লকডাউন_জীবনযুদ্ধ_ কলমে —- ব্রতশ্রী
লকডাউন_জীবনযুদ্ধ_
কলমে —- ব্রতশ্রী
প্রথম পর্ব ( ক্রমশঃ )
এই দু-তিনদিন ধরে রাতে একেবারেই ঘুম হচ্ছে না সৌগতর। প্রেসার এবং সুগার দুটোই বাড়ছে চড়চড়িয়ে। পরশুদিনের আগের দিন অফিসের মেইলটা পেয়েছে সৌগত। কোম্পানি টোটালি শাটডাউন। কবে রিওপন হবে কিছুই বলা যাচ্ছে না। তার ওপর বাইরে বেরিয়ে অন্য কোন চাকরির চেষ্টাও করতে পারবে না সে। কোভিড বাড়ছে , লকডাউন চলছে সারাদেশ জুড়ে। অন্য অনেক কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু তার ক্ষেত্রেও যে এরকমটা হবে তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না সৌগত। তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে , গত তিনদিন ধরে সে ভালো করে খেতে পারেনি , ঘুমোতেও পারেনি। স্বাতীকে এসব কথা বলে আর টেনশন দিতে চায়না সৌগত। এমনিতেই বউটা সারাটা দিন অমানুষিক পরিশ্রম করে। সারাদিন সবার রান্না করা , সংসারের যাবতীয় কাজ করা , বাবার খেয়াল রাখা , মিঠির পড়াশোনা দেখা সমস্ত দায়িত্ব ওরই। কাজের লোকটাও পর্যন্ত এই লকডাউনে ছাড়িয়ে দিয়েছে স্বাতী। ওর মুখের দিকে তাকানো যায় না ; এতটাই ক্লান্ত বিধ্বস্ত লাগে আজকাল ওকে। তার ওপর এই খবরটা জানলে কিভাবে রিঅ্যাক্ট করবে ভগবান জানেন। তার থেকে ওকে না বলাই ভালো , বরং গোপনে অন্যত্র কাজের চেষ্টা করতে হবে। বাড়িভাড়া , ইলেকট্রিসিটি বিল , গ্যাস , ক্লাস ফোরের মেয়ে মিঠির স্কুলের মাইনে , সংসারের খাবার খরচ , অন্যান্য যাবতীয় খরচ , বাবার ওষুধ , চেকআপ , সারা মাসের সমস্ত খরচ মিলিয়ে নয় নয় করে হলেও প্রায় তিরিশ-বত্রিশ হাজার টাকা। এতগুলো টাকার ব্যবস্থা সে কি করে করবে প্রত্যেক মাসে!! চিন্তায় টেনশনে মাথা খারাপ হয়ে যায় সৌগতর। আপাতত সপ্তাহে দুদিন মাছ এবং তিন দিন ডিম ধার্য করা হয়েছে আর বাকি দুদিন নিরামিষ। চিকেনের দামটা একটু বেড়ে গেছে হঠাৎ করেই। সৌগত পাতে নেয় না , স্বাতীও নানান অজুহাতে চিকেন খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে আজকাল। চিকেনটা শুধু বাবা আর দশ বছরের মেয়ে মিঠির জন্যই বরাদ্দ থাকে। কিন্তু কে জানে এত টাকার ব্যবস্থা কি করে হবে!! নামজাদা আইটি কোম্পানির সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার সৌগতর মানসিক চাপ ক্রমেই বাড়ছে।
পরদিন একদম সকালেই বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেল সৌগত। স্বাতী কোনোমতে একটু ডাল-আলুসেদ্ধ-ডিমসেদ্ধ দিয়ে ভাত রান্না করে দিল। আট বছর আগে একটা ইভেন্টে কোলকাতায় পরিচয় হয়েছিল অখিলেশের সঙ্গে। তাদের দুজনের কমন ফ্রেন্ড কেউ নেই এইটাই সুবিধা , অখিলেশ সৌগতর পরিবার , আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুবান্ধব কাউকেই চেনে না। ভীষণ তুখোড় , কর্মঠ এবং প্রবল বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন একটি ছেলে সে। এই সময় অখিলেশের সঙ্গে আলোচনা করা ভীষণ দরকার। আর একটুও দেরি করা ঠিক হবে না।
কাজটা নিয়ে একটু কিন্তু-কিন্তু করছিল সৌগত। কিন্তু অখিলেশ তাকে বোঝালো এই লকডাউনের সময় এর থেকে ভালো কাজের সম্ভাবনা আর নেই এবং যোগাযোগও নেই। এই লকডাউনের সময় যদি চাকরি চলে যায় তবে যার যেটা আছে সেটা ভাঙিয়েই তাকে খেতে হবে। আর তার জন্য অখিলেশের যা যা নেটওয়ার্ক আছে সে সৌগতকে সেই সবকিছু দিয়েই হেল্প করবে। সমস্ত দিন ধরে বন্ধু অখিলেশের সঙ্গে তার জল্পনা কল্পনা চলে। দুপুরবেলা একটা পাইস হোটেলে তারা নিরামিষ ভাত খায়। ব্যবসার জন্য অন্য একটা সিম নিতে হবে সৌগতকে যার নাম্বার শুধু কাস্টমাররা ছাড়া অন্য কেউ জানবে না। লিফলেট , কার্ড ইত্যাদির ব্যবস্থা অখিলেশ আপাতত নিজের টাকা দিয়ে করে দেবে , পরে টাকা পেয়ে তাকে শোধ করে দেবে সৌগত। অখিলেশের এলেম আছে বলতে হবে। তার চেষ্টায় সৌগত বিকেলের দিকে একটা কাজ পেয়েও যায়। তিন ঘন্টায় কড়কড়ে পাঁচ হাজার টাকা। মনটা খুশি হয়ে যায় সৌগতর। একটা সম্ভাবনা দেখতে পায় সে। ফেরার পথে স্টেশন বাজার থেকে সে একটু বাজার করে। মাছ চিকেন সবজি ডিম দুধ সবকিছু তো নেয়ই , সঙ্গে প্লাটফর্মের ধারে বসা মনোহারী দোকান থেকে স্বাতীর জন্য চারগাছা সিটি গোল্ডের চুড়ি , একটা চেন , একটা মঙ্গলসূত্র , একজোড়া ঝকঝকে পাথর বসানো কানের দুল আর টিপের পাতা। স্বাতীর লিকুইড সিঁদুরটা ক’দিন ধরে শেষ হয়ে গিয়েছে বলছিল। ভালো কোম্পানির একটা লিকুইড সিঁদুরও নিয়ে নেয় সে। অন্য একটা দোকান থেকে ভালো দেখে দুটো নাইটিও কেনে স্বাতীর জন্য। ওর ঘরে পরার নাইটিগুলো রং চটে একেবারে খারাপ অবস্থা হয়ে গেছে , চোখে দেখা যায় না। সঙ্গে একজোড়া গোলাপী রঙের হাওয়াই চটি। ছোট্ট একটা কালো ফোমলেদারের টাকা রাখার ব্যাগ। একটা ছোট জুঁই ফুলের সুগন্ধি পারফিউম। একটা ফেয়ার এন্ড লাভলী, একটা ফেস পাউডার। মিঠিকে অনেকদিন তার পছন্দের ক্যাডবেরি কিনে দেওয়া হয়নি। সেটাও নিতে ভোলে না সৌগত। মিঠির অনলাইন প্রজেক্টের জন্য কয়েকটা জিনিস লাগবে বলছিল সেগুলো নিয়ে নেয় সে। বাবার সুগার আর প্রেশারের ওষুধ খাওয়া হয়নি দিন পনেরো হয়ে গেল। কালকে সকালে মনে করে ওষুধের দোকান থেকে ওটা নিতেই হবে। আর বাবার ভোলিনি জেলটা শেষ হয়ে গেছে। ওটাও একটা নিয়ে নেবে।
রাতে রুটি খাওয়ার পর মিঠি তার পছন্দের ক্যাডবেরি পেয়ে খুশি হয়ে যখন বাবার ঘরে শুতে চলে যায় তখন সৌগত স্বাতীর জন্য যে জিনিসগুলো লুকিয়ে রেখেছিল সেগুলো স্বাতীর হাতে দেয়। প্যাকেট খুলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে স্বাতী। জিনিসগুলো বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে। আনন্দে বাচ্চা মেয়ের মত খুশিতে ভরে ওঠে সাথী। অনেকদিন বাদে সেদিন কাছাকাছি আসে স্বাতী আর সৌগত। (চলবে)