৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ ~ শান্তনু ঘোষ পর্ব-১৩

৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ
~ শান্তনু ঘোষ
পর্ব-১৩

আগে যা ঘটেছে:

আজ সকাল সকাল একাই বেরিয়ে পড়েছি । যাচ্ছি কুষ্টিয়া। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি দেখতে।
পথে শুনি আজ কুঠিবাড়ি নাকি বন্ধ। আজ রবিবার। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারী ছুটির দিন তো শুক্রবার। রবিবার তো নয়! তাহলে আজ বন্ধ থাকবে কেন। শুনে মনটা দমে গেল। এত কসরত করে সেই কলকাতা থেকে এলাম। আর এখন যদি ভিতরেই না যেতে পারি তো বিষয়টা মোটেও আনন্দদায়ক হবে না। যাই হোক এসেছি যখন, যাই এগিয়ে দেখি কি অবস্থা…

তারপর…
পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি কুঠিবাড়ির দিকে। পিচের সোজা রাস্তা। দুদিকে নানা ধরনের ছোটোখাটো দোকান। খাবার, খেলনা, স্মৃতি-স্মারক, আরো নানা টুকিটাকি বিক্রি হচ্ছে। সামনেই দেখতে পাচ্ছি লাল রঙের কুঠিবাড়ির। কি যে আনন্দ হচ্ছে তা নিজেকেই নিজে বলতে পারছি না। এত দিনের স্বপ্ন।

কুঠীবাড়ির সামনে বিশাল প্রাঙ্গণ। তার সামনে বিশাল গেট। দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছি গেট বন্ধ। কিন্তু কিছু লোকজন তো ঘুরঘুর করছে। তার মানে, ওরাও ভুল করে এসেছে নাকি? এসব ভাবতে ভাবতে গেটের সামনে এসে পড়েছি। আর ঠিক তখনই আমার জীবনের এক আনন্দ মুহূর্ত ধুম করে ঝুনো নারকেলের মত সামনে পড়ল। বড় গেটের পাশে একটা ছোট গেট। আর সেই গেটটা খোলা। আর তার পাশেই এক ছোট্ট কাউন্টারে ভিতরে ঢোকার টিকিট বিক্রি হচ্ছে।

আমার সামনে একজন ২০ টাকা দিয়ে ভিতরে ঢোকার টিকিট কেটে ঢুকে গেল।
আমি গিয়ে বলি, একটা টিকিট দিন।
ভিতর থেকে বলল, ২০ টাকা ।
টাকা দিতেই যাচ্ছি। অমনি ভিতরের ভদ্রলোক প্রশ্ন করল, আপনি কি ইন্ডিয়ান?
আমি বলি, হ্যাঁ।
– তাহলে ১০০ টাকা দিন।
আমি বলি, আরে এই তো আগের জনকে কুড়ি টাকায় দিলেন।
ভিতর থেকে জবাব এল, ফরেনারদের জন্য ১০০ টাকা।
আমি এখানে “ফরেনার”! নিজের কানেই কেমন যেন শোনালো শব্দটা।
১০০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটেই ঢুকতে হল।

গেট থেকে আরও মিটার দশেক হেঁটে কুঠীবাড়ির মূল দরজায় পৌঁছে গেছি। বাড়িটা মনে হয় কিছুদিন আগে মেরামত ও রং করা হয়েছে। তবে কাজে কিছু ফাঁক ছিল তা বুঝতে পারছি।

দরজা দিয়ে ঢুকতেই একজন টিকিটটা দেখল।
ভিতরে ঢুকে দেখছি অনেক লোক এসেছে। আজ ছুটির দিন বলেই হয়ত ভিড় বেশী।

কুঠীবাড়িটি দোতলা। বেশ সাবেকী ধাঁচে তৈরি। লাল রং করা। বাড়ির চারিদিকে সুবিশাল প্রাঙ্গণ। অনেক গাছ আছে। আর মাঝে মাঝে সুন্দর বাগান করে রাখা আছে। বাড়ির ডানদিকের উঠোন পেরিয়ে গেলে খুব বড় পুকুর। তার চারিদিকে আছে আম, নারকেল, সুপারি ও আরো নানা ধরনের গাছের সারি। শাণ বাঁধানো ঘাট। সেখানে গাছের স্নিগ্ধ ছায়ার নীচে বসে বোরখা পরিহিতা কয়েকজন মহিলা গল্প করছেন, আর তাদের বাচ্চা সামলাচ্ছেন। দূর থেকে তাদের চোখ ছাড়া আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

বাড়ির পেছনের দিকের বাগানে একটু দূরে দূরে কিছু প্রাচীন গাছ আছে। একটি পুরানো আম গাছের নীচে দেখছি লেখা আছে “রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত গাছ” । এর যে কি অর্থ আমি বুঝতে পারছি না। গাছটি কি রবীন্দ্রনাথ লাগিয়েছিলেন, নাকি এখানে বসে কবিতা লিখতেন, নাকি এই গাছের আম তাঁর প্রিয় ছিল, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। স্পষ্ট করে না বলে এমন ভাসা-ভাসা লিখে একটা টিনের ফলক লাগিয়ে দেবার কারণ আমি অনুধাবন করতে পারছি না। আশপাশে কেউ নেই যাকে জিজ্ঞেস করে সদুত্তর পাবো।

কুঠীবাড়ির অনেকগুলো ঘর। ঘরের বিন্যাস বেশ অন্যরকম। মূল দরজা দিয়ে সামনে একটা ড্রয়িং রুমের মত ঘর। তবে বেশী বড় নয়। এবং এটা ঠিক ড্রয়িং রুমও নয়। হয়ত ড্রয়িং রুমে যাবার ঘর। ঢুকেই ডান আর বাঁ দিকে দুটি ঘরে যাবার দুটি দরজা। আমি ঢুকেই বাঁদিকের ঘরে এসেছি । এই ঘরের মধ্য দিয়ে ভিতরের আর একটা ঘরে যাবার দরজা। সেই ভিতরের ঘরের এক পাশ দিয়ে মাঝের একটা ঘরে যাবার দরজা। এই মাঝের ঘরটা বেশ বড়। এটাই বৈঠকখানা হবে। আর এই ঘরটা থেকে আবার বাইরের ঘরটিতে যাবার দরজা আছে। এই মাঝের ঘরটির অবস্থান সামনের ছোট ঘরটির ঠিক পেছনে। অর্থাৎ এই ঘরটিতে তিনদিক দিয়েই প্রবেশ করা যায়।

ঘরগুলি খুব বড় নয়। প্রতিটি ঘরে প্রায় এক মানুষ সমান লম্বা অনেকগুলো জানালা। আলো-হাওয়ার সুবন্দোবস্ত। আমি গো-প্রো বার করে ভিডিও তুলতে যাবো, এমন সময় গেট-পাহারারত লোকটি এসে বললেন যে, ভিডিও তোলা নিষেধ। কিন্তু মোবাইলে ছবি তোলার অনুমতি আছে। বেশ মজা লাগলো।

সেই সময়ের জমিদার ছিলেন ঠাকুর পরিবার। তা সত্বেও তেমন আড়ম্বর কিছুই নেই এই বাড়িতে। গতকাল তো দুই জমিদার বাড়ি দেখেছি। নাটোরে আর পুঠিয়ায়। সে সব তো একেবারে রাজবাড়ি । তার কাছে। এই কুঠীবাড়ি তো শিশু।

ঘরগুলিতে অনেক ছবি, লেখা, স্মারক, কিছু আসবাব ও ব্যবহৃত জিনিসপত্র ইতস্ততঃ রাখা আছে। দেখে আমার মনে হচ্ছে, যেন খুব ভেবেচিন্তে ও যথেষ্ট পরিকল্পনা করে এই ঘর গুলো সাজানো হয়ে ওঠেনি। কেমন যেন খাপছাড়া জিনিস একই ঘরে পাশাপাশি রাখা আছে। সে যুগের একটা জলের ফিল্টারের পাশে টানানো আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক বড় ছবি। তার পাশেই একটা গোল টেবিল। উল্টো দিকে একটা ছোট আলমারি।

একটা ঘরে রাখা দুটো পালকি, তারই এক ধারে একটি ফাইল ক্যাবিনেট। অন্য একটি ঘরে এক কোণে একটা লন-মোয়ার রাখা আছে, তার পাশেই রাখা আছে একটা সিন্দুক। মাঝের ঘরে আছে রবি ঠাকুরের সেই বিখ্যাত পদ্মাবোট-এর একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। তার পাশেই রাখা কালো বার্নিশ করা খাজনা আদায়ের টেবিল।

এমনই সব সম্পর্কহীন জিনিসপত্র কোনায় কোনায় রাখা। তার একটা কারণ হতে পারে যে দ্রষ্টব্য হিসেবে সাজানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ জিনিস হয়ত পাওয়া যায়নি। তাই কিছু দিয়ে ঘর ভরাতে হবে বলেই এদিক ওদিক করে একরকম ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাজার হোক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো । একেবারে কিছুই না রাখলে ঠিক হবে না। যাই হোক অন্তত কিছু স্মৃতি-স্মারক দেখার সুযোগ তো পাওয়া যাচ্ছে। এটা অবশ্যই আমার মত। অন্যরা তাদের মত ভাববেন।

একতলা থেকে দোতলায় এসেছি। এখানেও একইরকম ভাবে বিভিন্ন দ্রষ্টব্য রাখা আছে। বারন্দায় রাখা আছে একটি ডিঙি যেটা কবি কোন কাজে নদী পথে কাছাকাছি কোথাও যেতে ব্যবহার করতেন। একটা ঘরে রাখা এক বড় খাট। কবি এই খাট ব্যবহার করতেন। গদীহীন খাট ঘিরে রাখা আছে দড়ির বেষ্টনী দিয়ে। খাটের উপর এক ফলকে লেখা – খাটের উপরে বসা নিষেধ। কিন্তু দেখছি অনেক লোক দড়ির বেষ্টনী এড়িয়ে সেই খাটে বসে ছবি তুলছে বা তোলাচ্ছে।

পাশে একটি ঘরে শুধুই ছবি রাখা আছে।
লোকজন দেখছি এলোপাথাড়ি ঘুরছে। দ্রষ্টব্য মন দিয়ে তেমন কেউ দেখছে না। বেশিরভাগই সেলফি নয় গ্রুপি তুলতে ব্যস্ত। বাচ্চারা এদিক ওদিক ছুটোছুটি আর চিৎকার করছে। বোরখা পরিহিতা মায়েরা ছুটছেন তাদের সামলাতে। সব মিলিয়ে বেশ হৈ চৈ চলছে। মনে পড়ল বেশ কয়েক বছর আগে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র সংগ্রহশালা কেমন দেখেছিলাম। সেখানে ঢুকে তার পরিবেশ দেখেই সম্ভ্রম জাগে। কারও জোরে কথা বলতেও অস্বস্তি হবে।

এসব ভাবতে ভাবতে নীচে নেমে এসেছি। নীচে একটি ভিজিটার্স কমেন্টস বুক রাখা আছে। কি মনে হল কে জানে। হঠাৎ খাতাটি একটু খুলে দেখতে ইচ্ছে হল। দেখছি বেশ কিছু কমেন্টস আছে। পশ্চিমবঙ্গের কিছু ঠিকানাও চোখে পড়ছে।

কি ভেবে, আমিও লিখতে শুরু করি। যা মনে আসছে লিখছি। আড়চোখে বুঝতে পারছি যে পাশে গেটের সামনে দাঁড়ানো কর্মী দুজন বেশ লক্ষ করছেন। ওরা জানেন যে আমি ইন্ডিয়ান। ঢোকার সময় টিকিট দেখেছিলেন। কিছু দর্শকও যেতে যেতে একবার একটু অবাক হয়ে ঘাড় ঘোরাচ্ছে। অনেক কিছু বক্তব্য ও নিজের নাম ঠিকানা লিখে খাতা বন্ধ করে বেরিয়ে এলাম।

এবার কুঠীবাড়ির চারপাশটা একটু ঘুরে দেখছি। অনেকটা বেলা হয়েছে। এখান থেকে যাবো লালন ফকিরের মাজারে। তাই আর বেশী সময় ব্যয় করতে পারছি না। তাছাড়া কুঠীবাড়ির ব্যবস্থাপনা দেখে আমার মনটা একটু দমে গেছে।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাইরে যাবার গেটের দিকে ধীরে ধীরে হাঁটছি। দেখতে পেলাম, একটি টুরিস্টের দল। তারাও কুঠীবাড়ি দেখে ফিরছেন। দলের সবাই প্রায় ষাটের কাছাকাছি বয়সের হবেন। বুঝতে পারছি কলকাতার লোক।

তাদেরই দলের এক ভদ্রলোক আমাকে দেখে বললেন, আমি কলকাতা থেকে এসেছি কিনা।
আমার উত্তর শুনে উনি বলেন, যে ওনার বাড়ি যাদবপুরে। সবাই দল বেঁধে একটা প্যাকেজ ট্যুরে বাংলাদেশ ভ্রমণে এসেছেন। টুকটাক কথা হচ্ছে। আজই ঢাকা থেকে বড় একটা গাড়ি নিয়ে এখানে এসেছেন। এবার লালন সাঁই এর মাজার দেখে আবার ঢাকায় ফিরে যাবেন। আমিও লালন ফকিরের ওখানে যাবো শুনে বললেন, আসুন আমাদের গাড়িতে, আপনাকে ওখানে নামিয়ে দেই।

আমি সবিনয়ে ও সানন্দে মানা করলাম। কারণ আমি তো শুধু জায়গা বা স্পট দেখতে বেরোই না। আমার ভ্রমণের লক্ষ্য হল মানুষের সাথে মেশা, তাঁদের জানা। গাড়িতে গেলে আমি তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব। আমার যাওয়া হবে সেই সাইকেল ভ্যানে গল্প করতে করতে…।

ওনাদের গাড়ি চলে গেল। আমি হাঁটছি। সামনে রাস্তার বাঁদিকে দেখি অনেক লোক সার দিয়ে মাটিতে উবু হয়ে বসে কি যেন বিক্রি করছে।
কৌতূহলী আমি জিজ্ঞেস করি, কি বিক্রি হচ্ছে।
ওরা বলেন, কুলফি।
পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এক ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী। আমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছেন, যে আমি ইন্ডিয়ান। নিজে থেকেই আলাপ করেন। ওনার ব্যবসা আছে ঢাকায়। এখানে ঘুরতে এসেছেন। আমার কৌতূহল দেখে উনি কুলফির উপরে এক ছোটখাটো বর্ণনা দিয়ে দিলেন। আমি তাতে গলে গিয়ে বলি, ভাই আমাকেও একটা কুলফি দ্যান।

এখানে কুলফি নাকি বিখ্যাত। কুলফি আরা খাজা। দুটোই নাকি খুব ভালো। সেই লালন ফকিরের আমল থেকেই এর সুনাম। এই নিয়ে নাকি লালন ফকিরের গানও আছে।

বলি, তা একটু শোনান না কেন সেই গানটা।
বিক্রেতা, একটু হেসে খোলা গলায় দুকলি সে গান গেয়ে দিলেন।
তাতে বেশ আনন্দিত হয়ে একটা কুলফি খাই।

খুব যে আহামরি লাগলো তা বলতে পারিনা। যাই হোক দাম দিতে গেছি। বিক্রেতা বলেন যে দাম মেটানো হয়ে গেছে। আমি তো অবাক ! কে দিল টাকা। পাশের ভদ্রলোকের দিকে ইশারা করলেন। আমি তো রীতিমত বিব্রত বোধ করছি।
এমন ক্ষেত্রে যা বলা হয় তাই বলছি।
উনি কিছুই শুনছেন না। বলছেন যে, আপনি আমাদের মেহেমান। তাই এটা এমন কিছুই নয়। ঢাকায় এলে যোগাযোগ করবেন।

এভাবেই বন্ধুত্ব ও শুভেচ্ছা বিনিময় করে আমি এবার কুঠীবাড়ির চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে আসি। সামনে একজন অল্প বয়সী ছেলে জিজ্ঞেস করে, সাইকেল ভ্যান লাগবে নাকি।
আমি বলি, আমি তো একা, পুরা ভ্যান নিব না। শেয়ার কইরা যামু। সে রাজি হয়। বলে, পথে কাউরে পাইলে নিয়া নিমু।
আমি বলি, ঠিক আছে। চল আলাউদ্দিন নগর।
ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *