কিছু কথা। পর্ব – ৮ । ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

ধারাবাহিক উপন্যাসিকা।
কিছু কথা।
পর্ব – ৮ ।
ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

কাকলির কথা।

কেন দেখা হলো এতো বছর পরে? মনে পড়ছে সত্তরের সেই উত্তাল দশক! এক‌ই পাড়ার ছেলেমেয়ে আমরা এক‌ই বছরে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছিলাম। পার্থ, সেবা, দুলাল, মধুমিতা, তনুশ্রী,ভীমু, সত্যব্রত, ময়না, কৌশিক। সবাই যার যার পছন্দ অনুযায়ী সাবজেক্টে অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম বেথুন, বিদ্যাসাগর, মণীন্দচন্দ্র কলেজে। আমি আর কৌশিক বাংলায় অনার্স নিয়ে স্কটিশে। আমাকে সবাই জানতো শান্ত, নির্বিরোধী,বাধ্য মেয়ে হিসেবে।আসলে সেই সময়ে মধ্যবিত্ত, ভদ্র শিক্ষিত বাঙালি পরিবারে একটা আলাদা দর্শন ও মূল্যবোধ ছিলো। ছেলেমেয়ের অবাধ মেলামেশায় একটি গন্ডি থাকতো।তবু সত্তরের দশক মুক্তির দশক। কৌশিক জড়িয়ে পড়লো নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে। সেদিনের কথা খুব মনে পড়ছে। কলেজের গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো পুলিশভ্যান। টেনে হেঁচড়ে তুললো স্বপন, সাধন, সুব্রত, কৌশিকদের। কৌশিকের হাতটা মুচড়ে নিংড়ে দিতে লাগলো ভিজে ন্যাতার মতো। চামড়া ছিঁড়ে টপটপ করে রক্ত ঝরতে লাগলো কনুই বেয়ে।কৌশিকের মুখে কোন‌ও প্রতিক্রিয়া নেই, নেই কোন‌ও যন্ত্রণার অভিব্যক্তি। গাছকে কাটলে যেমন নির্লিপ্ত থাকে সে, ঠিক তেমনি। এরা ভুল পথে পরিচালিত হয়েছিল। তবু আমি উপলব্ধি করেছিলাম সাচ্চা বিপ্লবী এরাই, এদের কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষার তাগিদ ছিলোনা। চারু মজুমদার ,কানু সান্যালকে এরা গুরু মেনেছিল।আমি মুখে কাপড় গুঁজে থরথরিয়ে কাঁপছি। সব মেয়েরা ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিলাম লেডিস কমন রুমে। পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে মনে করে একটু পরেই বেরিয়ে এলাম কলেজ থেকে। হঠাৎই দুমদাম বোমার আওয়াজ। আমরা ছুটলাম ডান্ডাস হস্টেলের দিকে। সেদিন বাড়ি ফিরতে রাত আটটা বেজে গিয়েছিল। পরদিন শুনলাম, বরানগরে গণহত্যার কথা। বরানগরের রাস্তা আর গঙ্গা লাল হয়ে গিয়েছিল রক্তে। ওরা নকশাল, ওরা আমার সহপাঠী কেউ, কেউবা আমার সোদর ভাই! আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম।

বারাসাত থেকে ট্রেনে শেয়ালদা সেখান থেকে বাসে কলেজ যেতাম। অসুস্থ শরীরে কলেজ যাওয়া বন্ধ হলো কিছু দিন। বাবা আমার পড়াশোনা নিয়ে চিন্তিত, মা চাইছেন ভালোয় ভালোয় বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে। শুরু হলো খবরের কাগজে পাত্র খোঁজা। খুকু বললো -‘ঊনিশ বছরেই বিয়ে দেবে মা? দিদি লেখাপড়ায় কতো ভালো। গ্র্যাজুয়েটটা অন্তত হতে দাও।’- মা বললেন -‘ এই ডামাডোলের বাজারে কোলকাতার কলেজে পড়তে যায়, বাড়ি ফিরতে রাত আটটা বেজে যায়। চাদ্দিকে বোমাবাজি, না, আর পড়তে হবেনা। ‘- খুকু বললো-‘ বারাসাত কলেজে ভর্তি হোক, দিদি এতো ভালো লেখাপড়ায়।’- আমি তখন বড়ো আশায় খুকুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। পারলে ঐই পারবে আমায় এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। মা একটু ভেবে বাবাকে বললো -‘ এমন সম্বন্ধ দেখবে যারা মেয়েকে পড়াবে। আমাদের তরফ থেকে এই একটিমাত্র শর্ত থাকুক।
পাত্র পাওয়া গেলো। অতনু মৈত্র। ধানবাদের হীরাপুরের পুরোনো বাসিন্দা। বনেদি পরিবার। সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান, সরকারি অফিসার। জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার গেজেটেড অফিসার। বয়স তেত্রিশ। গম্ভীর ব্যক্তিত্ব। বয়সে চোদ্দ বছরের বড়ো। খুকু আবার ফোঁস করলো। ও জানতো আমার আর কৌশিকের দুর্বলতা। মা বললেন -‘পুরুষমানুষের আবার বয়স কী? তোদের বাবা আমার চেয়ে পনেরো বছরের বড়ো। বোঝা যায়? তা ছাড়া উনি আমার যথেষ্ট খেয়াল রাখেন। বয়সের তফাৎ থাকলে স্বামীর থেকে ভালোবাসাই শুধু নয়, স্নেহ‌ও পাওয়া যায়।’-
ভালোয় ভালোয় বিয়ে হয়ে গেলো। বনেদি বাড়ির বড়ো বৌ আমি। সব সময়ই ভারী ভারীগয়না,শাঁখা-পলাও সোনা বাঁধানো, দামি তাঁতের শাড়ি, টকটকে সিঁদুর আলতায় সাজানো পুতুল হয়ে গেলাম। ধানবাদ মহিলা কলেজে ভর্তি করে দিলেন শ্বশুরমশাই। পাশ‌ও করেছিলাম। স্বামীর স্নেহ ভালোবাসা কতোটা পেয়েছি জানিনা, কিন্তু শাসন পুরোমাত্রায়। মা, বাবা, দাদা সকলেই শুধু খুশি নয় গর্বিত। শ্বশুরবাড়িতে অতনু মৈত্রের খাতির‌ই আলাদা। আমার খুশির খবর কে রাখে!

দেখতে দেখতে পৌঁছে গেছি ধানবাদ স্টেশন। বাড়ির গাড়ি যথারীতি হাজির। আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। এগিয়ে চললাম যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামির মতো নির্দিষ্ট জেলখানার দিকে।
ক্রমশঃ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *