বন্ধু ✒️✒️ কলমে – সুচেতনা ভট্টাচার্য্য
প্রিয় অনুভবদা,
চিঠি লেখার অভ্যাস কিংবা তাগিদ একাবিংশ শতকে পৌঁছে আমরা কেউই আর বোধ করি না। তাহলে তুমি হয়তো ভাববে প্রায় দেড় বছর পর আমি কোনো ফোন অথবা হোয়াটস্ এ্যাপে যোগাযোগ না করে তোমায় হঠাৎ চিঠি লিখে সেটা সুদূর ক্যানাডা অবধি পাঠাতে চাই কেন? চিঠি লেখার পরম্পরাকে যেভাবে আমাদের বিশ্ব একটি অতীতের বালু স্তম্ভের মত জ্ঞান করেছে, সে ভাবেই এত বছর পর আমাদের বন্ধুত্বকে তুমি এখন হয়তো একই দৃষ্টিতে দেখবে। তার রঙ ফিকে হয়েও, সম্পূর্ন মুছে যায়নি। এক একটি বালি কণার মতই জমে, সে নিয়েছে স্মৃতি বিস্মৃতির আড়ালে একটি ছায়া রূপ। তাকে আর একবার ফিরে দেখতে, হয়তো শুধুমাত্র নিজের জন্যই, মধ্যরাতে মহানগরীর স্তব্ধতায় বাড়ির ছাদে বসে এই প্রকল্প নিলাম।
ছাদে আমি আর এখন উঠি না তাও প্রায় এক বছর হতে চলেছে। তবুও এই ছাদের শুষ্ক মাটিতে বসেই ছোটবেলার কত সময়ে একসাথে কেটেছে। ক্লাস ইলেভেনে আমি তখন আর তুমি গ্র্যাজুয়েশনের সেকেন্ড ইয়ার ইতিহাসে। প্রতি শুক্রবারেই হয় তোমার বাড়ি নয়তো পাশেই আমার বাড়ির ছাদে একসাথে বসে গান শোনা কিংবা তোমার গিটারের তারে নিজেরাই সুমন, অনুপম থেকে মুকেশ লতার ডুয়েট, অথবা তোমার কন্ঠে আমার সব সময়ের প্রিয় তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান “বেশ তো না হয় স্বপ্তঋষির”। যদিও তুমি প্রায় সময়েই আমার থেকে শুনতে চাইতে “আজই যতো তারা তব আকাশে” । সুরের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি থেকেই যেভাবে আলাপের শুরু, তার মুহুর্তকে সমগ্র চিত্তে মিলিয়ে সময়হীন অখণ্ডতায় তুলে রাখার কথা তখন ভাবিনি। স্কুলে পড়ার চাপ, বয়ফ্রেন্ডের সাথে মনোমালিন্যের বোঝায় হারিয়ে থাকার সময়ে তোমার বোন আমায় তার খামখেয়ালী স্কুল গায়ক প্রেমিক ও তোমার সাথে আলাপ করিয়ে দেয়। তোমার বোন বলেছিল সর্বদা উদাসীন ও ভাবনায় নিমজ্জিত থাকার মুখভাব আসলে তোমার একটি সামাজিক স্বভাব। এই বিষয়ে আমি বেশি গ্রাহ্য করিনি, শুধু তোমার স্নেহশীলতাকে অন্তরের রোমান্টিকতায় বাঁধতে চেয়েছিলাম। তুমি বলেছিলে অপেক্ষা করতে, আমি বছর ঘুরতে গ্র্যাজুয়েশনে উঠে, অপেক্ষা করতে পারিনি। আবার অন্য বিফল সম্পর্ক, আবার তোমার কাছে সহায়তা। তুমি নির্লিপ্ত মুখে বন্ধুত্বের কর্তব্য পালন করে গিয়েছিলে। আমার আতঙ্কিত ও কান্নাকাটির স্বভাবের জন্য শেষে বাধ্য হয়েই বলেছিলে “আমি কি শুধু তোর দুঃখের সঙ্গী হব?” আনন্দের মুহুর্ত ভাগ করে নিলেও, দুঃখের প্রকাশকেই তুমি অতিরিক্ত মনে করেছিলে আমার। মাস্টার্স পড়তে গিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো, তোমার কথাটা আঘাত দিলেও, বাইরে বন্ধু বান্ধবের কারণেই স্মৃতির অস্পষ্টতায় হারিয়ে গিয়েছিল সুর দিয়ে ঘেরা ছাদের মুহুর্তগুলি। তুমিও হয়তো অভিমান করেই আর কোনো খবর বিশেষ নাওনি।
তুমি হয়তো ভাববে এখন হঠাৎ আমি কি সেন্টিমেন্টালিটির খাতিরে এসব লিখতে বসেছি? অতীতের গল্প গাঁথা উদ্দেশ্য আমার নয়। বরং এই মৃত শহরতলিতে একটু শ্বাস পেতে আরো একবার ছাদে এসে ফিরে দেখা। সময়কে স্পর্শ করতে কেউই পারবো না, তবুও ছায়ায় শেষ রেশ থেকে যাওয়া সকালের শ্বাসরুদ্ধ গহ্বরে প্রবেশের আগে আরো একবার অকারণেই অস্পষ্ট মুহুর্তের শেষ ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা। দুঃখের অন্তরঙ্গে তোমায় মনে আসেনি আজ, শুধুমাত্র সময়ের স্মৃতিতে হারানো গানকে আর একবার নতুন করে পেতে চাওয়ার হয়তো একটি ব্যার্থ কামনা। তুমি ফিরলেও একই ভাবে গিটারের ধ্বনি একসাথে হয়তো বাজবে না, তবুও একবার ইচ্ছা রইলো দুজনে একসাথে হলে আবার শোনা তরুণের “বেশ তো না হয় স্বপ্তঋষির”।
তোমার বাবা ও বোনের থেকে শুনলাম ক্যানাডায় এথনোমিউজিকোলজি নিয়ে পিএইচডি তোমার শেষের দিকে, হয়তো ফিরেই আসবে পরের বছর। আমি তখন থাকবো কিনা জানি না। রিসার্চের কাজ নিয়ে আমিও ব্যঙ্গালোরে আছি তুমি জানোই। এই চিঠির উত্তর আমি চাই না, শুধু অপেক্ষাটুকু চাই আরো একবার ছাদে সন্ধ্যার সময়হীনতায় প্রবেশ করতে। তোমায় সঙ্গী পেলে ভালো লাগবে। ভালো থেকো। আমার আন্তরিক ভালোবাসা নিও।
ইতি
তোমার চির স্নেহের বন্ধু
(নাম উল্লেখের প্রয়োজন মনে করলাম না)
কলমে – সচেতনতা ভট্টাচার্য্য