# পত্রসাহিত্য। # কলমে-ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
# পত্রসাহিত্য।
# কলমে-ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
আলো,
স্টেশনের টিকিট কাউন্টারে ছোট্ট খুপড়ি জানলাটায় দাঁড়িয়েছিলাম আমি। চোখদুটো খুঁজে বেড়াচ্ছিল তোকে রে আলো, আল্পনা। সেই ছোট্টবেলা থেকেই আমরা দুজন পরস্পরের বন্ধু, ভাববিনিময়ের মাধ্যম। কতদিন দেখিনা তোকে। আজকাল জানিস তো, ফেসবুকে সার্চ করলে সবাই তার কতো কতো পুরোনো বন্ধুদের খুঁজে পায়। আমিও খুঁজে পেয়েছি তেমন অনেক স্কুল কলেজের বন্ধুদের। শুধু পাইনি… আমার খুব কাছের তোকে… না, না, তোদের। পঞ্চাশ বছর আগে তুই তাকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে কোথায় যে হারিয়ে গেলি! আমার খোঁজা শুরু তখন থেকে। ছোট্ট ঐ গ্রাম্য স্টেশনের পেছন দিকে আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজে হলুদে মেশানো ফসলের ক্ষেত,টোকা মাথায় চাষীরা হাল বলদ নিয়ে মাঠে চাষ করছে। ঠিক যেন সহজপাঠের ছবি। বেঁটে বেঁটে রোগা,রোগা বলদ। ছোট ছোট পুকুর, ডোবা থেকে গামছা ছ্যাঁচা দিয়ে কুচো মাছ ধরছে আদুর গায়ের বাচ্চা ছেলেরা। ইচ্ছে করছিলো, ঐ মাঠ ভেঙে ছুটতে থাকি… এতো আলোয় ভরা মাঠ,এতো আলো চারিদিকে! তুই কোথায় রে আলো? আমার
চোখের আলো কেড়ে নিয়ে পারলি এমনভাবে চলে যেতে? এতো নিষ্ঠুর তুই তো ছিলিস না রে!
টিকিট কাউন্টারের বিক্রেতা জিজ্ঞেস করলেন কোন স্টেশনের টিকিট চাই আমার। তাই তো! কোন স্টেশন? আমি কাউন্টার থেকে সরে এলাম। তারপর শুরু হলো মনে মনে খোঁজা। আমার ভেতরে বাইরে তন্ন তন্ন করে খুঁচিয়ে বেহুলার বাসরঘরের সূচিপ্রমাণ ছিদ্রটাকে খুঁজে গেছি আমি। এক সময় ভীষণ বিরক্ত হয়ে নিজেকে ধিক্কার দিয়েছি। কী পাগলামি করছি আমি! যারা যাবার তারা তো যাবেই। ভাবতে পারছিনা কেন, থাকলে আরও ক্ষতি? ঘরের চোর সিঁদ কাটলে সহ্য হতো কী? আমি সংসার গড়ে তোলার আগেই তোরা নাগালের বাইরে চলে গেলি!!
নাঃ,শক্ত হতে হবে আমাকে। আমার হতভাগিনী মায়ের দায়িত্ব তো আমারই। মা কতবার বুঝিয়েছে, অতীত আঁকড়ে থাকতে নেই। মা পাত্র খুঁজে আমায় বিয়ে দিতে চেয়েছে। মা-ই একমাত্র সেই একজন মানুষ, যে আমায় সুখী দেখতে চেয়েছিল। জানিস আলো, আমার পুরুষমানুষে ঘেন্না ধরে গিয়েছিল। তাই মাকেও আমার সুখী করা হলো না। আমার অল্প বয়সে বিধবা মা, যে আমাকে ডানা দিয়ে আগলে বড় করেছে, আমাকে রাজরাণী রূপে দেখতে চেয়েছিলো। আমার মাথায় টকটকে সিঁদুর,আমার গয়নাভরা ঝলমলে চেহারার মুখে চুমু খেতে চেয়েছিলো। জানিস, মা আমার সাদা সিঁথি পাকাচুলের চিলুরবিলুর মাথাটার দিকে তাকিয়ে খালি দীর্ঘশ্বাস ফেলতো। সেই মাও চলে গেলো আমাকে একা করে দিয়ে কয়েক বছর আগে। আমি যে বার সরকারী চাকরি থেকে রিটায়ার করলাম।
