সম্পাদকের কলমে গীতশ্রী সিনহা

সম্পাদকীয় ——-

এই সংখ্যাটি ইতিহাস বাহক সংখ্যা মনে করি। সাহিত্যের প্রাঙ্গণে পত্র সাহিত্যের একটা বড় জায়গা আছে। আজ আমাদের কাছে লুপ্তপ্রায়। ইন্টারনেটের দৌলতে।
আজকের সম্পাদকীয় কলমে আছেন সুদেষ্ণা সিনহা। প্রায় প্রথম পর্ব থেকে একসাথে পথ চলছেন দিনাজপুর ডেইলি ওয়েবসাইট ম্যাগাজিন বিনোদন বিভাগীয় পোস্টের সাথে।
আমি দুঃখিত, পর পর অনুষ্ঠান, ঠান্ডা গরম অনিয়মের শিকার হয়েছি। আর একটা কথা, এই সংখ্যায় অরণ্যানী অরণ্যানী আমাকে একান্তভাবে সাহায্যের হাত এগিয়ে দিয়েছে।
ধন্যবাদ না জানিয়ে বলি, তোরা এইভাবেই পাশে থাকিস রে।

কাদম্বরীদেবীকে না পাঠানো চিঠি
সুদেষ্ণা সিনহা

কাদম্বরীদেবী ,
আপনাকে পত্র লেখার সাধ বহুদিনের।খুব জানতে ইচ্ছে করে শতাধিক বর্ষ পূর্বের সেই বৈশাখী রাতে কি এমন হল যে পরাজিত সৈনিকের মতো মৃত্যুকেই বেছে নিলেন আপনি?কাপড়ওয়ালার কাছ থেকে আফিমের বড়িগুলো কিনে সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন গয়নার বাক্সের এক কোণে।সেদিন সরোজিনী জাহাজের উদ্বোধন উপলক্ষে অনুষ্ঠান -আপনার স্বামী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কথা দিয়েছিলেন সন্ধ্যেবেলায় নিজে এসে আপনাকে নিয়ে যাবেন সেই অনুষ্ঠানে।আপনি বিশ্বাস করেছিলেন ।মনে মনে বেশ আনন্দ ও পেয়েছিলেন স্বামী এবার গুরুত্ব দিচ্ছেন আপনাকে।দীর্ঘদিনের অসুখের পর মনটা বেশ ফুরফুরে।বেশ যত্ন করে সাজলেন – পরণে গাঢ় নীল নয়নসুখ সিল্কের শাড়ি,সযত্নে বাঁধা খোঁপায় বেল ফুলের মালা,চোখে কাজলের ছোঁয়া ।কিন্তু সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হতে চলল,আপনার স্বামী এলেন না।আপনি বেশ বুঝতে পারলেন প্রতিবার যেমনটি হয় তেমনটিই হয়েছে আপনাকে ছাড়াই সকলে আমোদে আহ্লাদে মেতেছে।
কি যে হল আপনার সেদিন! দিনে দিনে জমানো অভিমান আর কষ্টের হিমবাহে ফাটল ধরল ।অথচ এই আপনিই ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের কত তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহ্য করেছেন মুখ বুঁজে।
ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য বউদের মতো সুন্দরী ছিলেন না আপনি, লোকে এ নিয়ে বহু কথা বলেছে ,আপনি শোনেননি।আপনি নিঃসন্তান,লোকে সে কথা নিয়ে কানাঘুষা করেছে আপনি কান দেন নি।বড়দিদি স্বর্ণকুমারীদেবীর কন্যা উর্মিলা আপনার খুব ন্যাওটা ছিল।সিঁড়ি থেকে পড়ে সে যখন মারা গেল ঠাকুর-চাকর থেকে বাড়ির মহিলামহল পর্যন্ত আপনাকে আঁটকুড়ি বলেছে, আপনার মনে মনে রক্তক্ষরণ হয়েছে তবুও আপনি একটি কথাও বলেননি।
আপনার জা জ্ঞানদাসুন্দরীদেবী আপনাকে কোনোদিনই মেনে নিতে পারেননি।নিজের আধুনিকতা নিয়ে তাঁর প্রচ্ছন্ন অহঙ্কার ছিল। তিনি এও ভাবতেন যে আপনি রূপে-গুণে-সামাজিক প্রতিপত্তি-শিক্ষা-দীক্ষায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী হওয়ার উপযুক্ত নন। প্রায়ই তিনি বলতেন,”নতুনের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল….স্ত্রী যদি শিক্ষাদীক্ষায় এতটাই নিচু হয়,সেই স্ত্রী নিয়ে ঘর করা যায় হয়তো সুখী হওয়া যায় না।”
তিনি কি জানতেন না কি অসাধারণ ছিল আপনার রুচিবোধ,সৌন্দর্যবোধ আর সাহিত্যজ্ঞান?একটা সময় ঠাকুরবাড়ির মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন আপনি।স্বামীর সঙ্গে গড়ের মাঠে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে এসেছেন।বালক রবীন্দ্রনাথের সাথী,কথাবলার সঙ্গী আর সাহিত্যের বড়ো সমালোচক ছিলেন আপনি। কবি বিহারীলালকে মুগ্ধ করেছিলেন আপনি নিজের আচরণে। অসম্ভব সুন্দর গান গাইতেন আপনি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের “অলীকবাবু ” নাটকে,”নায়িকার চরিত্রে আপনার সপ্রতিভ উপস্থিতি সকলের মন জয় করে নিয়েছিল।নিতান্ত নিঃসঙ্গতা যাতে গ্রাস না করে সেজন্য তেতলার ছাদে গড়ে তুলেছিলেন ফুলের বাগান -নন্দন কানন।চামেলি,গন্ধরাজ,রজণীগন্ধা,করবী,দোলোনচাঁপা হরেকরকম ফুল,সেই সাথে হরেকরকম পাখি।ঠাকুরবাড়ির চেহারাটাই বদলে দিলেন আপনি।নন্দনকাননে বসত গান ও সাহিত্যের পরিপাটি আসর।বাইরে থেকে আসতেন অক্ষয় চৌধুরী,তাঁর স্ত্রী শরৎকুমারী,মাঝে মাঝে কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীও।
ঠাকুরবাড়ির বদ্ধ আবহাওয়ায় আপনার শেষ ভরসা ছিল রবি -আপনাদের মনের মিলটা ছিল অনেক বেশী,আপনারা একে অপরকে বুঝতেন ও অনেক বেশী।তখন বাতাসে ভাসছে অনেক কথা ,সবচেয়ে জোরালো কথা – রবির সাথে আপনার নাকি প্রেম। নর-নারীর সব সম্পর্কই যে প্রেম নয়,উনবিংশ শতাব্দীর নারী হয়ে সেকথা বোঝাতে পারেননি আপনি। সব সত্যটুকু প্রকাশের কতটুকুই বা স্পর্ধা দেখানো যেত সেই যুগে?
ভারতী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখলেন,
আর একজন যে আমার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল,
তাহাকে মনে পড়ে।
লেখাটি প্রকাশের পরই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশে ১৮৮৩র ৯ই ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথের বিবাহ স্থির হল খুলনার ভবতারিণীর সাথে।
গানে,সুরে,ছন্দে,নাটকে,গল্পে,কবিতায় রবীন্দ্রনাথ তখন সাহিত্যাকাশে খ্যাতির চূড়ায়।একদিন তাঁর ঘর গুছাতে গিয়ে আপনি খুঁজে পেলেন একটি অসমাপ্ত কবিতার দুটো পংক্তি :
হেথা হতে যাও পুরাতন!
হেথায় নতুনের খেলা আরম্ভ হয়েছে।

অভিমানে,বিষন্নতায় ভরে উঠল আপনার মন।এর সাথে যুক্ত হল স্বামীর উদাসীনতা অতিরিক্ত কর্মব্যস্ততা।অনেক বিষন্নতা একত্রে জমাট বেঁধে কি সেদিন মৃত্যুচিন্তা এনেছিল আপনার মনে ?
আমি বলব আপনি সেদিন ভুল করেছিলেন ।আপনার রবি আপনাকে দেবীর আসনে বসিয়েছিলেন।মৃত্যুর অনেকদিন পরেও তিনি আপনার অভাব অনুভব করতেন। শৈশব সঙ্গীতের
উৎসর্গপত্রে লেখা আছে -বহুকাল হইল ,তোমার কাছে বসিয়াই
লিখিতাম,তোমাকেই শুনাইতাম।তুমি যেখানেই থাক না কেন,এ লেখাগুলি তোমার চোখে পড়িবেই।
ভালো থাকবেন।
ইতি
সুদেষ্ণা সিনহা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *