ধারাবাহিক উপন্যাসিকা। কিছু কথা। পর্ব ৭। কলমে-ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

ধারাবাহিক উপন্যাসিকা।
কিছু কথা। পর্ব ৭।
কলমে-ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

কৌশিকের কথা।
ও কে?!কাকলি না!ওকে দেখলাম তিনটি শতক পরে হাওড়া স্টেশনের বাইরে। বারবার এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিলো রাস্তা পার হ‌ওয়ার জন্য। একবারও সিগন্যাল দেখছিলো না। ভীড়টা তখন এগিয়ে গেল, কাকলিও মিছিলে পা মেলানোর মতো ভীড়ে ভীরে গেলো।
আমি পেছনে দৌড়ালাম। -‘এই যে,কাকলি না!’- কাকলি ঘুরে তাকালো। কি নিস্পৃহতা ওর দৃষ্টিতে। -‘চিনতে পারছো না? আমি কৌশিক।’- সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে কাকলি জিজ্ঞেস করলো -‘কেমন আছো?’- আমি বললাম -‘ভালো আছি।-‘ আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল,-‘আচ্ছা কাকলি,সেই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে? তুমি তখন রাস্তার পুলিশের হাত নাড়া দেখে রাস্তা পারাপার করতে। তুমি ছিলে ডিসিপ্লিনড মানুষ। আজ তোমার মুখের মশৃন চামড়ায় শুকনো গাছের শিকড়ের দাগ।তোমার চোখের তলায় নববধূর লেপ্টানো কাজলের জায়গায় গঙ্গার ঘাটের পলিমাটির বিষণ্ণতা। তাতে কতো পূণ্যার্থীর কীর্ণ পদচিহ্নের চিহ্ন। আমার ভোরের কাকলি! এই তোমাকে তো আমি চিনিনা!’- আমি কিছু বলতে পারলাম না। কাকলিই কথা শুরু করলো, -‘এ দিকে কোথায় যাচ্ছ?’- আমি যেন বাকশক্তি ফিরে পেলাম। -‘এই তো, অফিসের কাজে দুর্গাপুর যাচ্ছি। কিন্তু তুমি একা?’- কাকলি হাসলো, কেমন একটা ক্ষিন্ন হাসি! বললো -‘বাড়ি যাচ্ছি, ধানবাদ। চারটে দশের শক্তিপুঞ্জে।’- বললাম -‘এখন তো মোটে পৌনে তিনটে। কিছু মনে করো না, চা খাবে? একটু কথা বলতাম।’- কাকলি চোখ তুলে তাকালো, সেই পাখির নীড়ের মতো চোখ! ঝাপসা হয়ে এলো আমার দৃষ্টি। কাকলির পরনে দামী শাড়ি, বাঁ হাতে একটা দামী রিস্টওয়াচ।ডান হাতে মোটা বালা,কানে, গলায় চিকচিক করছে সোনা। সম্পন্ন আভিজাত্যের ছোঁয়া ওর সর্বাত্মক প্রকাশে। কিন্তু মুখে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। আমি বুঝতে পারছি না। মুখে বললাম…একটু হালকা সুরে -‘এত গয়না পড়ে ট্রেনে যাতায়াত করো! ভয় করে না?’- কাকলির উত্তর শুনে অবাক হয়ে গেলাম। -‘আসলে ফোনটা আসতেই এতো ভয় পেয়েছিলাম, গয়নাগুলো খুলে আসার কথা মনেই আসে নি। এগুলো আমার সব সময়ে গায়ে থাকে…’- বলতে বলতে থেমে গেল কাকলি। চোখ তুলে আমার নুনমরিচ চুলের দিকে তাকিয়ে থাকলো। -‘ কতো পাল্টে গেছো কৌশিক!’- -‘তা সারাজীবন কি ছোকড়া থাকবো?’- আমি বললাম। -‘কিন্তু কাকলি কি একটা ফোনের কথা বলছিলে! কী হয়েছে?’- কাকলির চোখ দুটো জলে ভ’রে উঠলো, -‘ দীপ মারা গেলো কাল রাতে।’- আমি চমকে উঠলাম। সবার আদরের, উচ্ছল প্রাণবন্ত সেই দীপ! বিশ্বাস করতে পারছি না।

আরও আমি ভেবে পাচ্ছি না, কাল ছোট ভাই মারা গেলো, আজ তার দিদি একা বাড়ি ফিরছে, সঙ্গে কেউ নেই! আমি বলেই ফেললাম -‘ তোমার বর?’- বললো -‘দুদিন আগে আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেছে। ওর অফিসের কাজে গেছে দিল্লীতে , মিটিং আছে।’- তার পরে একটু স্বাভাবিক স্বরে বললো -‘তোমার বিয়েতে আসতে পারিনি। তা তোমার ছেলেমেয়ে কতো বড়ো হলো?’- -‘মেয়ে নেই, একটাই ছেলে। মাধ্যমিক দেবে, তোমার?’- একটু চুপ থাকলো কাকলি, আস্তে মাথা নাড়লো দুদিকে -‘ হয়নি।’-
আমাদের চা জুড়িয়ে যাচ্ছে, চোখ পুড়ে যাচ্ছে, আমার মনে পড়ছে সত্তরের দশক। পুলিশের ভ্যান এসে তুলে নিলো আমাদের কয়েকজনকে। কলেজের ভেতর ছুটে ঢুকে গেল কাকলিরা । ওরা ঠকঠক করে কাঁপছিলো, কাকলি মুখে আঁচল গুঁজে দিয়েছিল। তারপর সাতাত্তর সাল কখন এলো কখন আমরা জেল থেকে মুক্তি পেলাম! শুরু হলো স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। সরকারি চাকরি পেলাম সহবিপ্লবী দেবিকাকে বিয়ে করে সংসার পাতলাম। খুব পাতি গল্প। পাতি মাস্তানের মতো। সময় হয়ে এলো শক্তিপুঞ্জ ছাড়ার। ক্লান্ত ভাবে উঠে দাঁড়ালো কাকলি, -‘আসছি। তুমি তো লোকালে যাবে।’- দ্রুত পায়ে নির্দিষ্ট প্লাটফর্মের দিকে এগিয়ে গেল কাকলি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *