# সীমান্ত # পর্ব – ৯ কলমে – অরণ্যানী

# সীমান্ত # পর্ব – ৯
কলমে – অরণ্যানী

মাস্টারদা বাটি চামচ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। রান্নাঘরে ঝিনুক রান্না করতে করতে চোখের জল ফেলতে লাগলো। মিনু উদাসীন চোখে চারপাশে চেয়ে রয়েছে। আবার কখনো উদ্বিগ্ন চোখে লুল্লুর দিকে তাকাচ্ছে। মাস্টারদা ওর কাছে এলো।
মিনু বাটিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল – এটা কী?
মাস্টারদা – নুন চিনির জল। পারবি, চামচে করে ওকে একটু একটু করে খাওয়াতে? তাহলে দেখবি ওর শরীর ঠিক হয়ে যাবে। মাস্টারদা মিনুর দিকে বাটিটা এগিয়ে দিল। মিনু চামচ করে জল নিয়ে লুল্লুর মুখের ফাঁক দিয়ে ঢোকানোর চেষ্টা করল ।লুল্লু মুখ সরিয়ে নিল। ওর ধাক্কায় চামচের জলও পড়ে গেল।
মিনু — খাওয়ানো যাচ্ছে না। কী হবে?
মাস্টারদা – দে, আমার কাছে দে। মিনুর কোল থেকে মাস্টারদা লুল্লুকে নিজের কোলে তুলে নিল। বিড়ালটার নরম স্পর্শ বেশ ভালোই লাগলো। এক হাতে বিড়ালটাকে চেপে ধরে, আর এক হাত দিয়ে চামচ দিয়ে একটু একটু করে নুন চিনির জল লুল্লুকে খাওয়াতে লাগলো। লুল্লু প্রথমে ভীত চোখে মাস্টারদার দিকে তাকাল। কিন্তু মাস্টারদার দক্ষ ও বলিষ্ঠ হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করা যাবে না বুঝে আস্তে আস্তে নুন চিনির জল খেতে লাগলো। সেছাড়া বমি করা পেট অনেকক্ষণ খালি থাকাতে খিদেও পেয়েছিল। তাই বিনা প্রতিবাদে খেতে লাগলো। মিনু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। হাফ বাটি শেষ হতে লুল্লুকে মাস্টারদা মিনুর কোলে দিল। লুল্লু কোল থেকে নেমে গিয়ে উঠোনের একধারে হিসি করে এসে বাটির বাকি জলটা চেটে খেয়ে নিল। মিনু এতক্ষণে মনের ভার হালকা করে একটু নিশ্চিন্তে লুল্লুর দিকে তাকাল। লুল্লু নিমগাছটার তলায় একটা জায়গা দেখে নিয়ে শুয়ে পড়ল।

মিনুর মা ততক্ষণে ঘাট থেকে কাচা জামাকাপড় মেলতে থাকল বেড়ার উপর। তারপর মাস্টারদার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।
মাস্টারদা – ওই বিড়ালের ডাক্তারী করছিলাম।
শোভা – মানে?
মাস্টারদা – বিড়ালকে ওষুধ খাওয়ালাম।
শোভা – ওষুধ?
মাস্টারদা – কিরে মিনু বল।
মিনু সবিস্তারে সব বলতে লাগলো।
মাস্টারদা – বৌদি বিড়ালের ডাক্তারীর কথা শুনে অবাক হয়ে যাচ্ছে। মিনু হাসল।
মাস্টারদা – তাহলে ডাক্তারীর পাওনাটা কী দিবি?
মিনু হাসি মুখে বললো – কী দেবো, বলো।
মাস্টারদা মিনুর কাঁধে হাত রেখে বললো – হ্যাঁরে, বিড়ালকে এতো ভালোবাসছিস, মানুষকে পারবি এভাবে ভালোবাসতে?
মিনু – মানুষকে ভালোবাসার দরকার কী? মানুষ তো নিজেরাই পারে নিজেদের সবকিছু জোগাড় করতে।
মাস্টারদা – আর পশুরা বুঝি পারে না?
মিনু – না। অনেক পশুই তো পারে না মানুষ না দেখলে ভালো থাকতে।
মাস্টারদা – ঠিক আছে, চল্। তুই তো অনেক বেলা করে দিলি। বিড়াল খেয়েছে, এবার তুই খেয়ে নিয়ে জামা প্যান্ট পরে মাঠে চল।
মিনু – নেয়ে আসব না?
মাস্টারদা –না, অনেক বেলা হয়ে গেছে।
ঝিনুক রান্নাঘর থেকে এক কাপ চা এনে মাস্টারদার হাতে বিস্কুট সহ ধরিয়ে দিয়ে ভেতরে চলে গেল।
মাস্টারদা দাওয়ায় বসে মিনুকে বললো – তুই রেডি হয়ে নে তাড়াতাড়ি। মিনুও ভেতরে চলে গেল।
শোভা – দেখো মাস্টার, ছেলেকে তো গণসেনায় নিচ্ছ। আমাদের ওই একটাই ছেলে। আমারও বয়স হয়ে গেছে। ভয়ের তো কিছু নেই?
মাস্টারদা – তুমি চিন্তা করো না বৌদি। আমরা তো অনেকেই আছি। আমি এই গ্রাম থেকে অনেককে তো বেছেছি। সেছাড়া পাশের গ্রাম থেকেও অনেকে থাকবে।
শোভা মিনতির কন্ঠে বললো – তবু বাবা আমার ছেলেটাকে দেখো। ও তোমায় খুব মানে।
মাস্টারদা – ঠিক আছে, দেখব।
মাস্টারদার চা খাওয়া শেষ। মিনুও খেয়ে নিয়ে রেডি। ওরা উঠোনে এসে বিজয়কে দেখতে পেল। মিনু বিজয়কে দেখে হাসল। বিজয় একটু লজ্জা পেল।
বিজয় – মাস্টারদা, কী হয়েছে? সবাই খুঁজছে তোমাকে। অলোক বললো, তুমি এখানে মিনুকে ডাকতে এসেছ। আমাদের প্র্যাকটিস শেষ। তুমি দেখবে চলো।
ওরা উঠোন পার হয়ে চললো। নিমগাছের তলায় লুল্লু তখন ফড়িংয়ের সঙ্গে লাফালাফি করছে। মিনু ও মাস্টারদার চোখ গেল সেইদিকে।
মাস্টারদা মিনুকে বললো – কিরে, খুশি তো?
মিনু ঘাড় কাত করে হ্যাঁ জানালো। ওরা মাঠের দিকে চলে গেল।

জঙ্গলে একা মেঘ :- এরই মধ্যে মেঘের কখন তন্দ্রা এসেছিল। ভোর হতেই মাথার উপরে পাখির কলরবে ঘুম ভাঙল। এতবড় একটা মানুষকে গাছের উপর দেখে আজ পাখিদের কলরব একটু বেশিই হচ্ছিল। মেঘ গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা তীর-ধনুক ও একটা ঝুলি নিয়ে গাছ থেকে নামল। এদিক ওদিক তাকিয়ে কী যেন ভাবতে লাগলো। তারপর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নির্দিষ্ট কিছুর উদ্দেশ্যে চলা শুরু হলো। একটা জামরুল গাছের কাছে এসে থামল। গাছটায় থোকায় থোকায় জামরুল হয়ে আছে। মেঘ তীর-ধনুক ও ঝুলি গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখে চটপট উঠে গেল গাছে। প্রথমেই একটা থোকা জামরুল পেড়ে গাছের ডালে বসে খেতে লাগলো। রাত থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। তাই খিদেও পেয়েছিল। এক থোকা জামরুল মুহূর্তে খেয়ে শেষ করে আর এক থোকা পাড়ল। দ্বিতীয় থোকা শেষ করে কিছু জামরুল পেড়ে ঝুলিতে ঢোকাল। তারপর গাছ থেকে নেমে তীর-ধনুক ও ঝুলি সহ জঙ্গলের পথে হাঁটা দিল। এবার এলো নদীর তীরে। এখানেও কাছাকাছি অন্য একটি আদিবাসী দলের বাস। তারা সকালবেলা দল বেঁধে খাদ্য সংগ্রহে যাচ্ছে। অনেকে শস্যক্ষেত্রে কাজ করছে। মেঘ ওদের দিকে একবার তাকাল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল নিজের দলের মানুষগুলোর চেহারা। তারপর দলপতির কথা, “তোমাকে তো এবার সাদি করতেই হবে।” মেঘ দ্রুত নদীতে নেমে গিয়ে জল খেল। চোখে, মুখে, হাতে, পায়ে জল দিল। তারপর বেশ দ্রুত জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকল। চলা দেখেই বোঝা যায় যে কোথায় সে চলেছে নিজেও তা জানে না।

ক্রমশ গভীর জঙ্গলে এসে প্রবেশ করল। এখানে জঙ্গল এতো ঘন যে দিনের বেলাতেও সূর্যের আলো সেভাবে প্রবেশ করে না। সবটাই ঘন ছায়ায় ঢাকা। যেন মনে হয় মেঘ করেছে। মেঘ হঠাৎই চলা থামালো। গাছ থেকে গাছের ডালে বাঁদর লাফ দিচ্ছে। পাখির কিচমিচ আওয়াজ। দিনের বেলাতেও ঝিঁঝিঁ ডাকছে। মেঘ একটা গাছের গায়ে ঠ্যাঁস দিয়ে দাঁড়িয়ে চারিদিকে শান্ত ও গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে। কিছুক্ষণ এভাবেই ঘোরের মধ্যে কাটল। তারপর উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘ বেলা বোঝার চেষ্টা করল। গাছের ফাঁক দিয়ে যেটুকু আকাশ দেখা যায়, তা বেশ চকচকে। মেঘ আবারও হাঁটা শুরু করল।

জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এবার একটু ফাঁকা জায়গায় এলো। এখানে আশপাশে জলা ও লম্বা লম্বা ঘাসের ঝোপ। মেঘ বেশ বড় একটা গাছের উঁচু ডালে বসে নিচের দিকে নজর রাখল। একটা ঘাসের ঝোপে দু’একটা ঘাস নড়ছিল। সেইদিকে তাকিয়ে কিছু দেখা গেল না। জলার পাশে কিছুটা ফাঁকা ঘাস জমি। উড়ে এসে একটি ময়ূর সেখানে বসল। সাথে সাথে আরো কয়েকটা ময়ূর এলো। মেঘের ধনুক থেকে তীর ছিটকে গিয়ে বিঁধল একটি ময়ূরের পিঠে। অন্য ময়ূরগুলো উড়ে পালালো। তখনই ঘাস ঝোপ থেকে একটি বড় বাঘ লাফ দিয়ে বেরিয়ে এসে ভয়ার্ত ভাবে ছুটতে ছুটতে বিপরীত দিকের জঙ্গলে চলে গেল। তীরবিদ্ধ ময়ূরটি একটু ছটফট করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। মেঘ একটু সময় অপেক্ষা করে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে গাছ থেকে নামল। এক দৌড়ে তীরবিদ্ধ ময়ূরটার পিঠ থেকে তীর খুলে নিয়ে ময়ূরটি সহ অতি দ্রুত ওদিকের জঙ্গল পার হয়ে আসতে লাগলো সতর্কতার সঙ্গে।

এভাবে জঙ্গলের একটা স্থানে এসে সে কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করলো। একটা ছুরি বের করে ময়ূরের মাংস ছাড়াতে লাগলো। তারপর চললো নদীর দিকে। নদীতে এসে ছাল ছাড়ানো ময়ূরটাকে ধুয়ে ঝুলিতে ভরে নিল। তারপর কিছুটা জলপান করে, হাত মুখ ধুয়ে কাপড়ে যে রক্ত লেগেছিল তাও ধুলো। নদীর ধারে গাছের ছায়ায় বসে ঝুলি থেকে কয়েকটা জামরুল বের করে খেলো। তারপর আবারও হাঁটা দিল।

এবার জঙ্গল ক্রমশ ফাঁকা হতে থাকলো। লোকালয় নজরে এলো। মেঘ দ্রুত জঙ্গল পার হয়ে গ্রামের লোকালয়ে এলো। এখানে মানুষের পোশাক একটু অন্যরকম। ওদের মতো নয়। মেঘ যদিও দু’একবার গ্রামে এসেছে আর কারুর সঙ্গে, কিন্তু ও অবাক চোখে আজ দেখতে লাগলো।
(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *