‘এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি : এক অসম্পূর্ণ জীবন’,২য় পর্ব : গীতালি ঘোষ
‘এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি : এক অসম্পূর্ণ জীবন’,২য় পর্ব : গীতালি ঘোষ
তান্ত্রিক শক্তিতে বিশ্বাসী হয়ে এ্যান্টনি সাধনার পথে নেমে আসেন। সাধনায় কুন্ডলিনী জাগ্রত হয় তার। শাক্ত কবি রামপ্রসাদের শ্যামাসঙ্গীত তার মনকে উদ্বেল করে। এছাড়াও স্থানীয় বাঙালি কবিদের সাধনসঙ্গীত তাকে অত্যন্ত আকৃষ্ট করেছিল। তার হৃদয়ে এই গানগুলি গভীর ছাপ ফেলেছিল কিন্তু সেগুলির মর্মে প্রবেশ করার মত শক্তি তার তখন ছিল না, কারণ ভাষার প্রতিকূলতা। তিনি সেই সময়ে কবিদের সঙ্গ করতেন, তাদের ভাষা বোঝার চেষ্টা করতেন। নানা স্থানে বহু যোগীর সঙ্গে তিনি মেলামেশা করেন। ছিলিমে টান দিলে তার বুদ্ধিতে শাণ পড়ত। তারপর তিনি কঠোর যোগ সাধনায় মন দেন।
এ্যান্টনি সাহেব বাংলার প্রেমে পড়েছিলেন। এরপর থেকেই তিনি গভীর অভিনিবেশ সহকারে বাংলা ভাষা শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। কঠোর অনুশীলনের ফলে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি শিক্ষিত বাঙালির মতোই বাংলায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। এ্যান্টনির মনের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল কবিত্ব।তাই শক্তি সাধনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রচনা করেন মাকালীর বন্দনাগীত। সেই সঙ্গীত ছিল ঘোর আধ্যাত্মিক ভাবসম্পন্ন। কিছু মানুষের এ গান ভালো লাগতে শুরু করে। বাংলার উৎসব, অনুষ্ঠান, সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে এতটাই ভালোবেসেছিলেন এ্যান্টনি, যে মা দুর্গার চারদিনের জন্য পিত্রালয়ে আসার যে উৎসব–দুর্গাপূজা— তা তাকে খুব আকৃষ্ট করেছিল। তার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে তিনি অনেক উৎকৃষ্ট আগমনী গানও রচনা করেন। কিন্তু তথাকথিত ব্রাহ্মণ সমাজ তার এই প্রচেষ্টাকে কখনোই ভালো চোখে দেখেনি। বারেবারে নানা উপায়ে তারা এ্যান্টনির মনোবল ভাঙার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তিনি তার অদম্য মনের জোরে এগিয়ে যেতে সমর্থ হন। তার সাধনা এবং গীত রচনা অব্যাহত থাকে। তাঁর রচিত একটি আগমনী গানের উদাহরণ….
“জয়া যোগেন্দ্র-জায়া, মহামায়া, মহিমা অসীম তোমার।
একবার দুর্গা দুর্গা দুর্গা বোলে যে ডাকে মা তোমায়,
তুমি করো তায় ভবসিন্ধু পার।”
ভাবলে অবাক হতে হয়, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী এক মানুষ তার প্রাণপণ চেষ্টায় এবং মনের টানে কেমন করে সম্পূর্ণ পৃথক এক ধর্মাচরণে আত্মনিয়োগ করেন। বহু বাধার সম্মুখীন হয়েও তিনি কখনোই দমে যাননি। সেখানেই ওনার অসম্ভব চারিত্রিক দৃঢ়তার সন্ধান পাওয়া যায়।
বাংলার বাবু সমাজে তখন কবিগানের চর্চা অত্যন্ত প্রবলভাবে শুরু হয়েছে। কবিগান হল বাংলা গানের একটি শাখা… প্রকৃতপক্ষে গানের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই। সাধারণ মানুষের চিত্তবিনোদনের জন্য শিল্পী কবিরা আসরে তাৎক্ষণিক গান বাঁধতেন, অন্যদল প্রত্যুত্তর করতেন…সবই গানের মাধ্যমে। দর্শকশ্রোতারাই জয়পরাজয় বিচার করত। এখানে সাধারণত বেদ পুরাণ রাধাকৃষ্ণ লীলা ইত্যাদি থেকে বিষয় নির্বাচন করে কবিরা গান বাঁধতেন। সেকালের এই জনপ্রিয় কবিগানের দিকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন এ্যান্টনি। তিনি বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রার কাছে কবিগানের শিক্ষা গ্রহণ করতে চেয়ে ব্যর্থ হন তার বিদেশী তকমার জন্য। এ্যান্টনি তার অদম্য মানসিক জোর এবং প্রাণশক্তির বলে আপন প্রচেষ্টায় শেষপর্যন্ত বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিয়াল রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। (চলবে)