মা গো
——————————-‘মা গো’————————
শ্রীচরণেষু মা,
মা, মাগো— লিখতে বসে চোখদুটো আমার বারেবারে ভিজে যাচ্ছে। জানি না, তুমি কেমন আছ, কিভাবে আছ ; জানার প্রবল ইচ্ছে থাকলেও তোমার নিষেধাজ্ঞা অতিক্রম করে তোমার কাছে পৌঁছনোর কোনো উপায় আমার নেই। সেই যে তুমি চলে যাওয়ার সময়ে আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিলে — ” সুবু, আমি না ডাকলে আমার কাছে কখনোই আসবি না”…. সে কথা অমান্য করার সাহস আমার নেই গো মা। কিন্তু তুমি এত নিষ্ঠুর কেন? সেই ছোটবেলা থেকে তোমাকে পেয়েছি আমি কাঠিন্য আর শাসনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু কোনোদিন আমাকে কোনো অভাবের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় নি। সেই কঠিন শাসনের মাঝেও যে স্নেহের ফল্গুধারা ছিল, তাও আমি বারবার অনুভব করেছি। প্রত্যেক পরীক্ষার আগে আমার সঙ্গে রাতজাগা, আমি অসুস্থ হলে আমার জন্য চিন্তায় তোমার ঘুম না আসা, আমার শিয়রে বসে থাকা, কোনো কিছুই আমি ভুলিনি মা।
আমার এই ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে বসে বৃষ্টি দেখতে দেখতে তোমাকে এই চিঠি লিখছি। রাকা ঘুমাতে চলে গেছে অনেকক্ষণ। আমার আর ঘুম আসে না। আমার মনটা তোমার ওই ‘আপনঘরে’র একটা ছোট্ট ঘরে উঁকিঝুকি মারছে। একটা শিশু যে তার মাকে জড়িয়ে ধরতে চাইছে। তুমি তো আমায় ছেড়ে নিশ্চিন্তে বসে আছ। তোমার সুবুকে দেখতে ইচ্ছে করে না মা?
বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে তুমি তো দুহাতে আমায় আগলে রেখেছিলে। আমার ক্লাস সেভেনের সেই পিতৃহারা জীবন শুধুই মাকে ঘিরে শুরু হল। আর্থিক কষ্ট কী ছিল, কতটা ছিল, আদৌ ছিল কিনা, তাও কোনোদিন বুঝিনি। তুমি যেমন অফিস যেতে, তেমনই গেছ, আমি পড়াশোনা করতে করতে কখন যেন এত বড় হয়ে গেছি। অফিস যেতে শুরু করেছি, তোমার হাতে আমার উপার্জনের টাকা তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছি। কই, কোনোদিন তো তুমিবিহীন জীবনযাপন করতে হয়নি আমাকে! আজ কেন আমার পাশে তুমি নেই মা? তোমার অবসর গ্রহণের পরও তো তুমি আমাকে নিয়ে একটা নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপের মধ্যে ছিলে। তারপর কী হল?
মানুষের প্রৌঢ়ত্ব এলে সে তো আরও বেশি আপনজনের নির্ভরতায় থাকতে চায়, কিন্তু তুমি কেন এমনি করে আমাকে পর করে দিলে?
যেদিন আমি রাকার কথা তোমাকে বললাম, আমি বোধহয় খেয়াল করে দেখিনি তোমার চোখে, কোনো অস্বস্তির কালো মেঘ! তখন আমি এক অন্য রঙিন জগতের আকর্ষণে ডুবেছিলাম। তাই তোমার মধ্যে পরিবর্তনটা আমার চোখে পড়েনি। তুমি শান্ত হয়ে রাকার সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছ, নিজের হাতে বিয়ের কেনাকাটা করেছ, নিজের হাতে রাকাকে বরণ করে স্বাগত জানিয়েছ। তাই আমি তোমার ভিতরের অস্থিরতাকে বুঝতে পারিনি।
কখন যে তুমি ‘আপনঘরে’র সঙ্গে যোগাযোগ করেছ, সেখানে চলে যাওয়ার জন্য সব ব্যবস্থা করে ফেলেছ, আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি মা। আমার অনুপস্থিতিতে রাকা কী কখনো তোমায় অসম্মান করেছে? মাগো, কেন তোমার আমাকে ছেড়ে বৃদ্ধাবাসে চলে যেতে হল? আমি তো কখনোই চাইনি তোমাকে ছেড়ে থাকতে?
যেদিন তুমি আমাকে ডেকে তোমার অমোঘ নির্দেশ শোনালে— “সুবু, আমি তোমাদের সংসার থেকে চলে যাচ্ছি, এবার তোমাদের দায়ভার নিজেরাই কাঁধে নাও”—- সেদিন আমার মাথায় বাজ ভেঙে পড়েছিল। এ সংবাদ আমার কাছে অকল্পনীয়। তাই আমি তোমাকে বারবার এর কারণ জিজ্ঞেস করেছিলাম। তুমি বলেছিলে, ” এবার আমাকে নিজের পথে চলতে হবে, একা চলতে হবে”—আমার সব অন্ধকার হয়ে এসেছিল। ছেলেমানুষের মত কেঁদেছিলাম। তুমি তোমার সেই শান্ত কাঠিন্য নিয়ে উঠে পড়েছিলে। আমি তখন লক্ষ্য করিনি যে এ ব্যাপারে রাকা কোনো বক্তব্য রাখেনি। পরে অবশ্য একথা ভেবেছি, কিন্তু আমিও তো তোমারই ছেলে, এক নীরব ঔদাসীন্যে তোমাকে যেতে দিয়েছি।
আর তারপর? আমার জীবনের সব আলোগুলো যেন নিভে গেছে। আমি মনে মনে অপরাধবোধে ভুগতে থেকেছি। তুমিময় আমার জীবন তুমিহীন হয়ে চলতে থেকেছে, কারোর কোনো অসুবিধা হয় নি। আজ বৃষ্টির মধ্যে শৈশব-কৈশোরের নানা মুহূর্তের মধ্য দিয়ে যেন আমি হেঁটে বেড়াচ্ছি, আমার সেই মা-কে নিয়ে। কিন্তু আমার সেই মা যে আমাকে ছেড়ে এত সহজে চলে যেতে পারে, তা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। তাই তো আরামদায়ক বেডরুমের ওম ছেড়ে এই ব্যালকনিতে বসে তোমাকে চিঠি লিখছি। মা গো, আমার অপরাধ কী ছিল? রাকাকে বিয়ে করা কী তোমার পছন্দ ছিল না? কই বলনি তো কখনো? নাহলে বিয়ের পনেরো দিনের মাথায় তুমি নিষ্ঠুরের মত আমাকে ছেড়ে চলে গেলে কেন? আমি তো সবসময়ই ভাবতাম, মায়ের বৃদ্ধ বয়সে আমি থাকব হাল ধরে, বরাভয়ের মত সব কষ্টকে দূরে সরিয়ে দেব। শারীরিক কোনো প্রতিকূলতাকে তোমার কাছে ঘেঁষতে দেব না। কোথায় সেই চিন্তা গুলো হারিয়ে গেল?
মা গো, তুমি কেমন আছ তোমার সুবুকে ছেড়ে? তোমার শরীর খারাপ হলে কে তোমাকে দেখবে, তোমার অসুবিধা হলে, কে তোমাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরবে? আমার টাকার প্রত্যাশা তুমি কর না আমি জানি, কিন্তু আমি যে তোমার জন্য সবকিছু করতে চাই। তোমার ঘরে আমি কাউকে হাত দিতে দিই না, তোমার তুলসীগাছে আমি রোজ জল দিই। তাও ওই ‘আপনঘর’ তোমার কাছে বেশি আপন হল? আমার ভালোবাসার কোনো দাম নেই তোমার কাছে? আমি যে তোমাকে ছেড়ে ভালো নেই গো মা। কিন্তু ছোট থেকে তোমার সব নিষেধ শুনতে অভ্যস্ত আমি কিছুতেই তোমার কাছে দৌড়ে যেতে পারিনা। আমার সমস্ত অন্তরাত্মা তোমাকে চাইছে, তোমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে তোমার নিশ্চিন্ত কোলটায় মাথা রেখে শুতে ইচ্ছে করছে! ও মা, এসো না আমার কাছে– আমি তোমার কোনো অসুবিধা হতে দেব না। আর দূরে সরে থেকো না গো, মা আমার!!
তোমার সুবু