তার। তপু তার ছোটবেলাকার বন্ধু। ওর ছোট বোন ঋতুর সঙ্গে তখন প্রেম চলছিল অলোকের। সে সময় মেয়েরা বাড়ি থেকে বেরোতো না খুব একটা। ঋতু যখন স্কুলে যেত,তখনই দেখা হতো দুজনের।বিকেলবেলা তপুকে ফুটবল খেলার জন্য ডাকতে গেলে কোন কোনদিন ঋতু দরজা খুলে দিত মাথা নিচু করে,একটাও কথা বলত না।খুব কষ্ট হতো অলোকের।
সেবার  ঋতু শাড়ি পরে স্কুলের সরস্বতী ঠাকুর দেখতে যাচ্ছিল বন্ধুদের সঙ্গে। খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে। পিছন ওর থেকে হাত ধরে টেনেছিল অলোক। ঋতু সকলের মাঝে লজ্জায় লাল। কিভাবে সেই কথা পৌঁছে গিয়েছিল বাড়িতে। সন্ধ্যেবেলায় অলোকের বাবা থমথমে মুখে বসেছিলেন বৈঠকখানার চেয়ারে।লন্ঠনের আবছা আলোতে বাবাকে খুব নিষ্ঠুর দেখাচ্ছিল। বৈঠকখানা পেরিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেয়েছিল অলোক।জলদগম্ভীর স্বরে বাবা ডেকেছিলেন,এদিকে এসো।
—-আমাকে ডাকছ?কোনমতে ঢোক গিলেছিল অলোক।
—–তুমি ছাড়া আর কে আছে এখানে?
মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল অলোক।
লাঠি দিয়ে অলোককে পিটাতে পিটাতে হাঁফাচ্ছিলেন  বাবা,এই বাড়ির ছেলে হয়ে তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভদ্র বাড়ির মেয়ের হাত ধরে টেনেছ?এই তোমার শিক্ষদীক্ষা!আজ তোমাকে মেরেই ফেলব। এইরকম কুলাঙ্গার ছেলে আমার চাই না।
মা এসে দুই হাত ধরে ফেলেছিলেন বাবার।
—– ছেলেমানুষ।না বুঝে ভুল করে ফেলেছে।আর মেরো না।ছেলেটা মরে যাবে যে!
বাবা ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন,দূর হয়ে যাক্।দূর হয়ে যাক্।
সেদিনে বাবার মারের থেকে অপমানটা বেশী করে কষ্ট দিয়েছিল অলোককে।
ঠাকুমা বলতেন,স্বভাব যায় না মরলে। কথাটা ঠিক।অলোকের স্বভাবের পরিবর্তন হয়নি।সাময়িকভাবে নিজেকে সরিয়ে নিলেও কলকাতায় ইউনিভার্সিটির দিনগুলোতে আবার অলোক নাগর হয়ে উঠেছে।  উদ্দাম জীবন!উচ্ছ্বল যৌবন!বান্ধবীদের ভিড়। এক একজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা! শারীরিক উত্তাপে নিজেকে মিশিয়ে দেওয়া!আড়ালে আবডালে তখন অলোকের নাম হয়েছে–‘প্লেবয়।’
কথাটা কানে আসত অলোকের কিন্তু এসব নিয়ে তার কোন হেলদোল হতো না। নির্বিকার হয়ে সবটাই মেনে নিত সে । রুমমেট প্রদীপ বলত, এ সব বন্ধ কর অলোক।   উত্তর দিত না অলোক। কখনো বা বলত,তুই নিজের চরকায় তেল দে।আমার ব্যাপারে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না।

শেষটায় জয়িতার কাছে খুব ফেঁসে গিয়েছিল অলোক। মেয়েটা অলোকের প্রেমে হাবুডুবু!কত চিঠি!কত চোখের জল! অলোক ভাবে,মেয়েটার হাত থেকে শেষ পর্যন্ত খুব বাঁচা গেছে! যত্ত সব প্যানপ্যানানি!

ঘরের জন্য চাকরি করা বউ দরকার। সে কথা মাথায় রেখেই স্বাধীনতাকে স্ত্রী হিসাবে নির্বাচন করেছে সে। অর্থ ছাড়া জীবন অনর্থক। পদ্মপাতায় যেমন জলের ছাপ পড়ে না,তেমনি পুরুষমানুষের জীবনে প্রেম প্রেম খেলায় কোনো দাগ পড়ে না  ! তবে সংসার করতে গেলে আগে পিছে অনেক কথা ভাবতে হয়। স্বাধীনতার খেলাধুলা করা শরীরে নারীসুলভ কমনীয়তা কম।তবুও অলোক ভবিষ্যৎ সংসারের স্বচ্ছন্দতার কথা ভেবে স্বাধীনতাকে বিয়ে করেছে। বিয়ে কি সবসময় মনের মিল দেখেই করতে হবে নাকি ! (চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *