রবীন্দ্রোত্তর বাংলা নাট্যসাহিত্য ✒️✒️✒️ রেশম লতা

রবীন্দ্রোত্তর বাংলা নাট্যসাহিত্য
রেশম লতা

আধুনিক নাটক সৃষ্টির পিছনে ইংরেজি সাহিত্য ও সভ্যতা সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হলেও রবীন্দ্রোত্তর সময়কালে এর প্রভাব খুব একটা চোখে পড়েনি। কেননা ততদিনে বাংলা সাহিত্যে নিজস্ব ঘরনার চিন্তাচেতনা, দূরদর্শন, সমাজসচেতনার উন্মেষ ব্যাপকভাবে উন্মোচিত হয়। আধুনিক নাটকের উৎপত্তি সামাজিক সমস্যা দেশ কালের বিচিত্রমুখী ভাব সংঘাত এবং রাষ্ট্রীয় আলোড়নকে উপজীব্য করে। রবীন্দ্রোত্তর নাট্য আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ছিল ভাব এবং আঙ্গিকের পরিবর্তন। এ পরিবর্তনকে পরিবর্ধনের মাধ্যমে অবলম্বন হিসেবে ধরে নিয়ে নুরুল মোমেনের আত্মপ্রকাশ। তার নাটকের বিশিষ্টতায় সুতীক্ষ্ম রসবোধ, সংলাপ এবং সজাগ অনুভূতির নির্যাস। নুরুল মোমেনের রূপান্তর, নেমেসিস, আলো ছায়া, বহুরূপা, নয়া খান্দান, যদি এমন হতো, শতকরা আশি ইত্যাদি নাট্যগ্রন্থগুলো বাংলা নাট্য সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। নেমেসিস নাটক রচনায় তিনি সর্বাধিক কৃতিত্ব অর্জন করেন। নুরুল মোমেন তার প্রথম নাটক রূপান্তর প্রকাশের মাধ্যমে খ্যাতির তুঙ্গে উঠেন। নেমেসিস নাটকের বৈচিত্র্যময় আঙ্গিক আর সংলাপের বিশিষ্টতা আকর্ষণীয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জনৈক বিত্তশালীর মনোজগতের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আর সংশয় খুব নিঁখুতভাবে তুলে ধরেছেন।
সিকান্দার আবু জাফর যদিও কবি হিসেবে পরিচিত মুখ তবে তার কিছু সংখ্যক নাট্য রচনা অবদান উল্লেখযোগ্য। তন্মধ্যে সিরাজউদ্দৌলা ঐতিহাসিক নাটক। শকুন্তলার উপাখ্যান রূপকধর্মী নাটক। এই রূপকের মূল কথায় সিকান্দার আবু জাফর যে উক্তি রেখেছেন তা ব্যক্তিজীবনের মনুষ্যত্বের অবলোকন।
আসকার ইবনে শাইখ একমাত্র নাট্যকার যিনি কেবল নাটকই রচনা করেন। তার নাটকের বিষয়বস্তুতে সামাজিক অবক্ষয় ও জাতীয় জাগরণ উল্লেখযোগ্য। তার রচিত ঐতিহাসিক নাটক তিতুমীর, অগ্নিগিরি ও রক্তপদ্ম। বিল বাওড়ের ঢেউ, এপার ওপার, বিদ্রোহী পদ্মা, প্রচ্ছদপট, পদক্ষেপ, প্রতীক্ষা, বিরোধ ইত্যাদি সামাজিক। তৎকালীন সময়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য, আনন্দ-বেদনার স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণ যেন নাট্যকারের স্পষ্ট ইঙ্গিত। প্রবীণ নাট্যকার শাহাদাত হোসেন কথা সাহিত্যিক ও কবি হিসেবে খ্যাত হলেও নাটকে তার অবদান অসামান্য। ঐতিহাসিক কাহিনীর আলোকে নাটক রচনার পক্ষে তিনি কলম ধরেছেন। নবাব আলীবর্দী, আনারকলি, মসনদের মোহ ইত্যাদি নাটকগুলো সারা জাগানো বিশেষ করে মুসলিম সাহিত্য অনুরাগীদের প্রেরণার মূল উৎসও বটে। বাংলা নাট্য সাহিত্যের সাথে যে নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত তিনি মুনির চৌধুরী। নাট্য সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ অবলম্বনে রচিত রক্তাক্ত প্রান্তর একটি পূর্ণাঙ্গ ঐতিহাসিক নাটক। নাটকের সাসপেন্স, সংঘাত ও গতিবেগ চোখে দেখার মত। মানুষ, নষ্ট ছেলে, কবর, চিঠি নাটকগুলো একাঙ্কিকাধর্মী। ভাষা আন্দোলনসহ রাজনৈতিক বিভিন্ন আন্দোলনের প্রেক্ষাপটের দৃশ্যায়ন তার নাটকে স্পষ্ট। এছাড়াও তার একতলা দুতলা, নেতা, গুন্ডা, বংশধর একটি মশা, পলাশী, রোজার জন্মদিনে ফিট কলাম, দণ্ডকারণ্য ইত্যাদি নাটকগুলোর উপস্থাপন অভিনব। ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ এবং প্রজ্ঞা বুদ্ধির শাণিত দীপ্তি তার নাটকের লক্ষ্যযোগ্য। বহুবিবাহ গঠিত সামাজিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে কাহিনী ও চরিত্রের বিন্যাস নিখুঁত পরিকল্পনায় চিত্রিত পেয়েছে অদ্বিতীয়া নাটকে। এই নাটকের স্রষ্টা আব্দুল হক। তার নাটকগুলোর বক্তব্য ও উপস্থাপন স্বতন্ত্র। আব্দুল হকের ঐতিহাসিক নাটক ফেরদৌসী। আলাউদ্দিন আল আজাদ একজন সচেতন কথা সাহিত্যিক। তার রচিত কয়েকটি নাটকের দক্ষতা অতুলনীয়। ইহুদির মেয়ে কাব্য নাট্য। ধন্যবাদ, মায়াবী প্রহর ও ইরোক্কার যাদুকর রূপক নাট্য। সংলাপের দৃঢ়তা ও গভীরতা আলাউদ্দিন আল আজাদ এর নাটকের বৈশিষ্ট্য। বাংলা নাট্য সাহিত্যের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অবদান অনস্বীকার্য। সচেতনতামূলক ও সংস্কারমূলক এই নাট্যকার নিরীক্ষাধর্মী নাটক লিখে গেছেন। বহুপীর, তরঙ্গভঙ্গ, সুড়ঙ্গ, উজানের মৃত্যু নাটকগুলো সমাজ জীবনের অন্ধকারচ্ছন্ন দিকগুলো প্রতীকী আয়না হিসেবে আজও ভাবি সমাদৃত। মমতাজ উদ্দীন আহমদ নাটক রচনায় কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তার উল্লেখযোগ্য নাটক গুলোর মধ্যে স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, বিবাহ, বর্ণচোরা, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম অন্যতম।জসীমউদ্দীনের প্রধান পরিচয় কবি হলেও তার কয়েকটি গীতিনাট্য বাংলা নাট্য সাহিত্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বেদের মেয়ে, পদ্মাপাড়, মধুমালা ইত্যাদি। লোক তথা গ্রামীণ জীবনের দ্বন্দ্ব সংঘাতের অন্যতম নিদর্শন। সমাজজীবনের বিচিত্র পরিচয় যার নাটকের অন্তরালে নিঁখুতভাবে খচিত তিনি শওকত ওসমান। বিশিষ্ট এই নাট্যকারের উল্লেখযোগ্য নাটক আমলার মামলা, কাঁকরমনি, তস্কর লস্কর ইত্যাদি। কল্যাণ মিত্রের কথা না বললেই নয়। যিনি নাটক রচনার স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন পুরস্কার ও জনপ্রিয়তার খ্যাতি। অসংখ্য নাটকের স্রষ্টা এই নাট্যকারের বেশ কিছু নাটকের নাম হল চোরাগলি, শপথ, একটি জাতি, সূর্যমহল, মন, ডাকাত, একটি ইতিহাস, দায়ী কে ইত্যাদি। আ.ন.ম বজলুর রশীদ সাহিত্যের অপরাপর ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ গুরুত্বপূর্ণ। তার রচিত উল্লেখযোগ্য নাটক গুলোর মধ্যে ত্রিমাত্রিক, ধান কলম, পাখি। নাটকগুলোর উপজীবী বিষয়গুলোর মধ্যে সমসাময়িক জীবন চিত্র এবং সমস্যা অন্যতম। বিনোদনের সীমানা পেরিয়ে রবীন্দ্রোত্তর নাটকের বক্তব্য সুস্পষ্ট। সমসাময়িক সমস্যা ও অভিজাত পরিবর্তন নাটকের উপজীব্য বিষয় হয়ে উঠেছে। তবে রবীন্দ্রোত্তর সময়ে বাংলা নাটকের গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এ কথাও অনস্বীকার্য বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাস সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো সমৃদ্ধি লাভ করতে পারিনি। যদিও বর্তমান সময়ে সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যের মতো নাটকের দৈন্যও সুস্পষ্ট। তবুও আশা করা যায় বাংলা নাটকের গতি তার নিজস্ব ধারায় প্রবাহিত হয়ে আমাদের বাংলা নাট্য সাহিত্যকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধিতে সফল করে তুলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *