৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ ~ শান্তনু ঘোষ পর্ব-১২

৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ
~ শান্তনু ঘোষ
পর্ব-১২

আগে যা ঘটেছে:
আমার বন্ধু আমাদের রাজশাহীর সপুরা সিল্ক মিলস-এ নিয়ে এসেছে। রাজশাহীর একটি বড় সিল্ক ফ্যাক্টরি। এখানে আমরা দেখলাম কিভাবে ডিম ফুটিয়ে শুঁয়োপোকা হয়। সেই শুঁয়োপোকা থেকে রেশম গুটি ও রেশম সুতো তৈরি করে। তার থেকে তৈরি হয় সিল্কের কাপড়।
এই কারখানার পাশেই আছে বিশাল শোরুম। সেখানে নানা ধরনের সিল্কের জিনিসের সম্ভার। বহু লোক কিনছে। আমরাও কিছু কিনলাম। রাত হয়ে গেছে। এবার ফিরছি পাবনা। অনেকটা পথ যেতে হবে।

তারপর…

গতকাল রাজশাহী ঘোরা হয়েছে। আমি আর কৌস্তভ গিয়েছিলাম। আজ আমি একা যাব শিলাইদহ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি দেখতে। সেখান থেকে যাব লালন সাঁই এর মাজার। এই জায়গাগুলি কুষ্টিয়া জেলার মধ্যে পড়ে। আর আমি এখন আছি পাবনা জেলায়।

কৌস্তভ যেতে পারবে না। ওর অফিস আছে।
সকালে ব্রেকফাস্ট করেই কৌস্তভের সাথে বেরিয়ে পড়েছি। অফিস যাওয়ার পথে ওর গাড়িতে আমাকে রূপপুরে এক হাইওয়ের উপর নামিয়ে দেবে। সেখান থেকেই কুষ্টিয়া যাবার বাস পেয়ে যাব।

আমাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা আরও এগিয়ে চলে গেল। বেশ চওড়া রাস্তা। অনেকটা ফাঁকা জায়গা। একদম ভিড়ভাট্টা নেই।

সামনেই দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। সুবিশাল কর্মকাণ্ড। চারিদিকে সুউচ্চ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। বাংলাদেশ মিলিটারি সদা সতর্ক দৃষ্টিতে পাহারা দিচ্ছে। প্রচুর সৈনিক আধুনিক স্বয়ংক্রিয় বন্দুক হাতে সব সময় চারিদিকে ঘুরছে। সব দেখে মনে হয় যেন যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে।

আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছি। কি বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। বোঝার চেষ্টা করছি। ভাবলাম দূর থেকে একটা ছবি তুলি। এতবড় একটা কাজ, তার নির্মাণের সময়ের ক্ষণিকের সাক্ষী আমি। একটা চিহ্ন অন্তত থাকবে আমার কাছে।

এই ভেবে যেই মোবাইলাটা বার করে ছবি তুলতে যাবো, এমন সময়, যেন শূন্য থেকে হঠাৎ একজন মিলিটারিম্যান সামনে এসে হাজির। বললেন, ছবি তোলা নিষেদ।

আমি তো অবাক। কেউ তো কোথাও ছিল না। আমি এত দূরে দাঁড়িয়ে। ইনি কি করে দেখতে পেলেন যে আমি ছবি তুলতে যাচ্ছি !

একটি খুবই কম বয়সী এক সৈনিক। কিন্তু অতি ভদ্র।
খুব বিনয়ের সাথে নরম গলায় আমাকে বললেন, স্যার, এখানে ছবি তোলা বা দাঁড়িয়ে থাকা নিষেদ আছে। আপনি দয়া করে মোবাইল পকেটে রাখুন আর এখানে দাঁড়াবেন না।

এতে আমি খুব আশ্চর্য হলাম না। এমন নিয়ম হতেই পারে ।
কিন্তু আমাকে সব কিছুর উপরে যা আশ্চর্য করছে, তা হল এই মিলিটারির এত বিনয়ী ভদ্র ব্যবহার।
ভাবছি, ঠিক একই রকম পরিস্থিতে ইন্ডিয়াতে কোন মিলিটারি এলে আমাকে অতি বিশ্রী হিন্দিতে রীতিমত ধমকের সুরে এখান থেকে হটিয়ে দিত।

আমি বলি, আমি তো এত দূরে দাঁড়িয়ে। এখান থেকে একটা ছবি তুললে ভিতরের কিছুই দেখা যাবে না। তাও আপনি মানা করবেন ?
উনি বলেন, এই দেয়ালের ত্রিসীমানায় ছবি তোলা, এমন কি সেল্ফীও নিষেদ।
ভাবছি, বাপরে বাপ ! কি টাইট সিকুরিটি।
আমি আবার জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা ভাই, আপনি বুঝতে পারলেন কি করে যে আমি ছবি তুলতে যাচ্ছি।
উনি দূরের একটা ওয়াচ টাওয়ার দেখিয়ে বলেন, ওখান থেকে আপনার উপর নজর রাখছে। আমাকে ওয়াকিটকিতে বলেছে।
তাকিয়ে দেখি যে, সত্যি, একজন মিলিটারি ওখানে দূরবীন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি স্তম্ভিত।

কৌস্তভের অফিস এরই ভিতরে কোথাও আছে।
আমাকে নামিয়ে ওর গাড়ি সাঁ করে চলে গেল ওই গুঢ় কর্মযজ্ঞের ভিতরে। ওখানে তো সাধারণের প্রবেশ নিষেদ। কিন্তু ওর হাই সিকুরিটি পাস আছে।

রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের কাছে এক বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি বাস। জিজ্ঞেস করি শিলাইদহে যাবে কোনটা? স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলল, ওইটা যাবে। দেখিয়ে দেওয়া বাসে উঠে জানালার ধারে একটা বসার সীট পেয়ে গেছি। বেশ খালি খালিই আছে।
বাসটা খুবই সাধারণ মানের। তবে গদী দেওয়া সীটগুলি, বহুল ব্যবহৃত পুরানো ভাঙ্গাচোরা টুরিস্ট বাসের মত।

বাস ছেড়েছে। কিছুক্ষণ পরে একজন এসে ভাড়া চাইল। বললাম শিলাইদহ যাব। তিনি শুধু বললেন, ত্রিশ টাকা দ্যান।
আমি বলি, ভাইয়া, আমি তো চিনি না। আমাকে ঠিক জায়গায় নামাইয়া দিবেন।
সে শুনল কি শুনল না, ঠিক বুঝলাম না।

আমি জানালার ধারে বসে দেখছি বাংলাদেশের গ্রামের রূপ। আবারো আমার সেই কথা মনে হচ্ছে। কই কোন পার্থক্য তো পাচ্ছি না। এটা পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়। এখানে শুধুমাত্র ঘন ঘন ছোট-বড় নানা ধরণের মসজিদ দেখা যায়।

প্রায় ঘন্টা খানেক পরে বাস একটা বাজার মত ভিড় জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ পেছন থেকে এক যাত্রী আমাকে বলছেন, এইখানে নাইমা যান। আমি পেছন ফিরে দেখি এক যাত্রী আমাকে নামতে বলছেন। বাঃ বেশ তো। তার মানে ইনি আমার কথাগুলো শুনেছেন।

যাই হোক নেমে গেছি। কিন্তু এটা তো শিলাইদহ নয়। জায়গাটার নাম কাউকে জিজ্ঞেস করার আগে আশেপাশের দোকানের সাইনবোর্ডের উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বুঝলাম জায়গাটার নাম মজমপুর ।
যা বাবাঃ, যাবো তো শিলাইদহ। বাস আমাকে এ কোথায় নামিয়ে দিল! আগে তো আমাকে কিছুই বলেনি!

যাই হোক। এক রিক্সাওয়ালাকে দেখে জিজ্ঞাসা করি, ভাই কুঠি বাড়ি যাবো কি করে?
তিনি খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এই মজমপুর থেকে শেয়ার অটো লন। আপনে হেইডায় চৌরহাস পর্যন্ত চইলা যান। ৫ টাকা নিবো। ওহান থেইকা যাইবেন আলাউদ্দীন নগর। সেহান থেইকা শিলাইদহ যাইবার কিছু একটা মিলবো। সব বোঝানোর পরে খুব হাল্কা চালে বললেন, যদি একটা অটো রিজার্ভ করেন তো ৫০০ টাকা নিবো। আর এইভাবে গেলে ৫০ টাকায় হইব। এই বলে খালি রিক্সা নিয়ে নির্বিকার চলে গেলেন। একবারও আমাকে বললেন না যে, আমার রিক্সায় আসেন। একজন মুরগী টুরিস্ট পেয়েও আমাকে কিন্তু মুরগী করলেন না। পুরো ঘটনাটা ওনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দিল। আরে যাহ্, ওনার নামটা তো জানা হল না …।

ওনার দেখানো পথে ঢাকা-কুষ্টিয়া মহাসড়ক দিয়ে দিব্য আলাউদ্দীন নগর চলে এসেছি। মহাসড়ক সোজা চলে গেছে। আলাউদ্দীন নগরের তিনমাথার মোড় থেকে বাঁদিকে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে শিলাইদহ।

আমি একটা মাল বওয়ার সাইকেল-ভ্যানগাড়িতে উঠে বসেছি। ভ্যানগাড়ি আর দু-একজন যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছে। অবশেষে গাড়ি ছাড়ল। এখন বেলা প্রায় সাড়ে দশটা। রোদ আছে বেশ।

এটা মোটামুটি গ্রাম। তবে পীচের রাস্তা বেশ ভাল। ভ্যানে পা ঝুলিয়ে বসে বাংলাদেশ – রবিঠাকুর – তাঁর হারিয়ে যাওয়া জমিদারী – সেই সময়ের জীবন ধারা আর একালের বাস্তব, এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে এসে পড়েছি শিলাইদহে। রাস্তার উপরেই বড় একটা বোর্ডে সবুজ-সাদায় নামটা লেখা আছে।

অবশেষে আমার স্বপ্নের সেই শিলাইদহ। ছোটবেলায় শিলাইদহ নামটার সঙ্গে অজান্তেই অকারণে কেমন যেন জুড়ে গেছিলাম। সেই সময় ভাবতাম, শিলাইদহ হয়ত শিয়ালদহের কাছেই কোন জায়গা হবে।
ভ্যান থেকে নেমে একটু খানি হেঁটে গেলেই কুঠি বাড়ি। এই রাস্তায় তো কবিগুরু একসময় হেঁটেছেন। ভাবতেই আমার বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছে। কিন্তু চারদিক দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে, সেকাল আর একাল, আকাশ আর পাতাল।

আরো একটু নিশ্চিত হবার জন্য একটা দোকানে কুঠিবাড়ি যাবার পথটা জিজ্ঞেস করতেই দোকানদার বলেন, আজ রবিবার। কুঠিবাড়ি তো বন্ধ ! রবিবার ওদের ছুটি।
আমি ভাবি, বাংলাদেশে রবিবার ছুটি !? কি করে সম্ভব !! বাংলাদেশে সরকারী ছুটির দিন তো শুক্রবার।

এক সময় অবশ্য বাংলাদেশে আমাদের মতই রবিবার ছিল ছুটির দিন। কিন্তু হুশেন মহম্মদ এরশাদ ১৯৮৮ সালে এইটা বদলে দিয়ে শুক্রবার ছুটির দিন করে দেয়। এরশাদ শুধু এইটুকুই নয়, বাংলাদেশকে এক পাকাপোক্ত ইসলামিক দেশ করার জন্য আরো অনেক কিছু করেছে। সে অন্য গল্প। তিনি ইসলামকে ষ্টেট রিলিজিয়ন ঘোষণা করেন। এরশাদ বিদায় নেবার পরে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কেউই আর এই বিষয়টিতে হাত দিতে চায়নি, বা কোন বদল আনেনি।

কিন্তু আমার এখন অন্য চিন্তা হচ্ছে।
এত দূর এসে শেষ পর্যন্ত কুঠি বাড়ি দেখা হবে না !! মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। হায় ভগবান !!

ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *