।।শ্যামা।। কলমে: সাহানা
।।শ্যামা।।
কলমে: সাহানা
শ্যামার দাঁতটা বরাবরই উঁচু। হাসলে, সামনের পাটিটা বেরিয়ে আসে। গায়ের রঙটাও ঘোর কালো। মেয়েদের এমন রূপ সচরাচর দ্যাখা যায় না! ঠাকুমা কিন্তু শ্যামার মধ্যে মা শ্যামার রূপটি খুঁজে পেয়েছিলেন!
আর হ্যাঁ, বলা উচিত, তার একঢাল কালো চুলটা অবশ্যই গুণের!
অবশ্য, গুণ বলতে আছে অনেক কিছুই!
চমৎকার গানের গলা তার!
দরদী গলায় চোখ দুখানি বুজে গান শুরু করলেই আসর মাত!
আর মিষ্টি, মিশুকে স্বভাবটাও গুণ বৈকি!
মা-বাবার চিন্তা অন্য!
মেয়েকে পাত্রস্থ করতে পারবেন তো?
মফস্বলি, আধা-শহুরে মানসিকতায় এইরকম পাত্রী একটু কম পছন্দের তালিকাতেই থাকে!
আর…নিজে দেখে শুনে?
ঠাকুমা কীর্তনের আসরে গিয়ে বলেন, “শ্যামা আমার ওরকম মেয়েই নয়! কালো তো কি? শ্যামা মা-ও তো! এই যে গানের ভরাট গলা, কম নাকি কিছু? খালি রূপ দেখলেই হবে…. গুণ? বলি, গুণের কদর নেই!”
সবাই শোনে। মাথা নাড়ে!
সম্বন্ধ পাতাতে কেউ আগ্রহী নয়!
শুধু গান নয়!
অসাধারণ হাতের কাজ তার! কাঁথা সেলাই-এ তার মতো নিপুণ শিল্পী পুরো শহরে, শুধু শহরে কেন, কোত্থাও নেই বলেই মনে হয়!
সেদিন বাড়িতে এলেন স্থানীয় পার্টি কর্মী, গীতাদেবী।
-“শ্যামাকে খুব দরকার! একটা আন্তর্জাতিক এক্সিবিশন হবে…বিষয়টা হলো বাংলার মেয়ের হস্তশিল্প। শ্যামা ছাড়া এদিকে কেউ নেই!”
গর্বে বুক ফুলে ওঠে ঠাকুমার।
বাবা বলেন…”বেশ তো!”
নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজে বসে সে।
জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূচীশিল্পটি বোধকরি সে বোনে। শিল্পের মূল বিষয়, রাধা কৃষ্ণের দোলযাত্রা!
গীতাদেবী দুদিন ঘুরে গিয়েছেন এর মধ্যে! মাত্র এক সপ্তাহ। জমা দিতে হবে তো!
নির্দিষ্ট সময়ে কাজটি জমা পড়ে। এবার অপেক্ষা।
একমাস….দুমাস..
সবাই চুপিচুপি হাসে…মহিলামহলে ঝড় ওঠে….
“ও খবর আর এসেছে!” ব্যানার্জি গিন্নী বলেন!
মৈত্র গিন্নী, বসুদের দুই বউ এবং আরও অনেকে সুর মেলায়!
ওরাও কাজ করেছে…..তবে প্রতিযোগিতাটা কালো-ফরসা রঙের তো নয়!
শ্যামাকে নিয়ে তথাকথিত সুন্দরী মহলে কানাকানিটা বেশি! গুণের উৎকর্ষতা কেউ মেনে নেয় কি, সহজে! রূপই তো শ্রেষ্ঠ!
ঠিক তিনমাসের মাথায় এক দুপুরে দরজায় কলিং বেল বেজে ওঠে।
ভরদুপুরে কে?
শ্যামা দরজা খুলতেই দুজন অচেনা মানুষ!
একজন বয়স্ক অন্যজন নবীন, শ্যামলা চেহারা, লম্বা চুল আর মায়াবী দুটো চোখ!
-শ্যামা ঘোষ? আপনি?
মাথা নাড়ে কোনোরকমে।
বাবা-মা দুজনেই নেমে এসেছেন।
-আপনারা?
আমরা সরকারী অফিসার। মহিলাদের হস্তশিল্প নিয়ে যে প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়েছিল, সেই কমিটিতেই। শ্যামা ঘোষ সর্বশেষ্ঠ মহিলা সূচীশিল্পীর আখ্যা পেয়েছেন! সাম্মানিক হিসেবে সার্টিফিকেট এবং কুড়ি হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে।
আগামী সপ্তাহে কলকাতায় একটি প্রদর্শনীতে।
সব কথা শোনে, শ্যামা।
লম্বা যুবকটি এক দৃষ্টিতে দেখছে তাকে! চোখে কি যেন…..কি যেন…
মনে হচ্ছে ছুটে পালায়!
কি যেন লাইনটা….যাওয়ার আগে নীচু স্বরে সবাইকে এড়িয়ে বলে যায় যুবকটি “কালো_জগতের_আলো!”
ইসসস্! কি লজ্জা! দুহাতে মুখ ঢাকে শ্যামাঙ্গিনী!