ঘরে মন টেকে না। কাজকম্মো নেই, আত্মীয় বন্ধু কেউই নেই। মানে আমিই নিজেকে একা করে দিয়েছি। খালি রেলগাড়ি চড়ে ছোট ছোট স্টেশনে নেমে পড়ি। কার খোঁজে আলো? তোর খোঁজে নাকি? নাঃ, তুই তো আমার অনুপ্রেরণা রে! তোর কাছে আমি কৃতজ্ঞ রে সই ! তোর, না..না তোদের পাথুরে স্বার্থপরতার আঘাতেই তো আমার ভেতরের সৃজনশীলতার রুদ্ধ পাষাণকারাটা ভেঙে গেলো। বেরিয়ে এলো কতো কবিতা, প্রবন্ধ, গল্পগাথা। আমার মনের বোঝা নামানোর প্ল্যাটফর্ম পেলাম ফেসবুকে,বুঝলাম,যতই বুক ভেঙে যাক,ভাঙন চিরস্থায়ী নয়।কতো পাঠক আমার লেখাগুলো পড়লেন। প্রসংশা করলেন;দ্যাখ্ আলোরাণী, নদী এ পাড় ভাঙে ,ও পাড় গড়ে। জোয়ারের পলিমাটি তাই উর্বর, শষ্যশ্যামল করেছে আমাকে। শব্দের চাষ করি এখন আমি। ফেসবুকে আমার মনের কথা উজার করে দিই। সৃষ্টির ফসল ফলাই।পরোক্ষভাবে আমার উপকারই তো করলি তোরা। কতো বন্ধু হয়েছে এখন আমার। বীরভূম, নদীয়া, জলপাইগুড়ি,বর্ধমান। সবাই কতো আন্তরিক ভাবে ডাকে,-“বন্ধু আমার বাড়ি এসো।”– আর আমি একা নয়। তবে যে কথা কাওকে বলতে নেই, আমার সেই চরম পরাজয়ের গ্লানির কথাও কাউকে বলতে পারিনি। এখন সবাই জানবে। কিছু করার নেই। মনের ভারটাও তো নামানোর দরকার। কিছুদিন থেকেই টের পাচ্ছি, আমি অশক্ত হয়ে যাচ্ছি। দীর্ণ হয়ে যাচ্ছি বয়সের ভারে। একার সংসারটুকুও আর টানতে ইচ্ছে করেনা। বেশীক্ষণ রাস্তায় হাঁটতে কষ্ট হয়। একাকিত্বের বিষণ্নতা গ্রাস করে আমাকে। সিনেমার পর্দার মতো ভেসে ওঠে অতীত, আর তোরা…….স্মৃতিমেদুরতায় ভেসে উঠিস সেই পর্দায়। আমি এই একলা বাড়িতে আর থাকতে পারছিলাম না রে।
অবশেষে চলে এলাম একটা বৃদ্ধাশ্রমে। যেদিন এলাম, সেদিনই এক বৃদ্ধের প্রাণহীন দেহ বের করে নিয়ে যাচ্ছিল আশ্রমের কর্তৃপক্ষ। কৌতুহলবশত আমিও দাঁড়ালাম। একি? ও কে! জয়!!!! ও এখানে এলো কী করে? কে ওকে এখানে পাঠালো? কেন শেষ সময়ে ওর বাড়ির কেউ নেই? তুই কোথায় রে আলো? প্রশ্নের ঢেউ সমুদ্রের মতো আছড়ে পড়তে লাগলো মনের বেলাভূমিতে। আমার চোখে গঙ্গা মেঘনা,যমুনা বাঁধ ভাঙলো। আমার দুই গাল বেয়ে গড়িয়ে নামতে লাগলো গরম জলের স্রোত। আমার শুকনো চোখে, আমার রুক্ষ বুকেও এতো বড়ো জলাধার ছিল? মা-ই তো আমার শেষ অশ্রুবিন্দুটা নিয়ে গেছে বলে জানতাম!! আশ্রমের কোন একজন সেবিকা পরম যত্নে আমাকে জড়িয়ে ধরে পৌঁছে দিলো আমার নির্দিষ্ট ঘরে। এই নদীপারের স্নিগ্ধ আশ্রম থেকেই আমারও দেহ একদিন অন্তিম যাত্রায় যাবে জয়যাত্রার মতো। জানিনা তোরা কোথায় ছিলি,কেমন ছিলি, কেমন ছিলো তোদের সংসার। আলোর সংসারে অন্ধকার নেমেছিল কি?
আলো আমার আলো!! শেষ পর্যন্ত জিৎ তবে আমারই হলো,…..বল্! জয়ের শেষযাত্রায় আমিই ওর মুখ দেখলাম।
খুব অবসন্ন লাগছে। তোর ঠিকানা আর খুঁজতে চাইনা। এই চিঠি ছেড়ে দিলাম মুখপুস্তিকায়। তোর একদা সই —
কবিতা।