৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ ~ শান্তনু ঘোষ পর্ব-১৪
৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ
~ শান্তনু ঘোষ
পর্ব-১৪
আগে যা ঘটেছে:
আজ সকাল সকাল কুষ্টিয়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি দেখতে এসেছি। আজ রবিবার হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ দিন বলে কুঠিবাড়ি খোলা । কুঠীবাড়িটি দোতলা। বেশ সাবেকী ধাঁচে তৈরি। লাল রং করা। বাড়ির চারিদিকে সুবিশাল প্রাঙ্গণ। বাড়ির ভিতর বিভিন্ন দ্রষ্টব্য আছে। কেমন যেন কতগুলি খাপছাড়া জিনিস একই ঘরে পাশাপাশি রাখা। সেসব দেখে এদিক ওদিক ঘুরে বেরিয়ে এসে রওনা দিয়েছি লালন ফকিরের মাজারের দিকে।
তারপর…
লালন সাঁইয়ের মাজার কুঠিবাড়ি থেকে বেশিদূরে নয়। তবে একেবারে কাছেও নয়। আমি গাড়ি রিজার্ভ করে আসিনি। সাধারণ বাস – অটো – সাইকেল ভ্যান করে পাবনা থেকে এসেছি। স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে রাস্তা চিনেছি। এই ভাবে বেড়ানোর যে মজা তা সৌখিন ভ্রমণকারীদের বোঝানো যায় না। আর বোঝানোর কোন প্রয়োজনও নেই। এই ভাবে নতুন জায়গায় অতি সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলা, আলাপ-চারিতা হয়ে যায়। এ এক অন্য ভালোলাগা। অনেকদিন পর্যন্ত মনে থেকে যায়।
একটা ছোট ঘটনা মনে আছে। বাংলাদেশেই এক জায়গায় বাসস্ট্যান্ডে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হচ্ছে দেখে আমি একটু চা পানের উদ্দেশ্যে সামনেই এক চা ও পানের দোকানে এক কাপ লিকার চা দিতে বলি। এখানে তো মনে হয় চা এর দামে এরা সাম্যবাদ প্রয়োগ করেছে । সব জায়গায় এক দাম মাত্র ৬ টাকা। আর অনেকটা পরিমাণ দেয়। দোকানী আমাকে এক বড় কাপে অর্ধেক চা দিল। আমি বলি, ভাই আর একটু গরম জল ঢেলে দাও না। চা বা চিনি কিছুই তো আর বেশী দিতে হবে না। সে বিনা বাক্যব্যয়ে গরম জল ঢেলে দিল কাপে। আমিও বেশ ফু ফু দিয়ে খাচ্ছি। এমন সময় আমার বাস এসে গেল। এটা মিস করলে পরের বাস অনেক পরে। কি করি ! এখনও অনেকটা চা বাকি আছে। আমি দোকানীকে বলি চা টা কি পুরোটা খেতে পারব? বাস কতক্ষণ দাঁড়াবে? সে খুব গম্ভীর ভাবে বলল, আমি এই জন্যই কম চা দিয়েছিলাম, আপনিই তো আরো চেয়ে নিলেন। আমি শুনে খুব মজা পেয়েছি।
কুঠিবাড়ি থেকে বেরিয়ে আবার স্থানীয় মানুষদের জিজ্ঞেস করে বুঝে নিলাম কি করে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে লালন ফকিরের মাজারে যেতে হয়।
লালন ফকিরের কবর ঘিরে তৈরি হয়েছে লালন সাঁইয়ের মাজার। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ছেউড়িয়া গ্রামে আছে সেই মাজার।
এবার আমি একটা ভ্যান রিক্সায় উঠে এসে পড়েছি আলাউদ্দিন নগর। সামনেই ঢাকা-কুষ্টিয়া মহাসড়ক। রাস্তা পার হতেই সামনে একটা অটো এসে দাঁড়ালো। অটোতে আরো যাত্রী রয়েছেন। একজন নামলেন। আমি জিজ্ঞেস করি, দবীর মোল্লার গেট যাবে কি ? অটো জানালো, সে যাবে। আমি ফটাস করে উঠে পড়লাম।
দবীর মোল্লার গেট জায়গাটা ঢাকা-কুষ্টিয়া মহাসড়কের উপরেই। ওখানে নেমে আমাকে আবার কোন একটা বাহন নিয়ে যেতে হবে মাজারে।
বেশী সময় লাগলো না। অটো আমাকে দবীর মোল্লার গেটে নামিয়ে ১০ টাকা নিয়ে চলে গেল। আমিও রাস্তা পার হয়ে সামনেই একটা সাইকেল ভ্যান পেয়ে জিজ্ঞেস করি, লালন সাঁইর মাজারে যাবা ?
বলে, হ্যাঁ।
-কত ভাড়া ?
– পাঁচ টাকা ।
আমি ভাবলাম বলে কি? মাত্র পাঁচ টাকা ভাড়া আজকের দিনে পৃথিবীতে কোথাও আছে নাকি !
আছে তো বটেই। সামনেই তো দেখতে পাচ্ছি।
আমি টক করে ভ্যানে উঠে পড়ি। বলি, চল।
লোকটি আর একটু অপেক্ষা করে দেখে নিচ্ছে যদি আর দু-একজন যাত্রী পাওয়া যায়।
আর একটি স্থানীয় ছেলে এসেছে।
ভ্যান চলতে শুরু করেছে। আমি ভাবছি কতদূরে হতে পারে।
খানিকক্ষণ চলে, ভ্যান এসে দাঁড়িয়েছে লালন সাঁইয়ের মাজারের সামনে।
বেশী দূর নয়। আমি ৫ টাকা ভাড়া দিয়ে ভাবছি লোকটি কিন্তু খুব সৎ। চাইলে সে আমার থেকে ১০ টাকা নিতেই পারত। আমি নতুন লোক। ভাড়া জানি না। কিন্তু সে তা করেনি। মনে মনে শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম।
নেমেই সামনে দেখি বিশাল সাদা রঙয়ের তোরণ। গেট থেকেই সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তা সোজা চলে গেছে ভিতরে। রাস্তা গিয়ে পৌছেছে সমাধি সৌধে। সাদা সুন্দর সৌধ দেখলেই মন আরাম পায়। তার পেছনে বড় দুটো বিল্ডিং।
একটা বিল্ডিঙের নিচে দেখছি অনেক লোক জড়ো হয়েছে। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে তারা তাঁদের নানা কার্যক্রম করছেন। কেউ গান করছেন, কেউ মিটিং, কেউ বা খাওয়াদাওয়া । কয়েকজনকে সামনে পেয়েই জিজ্ঞেস করছি কি পালন করছেন এখানে আপনারা।
উত্তরে এক মহিলা এগিয়ে এলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবে এসে পাশে দাঁড়ানো এক মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোককে দেখিয়ে বলেন, ইনি আমাদের সেক্রেটারি । লোকটি কোট পরিহিত, কমলা রঙের শশ্রুশোভিত, কিন্তু গোঁফ বিহীন। ওনার এক ইচ্ছে ছিল যে সেক্রেটারির নির্বাচনে জয়ী হলে উনি সাঁইজীর মাজারে এক পূর্ণ সেবা (ভোজ ব্যবস্থা সহ) দেবেন। সেই পূর্ণ সেবা দেওয়া হয়েছে আজ।
খাওয়াদাওয়া সুন্দর ভাবে সমাপ্ত। মেনু ছিল ভাত, ইলিশ মাছ, দই, মিষ্টি। বাংলাদেশের পূর্ণ সেবা, আর তাতে ইলিশ থাকবে না, তা তো হয় না। আমার হাতে ক্যামেরা। তাতে ভিডিও রেকর্ডিং করছি। তা দেখে ভদ্রমহিলা আরো উৎসাহে বলে চলেছেন।
মূল লালন সাইয়ের মাজার জায়গাটা হয়ত খুব বেশী বড় এলাকা ছিল না। থাকার কথাও নয়। তাও আমার মনে হয় পরবর্তী কালে আশেপাশে আরও কিছু জমি যোগ করে দৈর্ঘে ও প্রস্থে স্থান-পরিধি বৃদ্ধি করা হয়েছে।
এখানে দুটি বড় বিল্ডিং তৈরি করা হয়েছে। তার মধ্যে একটিতে আছে ছোট মিউজিয়াম। টিকিট কেটে ঢুকতে হয় সেখানে। আমি আর গেলাম না। অতীতের থেকে এই মুহূর্তে বর্তমানে আমার বেশী উৎসাহ। কত লোক এসেছে বেড়াতে। আজ রবিবার, যদিও কাজের দিন। কিন্তু ২৫শে ডিসেম্বর বলে সরকারী ছুটি। হয়ত সেই কারনেই জনসমাগম কিঞ্চিৎ বেশী।
এখানে একটা কথা বলি। আজ ২৫ শে ডিসেম্বর হওয়া সত্ত্বেও কোথাও যীশু নিয়ে কোন উৎসব বা সমারোহ চোখে পরেনি। এতটা রাস্তা এলাম, কোথাও যীশুর কিচ্ছু নেই। তারিখ না দেখলে, কেউ জানতেও পারবে না আজ ২৫শে ডিসেম্বর। অথচ এই দিনে কোলকাতা বা সারা পশ্চিমবঙ্গ উৎসবে উচ্ছসিত। ওখানেও বাঙ্গালী, এখানেও বাঙ্গালী। কিন্তু জীবন-যাত্রায় কত তফাৎ!
আমি খানিক এদিক ওদিক ঘুরছি। লোকজন দেখছি। তাঁদের পোশাক, চলন, কথাবার্তা এইসব আর কি। এই টুকরো ছবিগুলো কিছু যেন নীরবে অনেক কথা জানিয়ে দেয়।
মাজারের প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে উল্টোদিকে সোজা হাঁটছি। সামনে একটু দূরে আছে বিশাল মাঠ। এখানেই লালন ফকিরের মেলা বসে। খুব বড় মেলা। মাঠে যাবার রাস্তার দুপাশে অনেক ছোট ছোট দোকানে খেলনা, একতারা, আর খাজা বিক্রি হচ্ছে। এই খাজা নাকি বিখ্যাত। আমি একপিস খেয়ে দেখলাম। তেমন আহামরি কিছু নয়। তাও বাড়ির জন্য এক প্যাকেট কিনলাম।
বেলা পড়ে আসছে। এবার ফিরতে হবে। তাই ফেরার জন্য আবার সেই পথেই এলাম। চৌড়হাস মোড়ে এসে সামনেই এক মিষ্টির দোকান চোখে পড়ল। বনফুল সুইটস। নীচে মালিকে নাম লেখা শ্রী সুব্রত ঘোষ মুনা। আমিও ঘোষ। ভাবছি এমন অদ্ভূত নাম ঘোষেদের হয় নাকি ?
জানি না সেই টানেই কিনা, দোকানের ছবি তুলছি। তা দেখে মালিক কৌতূহলী হয়ে বলেন, সালাম আলাইকুম ভাইয়া। আপনি কে ? ছবি তুলছেন কেন?
ক্রমশঃ