# সীমান্ত # পর্ব – ৮ কলমে – অরণ্যানী
# সীমান্ত # পর্ব – ৮
কলমে – অরণ্যানী
মিনুর বাড়ি :- মিনুর মা উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে। বাবা দাওয়ায় বসে। অলোক পাশের ঘরের বিছানায় সম্ভবত জেগে। আর একটা ঘরে মেঝেতে বিছানা পেতে ঝিনুক আর মিনু ঘুমোচ্ছিল। মিনুর পাশে শুয়ে তার বিড়াল ছানা। হঠাৎ কোনো একটা শব্দে মিনুর ঘুম ভাঙল। উঠে বসে দেখে বিড়াল ছানা লুল্লু বমি করছে। ঝিনুক ধরমড় করে উঠে বসল। মিনু অসহায় চোখে লুল্লুর দিকে চেয়ে।
ঝিনুক – ইস্, কী বিচ্ছিরি কান্ড। আমি কতদিন বারণ করেছি বিছানায় বিড়াল নিয়ে শুতে।
ছলছল চোখে মিনু — তুই চুপ কর। ওর কী হয়েছে?
ঝিনুক – এখন কী হবে? বিছানার চাদর তুই কাচবি। আমি কিন্তু পারব না।
এদিকে লুল্লু বমি করার পর অসুস্থ বোধ করছে। সম্ভবত আবারও করবে।
মিনু কান্না জড়ানো গলায় চিৎকার করে উঠল – আমি জানি না। তুই যা। আমি কিচ্ছু পারব না। আমার ভালো লাগছে না।
ঝিনুক ঘেন্নায় নাকমুখ সিঁটকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। চিৎকার শুনে আলোক এসে ঘরে ঢুকল।দেখলো মিনু ওর লুল্লুকে কোলে জড়িয়ে রেখে মাথায় হাত বোলাচ্ছে, আর অঝোরে কাঁদছে।
অলোক – চাদর গুটিয়ে রেখে দে উঠোনের ধারে। আমি এসে পরে কেচে দেবো। অলোক ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
মা উঠোন থেকে চেঁচিয়ে বললো – সকাল থেকেই দু’বোনে ঝগড়া বেধে গেল? আর দু’দিন পর তো একজন চলেই যাবে। ঝিনুক ততক্ষণে উঠোনে বেরিয়ে এসেছে।
মা – ঝিনুক দেখ, সকালে পান্তা ভাতের সঙ্গে কী করবি। মিনু আর অলোক তো বোধহয় এখনই অস্ত্রশিক্ষা নিতে যাবে।
ঝিনুক – দেখো গে। মিনু এখন বিছানার চাদরে বিড়ালকে বমি করাচ্ছে আর কাঁদছে। আজ আর অস্ত্রশিক্ষা নিতে গেলে হয়। মা ঠিক কিছু বুঝল না। ঝাঁট দেওয়া শেষ করে হাতের ঝাঁটা উঠোনের একপাশে রেখে ঝিনুকের মুখের দিকে চেয়ে রইল। মিনুর বাবা নির্বিকার চিত্তে দাওয়ায় বসে বিড়ি টানতে লাগলো।
ঝিনুক – ওই বমি করা চাদর তোমার ছোট মেয়েকে দিয়ে কাচিও।
অলোক প্রাতঃকৃত্য সারবার জন্য উঠোন পার হয়ে যেতে যেতে বললো – এতো ঝগড়া কেন করছিস? বললাম তো কেচে দেবো। এতো চেঁচালে দু’দিনে তোর বর পালাবে।
ঝিনুক – তুই চুপ কর। তোর তাতে কী? যেখানে যাচ্ছিস যা।
অলোক – একেবারে নদী থেকে নেয়ে এসে খেয়ে বেরিয়ে যাব।
মা – কী হয়েছে? মিনু বমি করেছে? বিছানায়?
ঝিনুক — না, ওর বিড়াল। বাবা সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে কী হয়েছে বোঝার চেষ্টা করছে। সম্ভবত বুঝেও যাচ্ছে।
মা – তা ঘরে কেন? বাইরে বের করে আনুক।
ততক্ষণে মিনু লুল্লুকে কোলে করে উঠোনের আম গাছটার নিচে নিয়ে এলো। লুল্লু ওখানেও খানিকটা বমি করল।
ঝিনুক বালতি থেকে জল নিয়ে দাঁত মেজে, মুখ হাত ধুয়ে ঘরে চলে গেল।
মিনুর মা শোভা – মিনু, ও ওখানে শুয়ে থাক। পরে ঠিক হয়ে যাবে। যা, হাতমুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নে। তোকে তো আবার যেতে হবে। শোভাও ঘরে চলে গেল।
হীরন (মিনুর বাবা) – আমিও খেয়ে মাঠে যাব।
শোভা – অস্ত্রশিক্ষা নিতে?
হীরন – সকাল থেকে অস্ত্রশিক্ষা নিলে চাষের কাজ কে দেখবে? দেখি, বিকেলে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারলে একটু প্র্যাকটিস করে নেবখন। রান্নাবান্না সেরে তুমি পারলে একবার ক্ষেতে যেও। অলোকও থাকবে না। সব্জি বসাব।
শোভা – ঠিক আছে। ঝিনুক যদি ঘরের কাজগুলো দেখে, তবে তো আমি যেতেই পারি।
হীরন – ও আর ক’দিন?
শোভা – তবু যে ক’দিন আছে। রোদের মধ্যে চাষের কাজে তো ওকে পাঠানো যায় না। দু’দিন পর বিয়ে। গায়ের রঙ তো যাবে পুড়ে। ওদিকে অলোকও তো গণসেনায় যাবে। সারাদিন অস্ত্রশিক্ষাই তো ওকে করতে হবে। ভাবতেও কী ভয় লাগে। হ্যাঁ গো, যুদ্ধ করতে গেলে কিছু তো হয়ে যাবে না?
হীরন – চিন্তা করে কী করবে? আরো অনেকে তো যাবে। বিজয়ও তো যাবে শুনছি। এদিকে যুদ্ধে চাষের ক্ষেত যদি নষ্ট হয়, এতগুলো মানুষ খাবে কী? সে চিন্তাও তো আছে।
মিনুর মা ঘরের ভেতর থেকে, বাবা দাওয়া থেকে কথা বলে যাচ্ছিল। ঝিনুক রান্নাঘরে রান্না করছিল। মা ঘর বাড়ি পরিষ্কার করছিল।
ওদিকে লুল্লু উঠোনে বমি করতে লাগলো কিছুক্ষণ পর পর। মিনু তার সেবা করে চলল। অলোক ঘরে এসে ঢুকল। কিছু বুঝল না। ভাবল অন্যদিনের মতো মিনুর বিড়াল আদর চলছে। উঠোনের গেট খোলা। গেটের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল কবিতার বোন সুজাতা। মিনুর বিড়াল ছানাকে দেখে গেট ঠেলে ভেতরে এলো। মিনু করুণ মুখে লুল্লুকে নিয়ে বসে আছে। অলোক খাওয়া দাওয়া সেরে অস্ত্রশিক্ষার পোশাক পরে বাইরে এলো।
অলোক – কী রে, যাবি না? তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া করে জামা প্যান্ট পরে চলে আয়। চানও তো করলি না। অলোক বেরিয়ে গেল। লুল্লু হঠাৎ আবারও বমি করল।
মিনু – কী হবে? ও কি মরে যাবে? মিনুর চোখ থেকে জল পড়তে থাকল।
সুজাতা – বিড়াল বমি করলে কিছু হয় না মিনুদি। একটা বিড়াল তো প্রায়ই আমাদের উঠোনে বমি করে দিয়ে যায়। কই, কিছু তো হয় না?
মিনু – ও তো খুব ছোট।
সুজাতা – কেন, কুকুর ছানাও তো ছোট হয়। ওরাও বমি করে। একরকম ঘাস আছে, ওগুলো খেলে ওদের অসুখ সেরে যায়। আমি নিয়ে আসি? এই বলে সুজাতা দৌড়ে চলে গেল। মিনু গভীর দুশ্চিন্তা নিয়ে লুল্লুকে কোলে করে বসে রইল।
মিনুর মা বাইরে এসে মিনুকে ওভাবে বিড়াল কোলে নিয়ে বসে থাকতে দেখে বললো — কী হয়েছে?
মিনু অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিল — লুল্লু বোধহয় আর বাঁচবে না। একদম নেতিয়ে গেছে ।কী হবে?
মা — এতো বড় হয়েছিস – – – এখন আর বিড়ালের জন্য কান্না মানায় না। কী দরকার এসব জিনিস পোষার? ও ওখানে যেমন ঘুমিয়ে থাকে থাক। খানিক বাদে আপনি ঠিক হয়ে যাবে। তুই খেয়ে জামা প্যান্ট পরে যা। দেরি হয়ে গেছে। মিনুর বাবা উঠোনে এসে অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকল।
বাবা – বিড়ালে বমি করলে কিছু হয় না। নে ওঠ। কাঁদিস না। আমি গেলাম। তুমি তাহলে যেও। মার উদ্দেশ্যে শেষ কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেল।
ঝিনুক — যুদ্ধ লাগলে মানুষ বাঁচে কি মরে তার ঠিক নেই, আর তুই বিড়ালের জন্য কাঁদছিস?
মা – যাকগে ঝিনুক, তুই কিছু বলিস না।
মিনু কাঁদতেই থাকল। কিছুটা লুল্লুর জন্য চিন্তা ও ভয় থেকে, আর কিছুটা তার কষ্ট যে কেউ বুঝতে পারছে না তারজন্য। এমন সময় সুজাতা ঘাস নিয়ে এসে ঢুকল।
সুজাতা – মিনুদি, তুই অস্ত্রশিক্ষা নিতে যাসনি কেন? তুই কাঁদছিস? এই নে, খাইয়ে দে। সেরে যাবে। ওর জন্য যাসনি? মাস্টারদা আসছে।
মিনু চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল – কোথায়?
সুজাতা – তোদের বাড়ির দিকেই বোধহয়। মিনু এদিক ওদিক তাকাল। মাস্টারদা তখনও এসে পৌঁছয়নি। মিনু একটা ঘাস নিয়ে লুল্লুর মুখের ফাঁক দিয়ে ঢোকানোর চেষ্টা করল। লুল্লু মুখ সরিয়ে নিল। মিনু আবারও চেষ্টা করল। কিন্তু লুল্লুকে ঘাস খাওয়ানো গেল না।
সুজাতা – ঘাসগুলো যদি বেঁটে মুখের ফাঁক দিয়ে খাইয়ে দেওয়া হয়?
এমন সময় মাস্টারদা উঠোনে এসে ঢুকল। মাস্টারদাকে দেখেই সুজাতা এক ছুটে পালালো।
মাস্টারদা — কী হলো রে, এই সুজাতা?
সুজাতা কোনো কথা না শুনে ছুটে চলে গেল। মিনু বিড়াল ছানা কোলে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল মাস্টারদার দিকে।
মাস্টারদা – কী রে, যাসনি কেন? মিনুর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে থাকল। মিনু নীরব। মিনুর মা উঠোনে বেরিয়ে এসে বললো – আমি ওকে কতবার বললাম। ওর বিড়ালের শরীর খারাপ বলে সেই সকাল থেকে কান্নাকাটি করছে। দেখো তো কী কান্ড। এই চাদরে আবার বিড়াল বমি করেছে, আমায় কাচতে যেতে হবে। মা বালতি করে চাদর নিয়ে বেরিয়ে গেল।
মাস্টারদা – কী হয়েছে তোর বিড়ালের?
মিনু – সকাল থেকে বার বার বমি করছে। এখন কেমন এলিয়ে পড়েছে।
মাস্টারদা – কী খেয়েছিল তোর বিড়াল?
মিনু – কিছুই নয়। দুধ দিয়ে ভাত। সকাল থেকেই বমি করছে। আবারও যদি করে ও তো মরে যাবে। মিনু আবারও অঝোরে কাঁদতে লাগলো। মাস্টারদা অবাক চোখে মিনুর দিকে চেয়ে রইল।
মাস্টারদা – কই, কী হয়েছে? আমার কাছে দে তো একটু। মাস্টারদা মিনুর কোল থেকে লুল্লুকে নিয়ে গায়ে হাত দিয়ে দেখতে লাগলো। বিড়াল ছানাটা ঝিমন্ত চোখে মাস্টারদাকে দেখতে লাগলো।
মাস্টারদা – দাঁড়া, তোর বিড়ালের জন্য ওষুধ বানিয়ে আনছি। তুই এখানে বস্।
মাস্টারদা মিনুদের ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। মিনু কিছুই বুঝল না। তবুও ভাবল, বোধহয় কিছু একটা উপায় হবে। মাস্টারদা রান্নাঘরে গেল। ঝিনুক বেরিয়ে এলো।
ঝিনুক – কিছু লাগবে?
মাস্টারদা – নুন চিনির জল। মিনুর বিড়ালকে খাওয়াব। ঝিনুক ভীষণ হেসে ফেললো।
ঝিনুক – শেষে তুমিও পাগল হলে নাকি? বিড়াল খাবে নুন চিনির জল? বিড়াল কি মানুষ?
মাস্টারদা – জানি না। দে তো। তুই আর অস্ত্রশিক্ষা নিচ্ছিস না যে? বিয়ে হয়ে গেলে যুদ্ধ আর কোনদিন করতে হবে না?
ঝিনুক নুন চিনি এগিয়ে দিয়ে কৌতুহলী হয়ে দেখতে থাকল।
মাস্টারদা – দেশের এমন অবস্থাও তো কোনদিন হতে পারে, যে সবাইকেই যুদ্ধ করতে হচ্ছে। বিয়ে হয়ে সীমান্ত থেকে এমন কিছু দূরে তো চলে যাচ্ছিস না। ওখানে যদি কেউ অস্ত্রশিক্ষা দেয় তবে বিয়ের পর নিবি। বুঝলি? আর লেখাপড়া যা শিখেছিস মনে রাখার চেষ্টা করিস। ছোটদের বইপত্র মাঝে মাঝে নিয়ে পড়বি। কষ্ট করে এতদিন যা শিখেছিস ভুলে যাস না।
ঝিনুক ছলছল চোখে বললো — গ্রাম ছেড়ে চলে যাব ক’দিন পর। এমনিই মন খারাপ লাগছে। যদি সত্যি যুদ্ধ বাধে মা, বাবা, বাড়ির সকলের, তোমাদের কী হবে? বলতে বলতে ঝিনুক ঝরঝর করে কাঁদতে থাকল।
মাস্টারদা – কাঁদিস না। যুদ্ধ লাগলে যুদ্ধ থামবেও। তখন আসবি আবার বাপের বাড়ি। আগেও তো যুদ্ধ হয়েছে।
ঝিনুক – তখন কাকে দেখতে পাব আর কাকে পাব না।
মাস্টারদা – দেখ্, সে তো ভাগ্য। বাঁচার চেষ্টাই তো আমরা সকাল থেকে চালিয়ে যাচ্ছি। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
– তবে সে চেষ্টায় তুই থাকবি না। এই আসলে তোর কষ্ট। গাঁয়ের ছেলে বিয়ে করলেই তো পারতিস। শ্যামল ছেলেটা তো ভালোই ছিল।
ঝিনুক – বাবা মা দিতে চাইল না।
মাস্টারদা – তুইও করতে চাসনি।
ঝিনুক মাস্টারদার পা দুটো জড়িয়ে ধরে – আমায় আশীর্বাদ করো মাস্টারদা, যেন ভালো থাকতে পারি।
মাস্টারদা ঝিনুকের মাথায় হাত রেখে –ওঠ্। ভালোই থাকবি। কিন্তু গাঁয়ের ছেলেগুলোর কি বিয়ে হবে না? তোরা মেয়েরা যদি যুদ্ধের ভয়ে এভাবে গ্রাম ছেড়ে পালাস?
ঝিনুক – কী করব? মা সম্বন্ধ নিয়ে এলো। ওদেরও পছন্দ হয়ে গেল।
মাস্টারদা এদিকে ছোট বাটিতে জলের সঙ্গে এক চামচ চিনি ও একটু নুন নিয়ে গুলছে। ঝিনুক অপরাধী মুখ করে পাশে দাঁড়িয়ে।
মাস্টারদা – যাকগে, যা হওয়ার হয়ে গেছে। যাকে বিয়ে করবি তাকে যেন ভালোবাসিস। তার কোনো বিপদের মুহূর্তে তাকে ফেলে চলে যাস না। ভালোবেসে অন্যের পাশে থাকতে হয়। নাহলে জীবনে একা হয়ে যেতে হয়।
(ক্রমশ)