আত্মজা ———- পর্ব -৯ ✒️সুদেষ্ণা সিনহা

আত্মজা
———-
ধারাবাহিক উপন্যাস
অধ্যায় -৯
সুদেষ্ণা সিনহা

ফুল দিয়ে সাজানো খাট,মাথার উপরে উঁচু করে বাঁধা গোলাপের ঝাড়।রজনীগন্ধার চেন উঁচু থেকে নীচে ঝুলে আছে।
অলোকের ঘরের চারপাশে একবার চোখ ঘুরিয়ে নেয় স্বাধীনতা। ঘরের একপাশে একটা সেগুন কাঠের খাট, সুক্ষ্ম নকশা,মুখে মুখ লাগিয়ে পেখম তুলে দিয়েছে দুটো ময়ূর। কালচে কাঠ রঙে পালিশ করা।খাটের পাশেই বড় জানলাটা ভিতর থেকে বন্ধ করা আছে। খাটের উল্টোদিকে দেওয়াল জুড়ে বই এর আলমারি,তাতে নানান ধরনের বই।  পাশে ছোট টেবিলে গ্রামোফোন রেকর্ড। আরো দুই একটা টুল,চেয়ার,ছোট একটা পড়ার টেবিল ,আর চেয়ার ঘরের আর এক পাশে দেওয়াল ঘেঁসে রাখা আছে।
বিয়ের আগে অলোক দেখতে এসেছিল স্বাধীনতাকে।বৌদি বলেছিল,যা কিছু তোমাদের নিজেদের জানার আছে, জেনে নাও এই বেলা।আমি পাহারা দিচ্ছি।কেউ আসবে না। তবুও আড়ষ্ট হয়ে বসেছিল স্বাধীনতা।অলোক যেটুকু জানতে চেয়েছে,সেটুকুর শুধু উওর দিয়েছে।নিজে থেকে কোন প্রশ্ন করেনি তাকে।
পাত্র স্কুলে শিক্ষকতা করেন। স্কুলের শিক্ষকতার চাকরিতে বেতন তেমন কিছু নয়,তবে সম্মানজনক চাকরি। কে যেন সম্বন্ধ এনেছিল মায়ের কাছে।
মা আগেকার দিনের মানুষ।বাবার মতো তার শিক্ষাদীক্ষা,সংস্কার কোনটিই নেই।মা চাইছিলেন,স্বাধীনতার বিয়ে হোক,সংসার হোক।তিনি চোখ বুঁজলে কে দেখবে আইবুড়ো মেয়েকে!শশীকান্তের বিয়ে হয়েছে,সংসার হয়েছে সেই বা কতদিন বোনকে দেখবে!
স্বাধীনতার স্কুল বহরমপুরের কাছেই।পাত্রের স্কুল বহরমপুরের খুব কাছে না হলেও বাসে করে বহরমপুর থেকে যাতায়াত করা যাবে।ইচ্ছে হলে পাত্রকে বিয়ে করে স্বাধীনতা  বহরমপুরে সংসার পাততে পারবে,আবার চাকরি বজায় রাখতেও পারবে।
দেখতে এসে অলোক বলেছিল,আপনি আমার সম্বন্ধে কতটুকু জানেন জানি না।তবে একটা কথা আমার বলা উচিৎ মনে করছি —আমার বাবা নেই,মা আর অবিবাহিত দুই বোনের দায়িত্ব আমার।তাদের ছেড়ে বউকে নিয়ে একা একা সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। স্বাধীনতা মনে মনে বলেছিল,একি বলছেন!কেউ মাকে,বোনদের একা রেখে চলে যেতে পারে?না সে কাজ করা উচিৎ।  বাবা হলে বলতেন,গর্ভধারিনী মা,তিনি তো সাক্ষাৎ দেবী —তাঁকে কি অবহেলা করতে হয় মা! জীবনভর তোকে এই শেখালাম!
স্বাধীনতা মুখে বলেছিল, তা কেন হবে?আপনি যেখানে থাকবেন,সেখানেই আপনার মা,বোনদের রাখবেন।এটাই তো উচিৎ ।

বিছানার ফুল সরিয়ে বিছানার চাদরটা পরিস্কার করছিল স্বাধীনতা। বেনারসীর কাপড়,ব্লাউজ ,ফুলের গয়না খুলে রেখে সে একটা লাল ফুল ফুল ছাপা শাড়ি পরে নিয়েছিল।মাথার মুকুট,গলার জরোয়া হার,সাতনরী হার,কানের ভারী দুল,হাতের বাউটি,বালা খুলে একটা ব্যাগের মধ্যে রেখেছিল।এত সব গয়না পরে কি ঘুমানো যায়!
বিছানার এক কোণে বসে অলোকের জন্য প্রতীক্ষা করছিল সে।
ঘরের হুড়কোটা তুলে দিতে দিতে অলোক বলে,এখনও বসে আছ?ঘুমোওনি তুমি এখনও?
মাথা নাড়ে স্বাধীনতা।
—– না।
—–আচ্ছা আমি আসছি।
বিছানা থেকে নেমে গড় হয়ে অলোককে প্রণাম করে স্বাধীনতা। অলোক ব্যস্ত হয়ে পা সরিয়ে নেয়,একি! একি করছ! অলোক লাল ভেলভেটের একটা চৌকো বাক্স থেকে বের করে আনে সোনার আংটি।পরিয়ে দেয় স্বাধীনতার বাঁ হাতের অনামিকায়। স্বাধীনতার বাঁ হাত তুলে আলতো করে একটা চুম্বন করে অলোক।
—নাও এবার শুয়ে পড়।
আলো নিভিয়ে দেয় অলোক।

সে এক আশ্চর্য অনুভূতি! আশ্চর্য সেই স্পর্শ!তার বত্রিশ বছরের জীবনে এমন রঙীন বসন্ত আসেনি কোনদিন! তার নারীদেহ পুরুষের স্পর্শে শিহরিত হয়ে উঠল  নিমেষেই। শরীর জুড়ে শিরশিরে স্পন্দন! আবেশে চোখ বুঁজে এল। শরীর জুড়ে উন্মত্ততা!সে জানত না যে শরীরও কথা কয়,একদম মানুষের মতো করে।ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে অলোক জড়িয়ে ধরেছে স্বাধীনতাকে। অলোকের গোঁফের খোঁচায় তার গালে খোঁচা লাগে। ধীরে ধীরে তার অধর নিংড়ে রস শুষে নিচ্ছে নেয় অলোক একটু একটু করে ।
—–তোমায় ভালবাসি…
—– উউঁ
—–তুমি?
—–উহহ্
—-কি হল?ভাল লাগছে আজকের রাতটা? বললে না তো? আমায় ভালোবাস?
একটু একটু করে অলোকের ভালবাসার কাছে নতি স্বীকার করে স্বাধীনতার শরীর । ওর চোখে মাদকতা। চুলগুলো উসকে খুসকো । পাগলের মতো স্বাধীনতার হাত দুটোকে জড়িয়ে দেয় অলোক তার শরীরের উপরে।
—আমায় ভালবাস…আমায় আদর কর…
দুই হাতে অলোকের শরীরকে জড়িয়ে ধরে স্বাধীনতা ।মিশে যায় অলোকের শরীরে।
মানুষটা এত দুঃখী!কি কষ্ট ওর!ভালবাসা পায়নি কোনদিন!আমি ওকে ভালবাসব। ওকে ভরিয়ে দেব।আমি তোমার!আমি তোমারই!চিরদিন তোমায় ঘিরে থাকবে আমার ভালবাসা। সব কথা কি বলা যায়!আমি মুখে ভালবাসার কথা বলতে পারি না।লজ্জা পাই।তাই বলে স্বামীকে ভালবাসব না!তুমি যে আমার।শুধু আমার!শুধু আমার!
এতদিনের অনাবাদি জমিতে কর্ষিত হয় ভালবাসার প্রথম ফসল।

কখন যে সকাল হয়ে গেল! বাইরের আলো ঘরে ঢুকতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসে স্বাধীনতা। বাড়ির সবাই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে বুঝি এতক্ষণে।ইস্ কতক্ষণ শুয়ে আছে বিছানায়!কাল রাতে শুতেও অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল! বিছানায় চোখ পড়ে তার।ওমা বালিশে মাথা রেখে কি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে মানুষটা!মাথার চুলগুলো এলোমেলো। কি কান্ড! ওর গালে,কানের লতিতে যে সিঁদুর লেগে! ছিঃ ছিঃ!কাল রাতে নির্ঘাৎ তার মাথা থেকে সিঁদুর লেগে গেছে! পরনের  ছাপা শাড়ির কোণ দিয়ে আলতো হাতে সিঁদুরগুলো মোছার চেষ্টা করে। সিঁদুর মুছলেও লাল দাগ থেকে যায়।একবার মানুষটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে খুব ইচ্ছে করে!না না থাক বাবা,কিছু মনে ভাবে যদি!
কাল রাতের কথা মনে পড়তেই লজ্জা পায় স্বাধীনতা। ভালবাসায় ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়েছে মানুষটা।কে বলবে কালই দেখা হয়েছে ওদের!
মা বলেন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক।
স্বাধীনতার বউদি,নমিতা তারই বয়সী। বোনের বিয়ের  ব্যবস্থা করতে গিয়ে বার বার ব্যর্থ হয়েছ শশীকান্ত।কিছুতেই বিয়ে করতে রাজী হচ্ছিল না স্বাধীনতা। কত বার যে পাত্রপক্ষ তার বোনকে দেখতে এসে ঘুরে গেছে।
একদিন নমিতার খুব রাগ হয়েছিল স্বাধীনতার উপর।
নমিতা বলেছিল , ঠাকুরঝি তুমি বিয়ে করতে চাইছ না তো।কিন্তু জেনে রাখ,স্বামীর ভালবাসা অমূল্য সম্পদ ।মেয়েরা তাদের সব কিছু ছেড়ে কেবল মাত্র স্বামীর ভালবাসা নিয়েই বাঁচতে পারে।বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেলে দেখবে সেই ভালবাসা পাওয়ার জন্য তোমাকে আপশোষ করতে হবে একদিন।
বিছানা থেকে নীচে নামবার সময় পরম যত্নে অলোকের পায়ের তলা থেকে চাদরটা ওর গায়ে তুলে দেয় স্বাধীনতা। তারপর একপাশ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে পা দেয় সে।ঘরের একপাশে লম্বা আয়নায় তার প্রতিবিম্ব দেখা যায়।
সিঁথিময় মেটে সিঁদুর সিঁথির চারপাশে ছড়িয়ে কপালে,নাকে নেমেছে। আয়না দেখে আস্তে আস্তে নাক,কপাল পরিস্কার করে নেয় স্বাধীনতা। শাড়িটা ঠিক করে পরে নেয়।তারপর দরজার হুড়কোটা খুলে দেয়।
মা বলেন,বিছানার কাপড়ে সংসারের কোন জিনিস ধরতে নেই। প্রথমে টুথপেস্ট ব্রাশে লাগিয়ে নেয় সে। গামছা আর কাচা শাড়ি বাথরুমের দড়িতে রেখেছে সে।উঠোনের একপাশে টিউকল।লোহার বালতিতে জল ভরে বাথরুমে ঢোকে স্বাধীনতা।একেবারে স্নান সেরে পুজোর ঘরে ঢোকে সে।
বাড়িভর্তি অনেক আত্মীয়স্বজন। মাথায় ঘোমটা টানে স্বাধীনতা।মা বলেছেন,বড়দের সম্মান জানাতে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম কোরো মা। আর শ্বশুর,ভাসুরের সামনে মাথায় কাপড় দেবে।
সকালের চা হবে।রান্নাঘরে স্টোভ জ্বেলে চায়ের জল বসায় সে।
বাড়ির সকলের ঘুম ভাঙেনি তখনও।কাল বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে মধ্যরাত্রি।রান্নার বাসনকোসন নামানো আছে উঠোনের একপাশে। কাজের মাসি এসে সে সব পরিষ্কার করবে।
শাশুড়ি মা এক গাল হেসে বললেন,বৌমা উঠে পড়েছ দেখছি। কাল অসুবিধা হয় নি তো?
স্বাধীনতা মুখ নীচু করে মাথা নাড়ে।
স্বাধীনতা এমনই একজন মেয়ে যে খুব সহজে সকলের সঙ্গে মিশতে পারে না।মানুষের সঙ্গে মিশতে তার সময় লাগে।খুব মনের মিল হলেও সে ধীরে ধীরে প্রিয় মানুষের কাছে আসে।নিজের মনের কথা বলতেও অনেক ভাবতে হয় তাকে।
ছোটবেলায় বাবারও নাকি এইরকম স্বভাব ছিল।খুব স্বচ্ছন্দে সকলের সঙ্গে মিশতে পারতেন না তিনিও।    বাবা বলতেন,আমাদের ছেলেমেয়েরা এইরকম চাপা স্বভাবের। চট করে সকলের সঙ্গে মিশতে পারে না।

টিঙ্কু আর মুন্নি– দুই ননদ জড়িয়ে ধরল স্বাধীনতাকে,বউদি এসে গেছে।মা এবার কিন্তু আমরা কোন কথা শুনব না।বৌদিকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাব ।তুমি নিষেধ করতে পারবে না।
অলোকদের বাড়িটা তাদের মতো বড় নয়।সাবেকি আমলের দোতলা বাড়ি।উপর-নীচ মিলে পাঁচটা ঘর।রান্না আর খাওয়ার ব্যবস্থা নীচে। উপরে তিনটে শোওয়ার ঘর। সব থেকে বড় ঘরটা অলোকের। শাশুড়িমার ঘরে দুটো খাট এক সাথে জোড়া দেওয়া হয়েছে। তার ঘরে পুরানো আমলের লোহার সিন্দুক রাখা আছে একটা। অন্য ঘরটা দুই ননদের । বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন এলে অলোকের মা,বিমলাদেবী ঘর ছেড়ে মেয়েদের ঘরে চলে যান।
ননদদের ঘরে একটাই খাট। এক পাশে বেঞ্চের উপর থরে থরে ট্রাঙ্ক সাজানো।ট্রাঙ্কে পরিবারের সকলের শাড়ি,জামাকাপড়,শীতের জামাকাপড় সাজিয়ে রাখা আছে। ঘরের একপাশে বাড়তি বিছানাগুলো টেবিলের উপর গুছিয়ে রাখা থাকে।
ঘর থেকে বেরিয়ে এল অলোক। মাথায় ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়েছিল স্বাধীনতা।চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নেয় সে।
একটা নতুন ভাল লাগা আচ্ছন্ন করে রাখে তাকে।জীবনের বাঁকে বাঁকে কত রহস্য থরে থরে সাজানো।কে ভেবেছিল তার একটা নতুন সংসার হবে,তাকে নিয়ে ভাববার লোক হবে,তাকে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেবে কেউ!
এইই, আমাকে কড়া করে এক কাপ চা দিও তো।অলোকের ডাকে অন্যমনস্কতা ভাঙে স্বাধীনতার।
—– আচ্ছা। দিচ্ছি।
অলোকের চোখে চোখ পড়ে স্বাধীনতার। ঘোমটার ফাঁক দিয়ে সে অপলক চেয়ে থাকে তার ভালবাসার মানুষটার দিকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *