আত্মজা — ধারাবাহিক উপন্যাস অধ্যায় -৮ *** সুদেষ্ণা সিনহা
আত্মজা
————
ধারাবাহিক উপন্যাস
অধ্যায় -৮
সুদেষ্ণা সিনহা
ভোর থেকে নহবৎ বসেছে।সানাই এর সুর ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। সানাই এর মন কেমন করা সুরে বড় অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে স্বাধীনতাকে।চেয়ারে চুপচাপ বসেছিল সে। বাবার খুব প্রিয়পাত্রী ছিল সে। আজ বাবার কথা খুব বেশী করে মনে পড়ছে তার।
ভোরবেলায় বড় পিসিমা, সেজমামিমা,ছোট
মাসিমা,বৌদি জল সাজতে গঙ্গায় যাবার জন্য তাকে ঠেলে তুলেছিল।
—-ওঠ,ওঠ,সূর্য ওঠার আগে দুটো কিছু মুখে দে।তারপর তো উপোস। সারাদিন কিচ্ছু মুখে দিতে পারবি না।
বড় পিসিমা এক বাটি চিঁড়ে চিনি,কলা দিয়ে মেখে ঘরে ঢুকে দেখেন স্বাধীনতা তখনও শুয়ে আছে। মাথায় হাত দিয়ে ডাকতে ডাকতে স্নেহভরে বলেছিলেন,মা মন খারাপ করছে ?
—– না।
—-তবে কি শরীর খারাপ?
—না না, পিসিমা।
পিসিমা কি বুঝলেন কে জানে একটু থেমে বললেন,এটাই তো মেয়েদের ভবিতব্য মা।বাপের ঘর মেয়েদের আপন ঘর নয়। স্বামীর ঘরখানই তাদের আসল।
স্বাধীনতার বাবার নিজের ভাইবোন নেই।তিনি একমাত্র সন্তান ছিলেন। তবে মাসি,পিসি,মামা সকলের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রেখেছিলেন। এখনও সে সব বজায় আছে। বড় পিসিমা বাবার বড় মামার মেয়ে।দুই বাড়ির মধ্যে সম্পর্ক খুব ভাল।সব কাজে তাদের আসা-যাওয়া আছে।
চারিদিকে আবছা অন্ধকার।সূর্য উঠতে এখনও কিছুটা দেরী আছে।রাত না দিন বুঝতে না পেরে একটা রাতজাগা পাখি ডেকে উঠল। আট-দশজনজন মেয়েদের একটা দল এসেছে গঙ্গার ঘাটে জল সাজতে। স্বাধীনতার বিয়েতে বড় পিসিমা ডালা ধরেছেন। গঙ্গা থেকে পিতলের কলসি পূর্ণ করে নিয়ে যেতে হবে বাড়িতে। অষ্টমঙ্গলার দিন সেই কলসি থেকে জল ছিটিয়ে দিতে হবে বর-কনের মাথায়।
সেজমামিমা হাতে কলসি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন।তিনিই আজ কলসিটা ভরে নিয়ে যাবেন।গঙ্গায় জলে পা দিলেন মামিমা। ঘোলা জল কয়েকটা তরঙ্গে আবর্তিত হল।
কে যেন বলল,আস্তে আস্তে নাম।নেমেই গর্ত নেই তো।
রাস্তা অন্ধকার।কলকাতার মতো এখানে সন্ধ্যেবেলায় কেউ রাস্তার মোড়ে মোড়ে গ্যাসের আলো জ্বেলে দিয়ে যায় না। সেজমামা হাতে লন্ঠন নিয়ে মেয়েদের দলটিকে আলো দেখাতে দেখাতে এসেছেন। গঙ্গার ঘাটের ধারে লন্ঠনের পলতে বাড়িয়ে দিয়ে তিনি মামিমাকে ডেকে বললেন, ছবি দেখে পা দাও জলে।জলটা একবার নাড়িয়ে নাও।বর্ষাকাল।সাপখোপের উৎপাত বড্ড বেশী।
মামিমার প্রতি মামার টান দেখে সবাই হেসে উঠল।
মাসিমা বলল,দাদাভাই আমরা এতজন থাকতে তোমার বউকে সাপে ধরবে বুঝি?
সেজমামিমা বললেন,এয়োতিরা তিনজন বা পাঁচজন ধরে কলসিটা আমার কাঁখে তুলে দাও।
পাঁচ এয়োতি এগিয়ে এল।উলু ধ্বনি দিল সকলে।শাঁখ বেজে উঠল।
আর সকলে ডাঙ্গায় দাঁড়িয়েছিল।সেজমামিমা জল থেকে কলসি কাঁখে উঠতে উঠতে গঙ্গার জল ছিটিয়ে দিলেন সকলের মাথায়।
—-শুদ্ধ…শুদ্ধ….
ওঁ সদ্যপাতক সংহন্ত্রী সদ্যদুঃখবিনাশিনী
সুখদে মোক্ষদে গঙ্গে গঙ্গৈব পরমাং গতিম।
পূর্ব আকাশে লাল আলোয় সূর্যদেব উঠছেন।সেজমামিমার মন্ত্র উচ্চারণে চারিদিক গমগম করে উঠল।
রাত্রি একটায় লগ্ন। আজ বিয়ে করতে এসেছে অলোক সান্যাল। কনেদের বাড়ির চন্ডীমন্ডপে পাত্র সেজে বসেছিল সে । বর সাজে তাকে বেশ দেখাচ্ছে।মাথার টোপর আর রজনীগন্ধার মালাটা এক পাশে খুলে রেখে সে বরাসনে স্বচ্ছন্দভাবে বসেছিল।
ছেলেবেলার বন্ধুবান্ধবের সাথে আর যোগাযোগ নেই অলোকের।তার সাথে এসেছে স্কুলের শিক্ষকরা,কিছু পাড়া-প্রতিবেশী,কিছু আত্মীয়-স্বজন।
একটু আগে কনের বাড়ির এক ঝাঁক রূপসী এসে দেখে গেছে তাকে।তাদের মধ্যে গোলাপী বেনারসী পরা মেয়েটা খুব সুন্দরী। কি টানা টানা চেহারা!স্বাধীনতার মাসতুতো বোন ।
—-কি যেন নাম বলল? কি নাম! কি নাম! হ্যাঁ,মনে পড়েছে। টুকটুকি! মেয়েটা কথাতেও বেশ চটরপটর।বলল,আপনি আমার জামাইবাবু হন,আপনার সাথেই তো আমার ঠাট্টা-ইয়ার্কির সম্পর্ক হবে।
স্বাধীনতা কোন দিন বিয়ে করবে বলে ভাবেইনি। মারা যাবার আগে পর্যন্ত যতবার তার বাবার সাথে কথা হয়েছে,বাবা বলেছেন,নিজের দুটো পায়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে স্বাধীন। যুগ বদলেছে।তুমি স্বাধীন ভারতবর্ষের নাগরিক।
তার বন্ধু করবী ক্লাস ফোর অবধি পড়ে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল।
কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে গ্রাজুয়েট হবার পর মা বাবাকে বলেছিলেন,এবার মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা কর।মেয়ে বড় হয়েছে।
হাসতে হাসতে বাবা বলেছিলেন, অসম্ভব।আমার মেয়ে কি লোকের বাড়ির রান্না,ঘরের কাজ করতে যাবে?
—– এ কথার মানে? মা চোখ কপালে তোলেন।
—— মানে খুব সহজ —- আমার মেয়ে যতদিন না নিজে চাকরি-বাকরি পাচ্ছে ততদিন মেয়ের বিয়ে হবে না।
স্বাধীনতার বাবা মনে মনে মেয়েদের শ্রদ্ধা করতেন।পুরুষের উপর নির্ভরশীল হলে অনেক পরিবারে মেয়েদের কোন কদর থাকে না।বাবা নিজের মেয়ের ক্ষেত্রে কোন অন্যায় বা অবিচার হলে সহ্য করতে পারবেন না,এটা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন।
হেস্টিংস কলেজে বি পি এডের ফর্ম ফিলাপ চলছিল। স্বাধীনতা ফর্ম ভরে জমা দিয়েছিল।ভর্তির লিস্টে নাম উঠলে বাবা খুশীতে মসগুল হয়ে উঠেছিলেন।
—- সরমা,সরমা,বাবা খুব উত্তেজিত।
—-কি বলছ?রান্নাঘরে।মায়ের উত্তর।
—–স্বাধীন হেস্টিংস কলেজে বি পি এড পড়ার চান্স পেয়েছে।ভর্তি করে দেব। আমি কতদিন ধরে অপেক্ষা করে আছি এই দিনটার আশায়।
—- তাহলে কি তোমায় মেয়ে কলকাতায় থাকবে?
—-পড়ার প্রয়োজনে থাকতে হবেই।
সরমা রেগে যায়।
-‐–তোমার যা খুশী কর।পরে মেয়েকে নিয়ে পাঁচ কথা উঠলে আমাকে দোষ দিও না।
গজ গজ করতে করতে সরমা ঘর ছেড়ে চলে যান।
—-বাবা, মা রেগে চলে গেল যে।
—-যেতে দে মা।
—-আমার কলকাতায় পড়া..
—- তোর কলকাতায় পড়া হবে।আমি তো ভর্তি করে দেব।ভয় পাচ্ছিস কেন?
বৌদি ঘরে এল। সঙ্গে পাল মাসিমার ছোট বৌমা,পাড়ার মেয়ে মঞ্জু।
—-ঠাকুরঝি ওরা তোমাকে সাজাবে।তুমি বিছানায় এসে বস।
রাত্রি একটায় লগ্ন হওয়ায় বরযাত্রীদের খাওয়াদাওয়া শেষ হয়ে গেছে। কনেকে পিঁড়িতে বসিয়ে সাত জন বিবাহিত পুরুষ নিয়ে গেল ছাদনাতলায়। পান দিয়ে স্বাধীনতার মুখ ঢাকা।এবার শুভদৃষ্টি। ওদের মাথার উপরে একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দেয় সবাই। স্বাধীনতা চোখ মেলে তাকায়।এক জোড়া চোখ প্রেমিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।স্বাধীনতা লজ্জা পায়।চোখ নামিয়ে নিতেই উৎসাহী দর্শক চেঁচিয়ে ওঠে, আর একবার। আর একবার তাকাও।
আবার তাকায় স্বাধীনতা। তার জীবনের বত্রিশ বসন্তে এল এক রাজপুত্র!কি সুন্দর চেহারা! চশমার আড়ালে তার বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ যেন কথা বলল,ও মেয়ে, তুমি আমার ঘরে এস।তোমার জন্য আমার শূণ্য হৃদয় এখনও যে অপেক্ষায় আছে।এস আমরা দু’জন হাতে হাত ধরে জীবন পথে প্রবেশ করি।
ভরা নদী ছলছল জলের উচ্ছ্বাসে যেমন সমুদ্রের সাথে মিলিত হয় তেমনিই স্বাধীনতা আজ তার বুকভরা ভালবাসা নিয়ে অলোককে গ্রহন করে নিল ।
মা,সরমা সম্প্রদান করছেন।এতদিনের লালিতপালিত তার বাড়ির পরম সম্পদটিকে তিনি তুলে দিয়েছেন অলোকের হাতে।
যদিদং হৃদয়ং মম,তদস্তু হৃদয়ং তব।
আমার হৃদয় তোমার হোক,তোমার হৃদয় আমার হোক।
চারিদিকে সানাইয়ের সুর বেজে ওঠে।
পুরোহিত কাঠায় সিঁদুর ঢেলে ধরিয়ে দেয় অলোকের হাতে। অলোক ডান হাত দিয়ে কাঠায় ভরা সিঁদুর স্বাধীনতার সিঁথিতে এঁকে দেয়। বাঁ হাত দিয়ে ঘোমটা টেনে দেয় স্বাধীনতার মাথায়।
তুমি আজ আমার হলে,আমি হলাম তোমার।
বাসর বসবে।বর-কনে বাসর ঘরে গালিচায় বসে বিশ্রাম নেবে।তার আগেই মধুনাপিত এল,হাতে ধরা হালকা হলুদ কাগজে লাল বর্ণের বাংলা কবিতা।
হলুদের কাগজের উপরে লেখা “শ্রী শ্রী প্রজাপতয়ে নমঃ”।
তারপর দুইপাশে মালা হাতে দুই পরীর ছবি।
মধুনাপিত সুর করে পড়তে লাগল—-
শুনুন শুনুন মহাশয় করি নিবেদন
অলোক,স্বাধীনতার শুভপরিণয় করিব বর্ণন।
রাম যথা সীতারে করিলা গ্রহণ
দেবতারা আশির্বচন করিল প্রদান।
সেইমত আষাঢ় বার পুণ্য তিথি ক্ষণে
অলোক- স্বাধীনতা পরস্পরে গ্রহণ করিলা মনে।
যতেক দেবদেবী পুষ্প দিলা মাথে,
স্বামী-স্ত্রীরূপে তাহারা রহিবে একসাথে।
এবার বাসরঘরে স্বাধীনতার মাসি-পিসি মামাতো-পিসতুতো ভাইবোন,অলোকের বন্ধুদের ভিড়। অলোক ভরাট গলায় গেয়ে উঠল, আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি।সন্ধ্যেবেলার চামেলি গো,সকালবেলার মল্লিকা,আমায় চেন কি?
কি সুন্দর গলা।মানুষটার কত গুণ! স্বাধীনতা মনে মনে গর্ব অনুভব করে।আজ বাবা থাকলে খুব খুশী হতেন!
স্বাধীনতা মনে মনে বলে,বাবা তুমি অলক্ষ্যে থেকে দেখো তোমার স্বাধীন আজ জীবনসাথী হিসাবে একটা মানুষকে পাশে পেয়েছে। তোমার মেয়ে খুব খুশী হয়েছে বাবা।
সকালে বর-কনের বিদায়পর্ব। ছাদনাতলায় একে একে গুরুজনেরা আশির্বাদ করলেন বর-কনেকে।এবার কনকাঞ্জলির জোগাড় হয়ে গেছে। পিসিমা একটা কাঁসার পাত্রে চাল দিয়ে বললেন,স্বাধীন তোর মা পিছনে আঁচল পেতে দাঁড়াবেন। তুই তিন বার বৌদির আঁচলে চাল দিবি আর বলবি,তোমার সব ঋণ শোধ করে দিলাম।
কেঁদে মাথা নাড়ল স্বাধীনতা,পারব না পিসিমা।মা-বাবার ঋণ কি কেউ শোধ করতে পারে?শোধ করা যায় কখনো?
এবার কনে বিদায়ের পালা।বাড়ির আত্মীয়-স্বজন,পাড়া-প্রতিবেশি সবাই এসে জড়ো হয়েছে বিয়ের ছাদনাতলায়।
স্বাধীনতাদের বাড়ির রীতি পালকি চড়ে কনেকে বিদায় জানাতে হবে। শহরের পাকা রাস্তায় বরের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।সেখান অবধি পালকি যাবে। উঠোনে পালকি রেখে দাঁড়িয়ে আছে ছয় বেহারা। তাদের পরনে খাটো ধুতি,মাথায় পাগড়ি,আদুল গা,গলায় জড়ানো গামছা আর প্রত্যেকের হাতে পাকা বাঁশের লাঠি। একটা পাথরের থালায় জল রাখা আছে।সেই জলে স্বাধীনতার পা ধুইয়ে দিল তার পিসির মেয়ে অঞ্জু।এটা পুরানো লোক রীতি।উমার শ্বশুরবাড়িতে যাবার সময় মা মেনকার নির্দেশে উমার বাপের বাড়ি ফিরে আসার আশায় মা মেনকা মেয়ের পা জলে ধুইয়ে দেবার নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন,”আবার এসো মা।”
কনকাঞ্জলির অনুষ্ঠান শেষ করে পালকিতে উঠে বসল স্বাধীনতা। বেহারারা কাঁধে তুলে নিল পালকি।
—হুম্ না—‘হুম্ না–হুম্ না
পরিচিত সবুজ খেত,রেল লাইন,পদ্ম দিঘি,বাঁশবাগান পেরিয়ে এগিয়ে চলল পালকি দুলকি চালে।পালকির খোলা দরজা দিয়ে বুড়ো বটতলায় চোখ পড়ল স্বাধীনতার। বটের ছায়ায় বিষন্ন বদনে দাঁড়িয়ে আছে রমেনকাকা,তার দাদুর আমলের ভাগচাষী বিশুদাদুর ছেলে। অতীতের স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে।স্বাধীনতার বুকের ভিতরটা যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। চোখে টলটলে জল।
দ্রুত পালকি ছুটে চলল পাকা রাস্তার দিকে।
গাড়িতে অলোক বসেছিল আগে থেকেই।স্বাধীনতা পালকি থেকে নেমে গাড়িতে ওঠে। তার দু চোখে জল। অলোক হাত বাড়িয়ে রুমাল দেয় তার হাতে। চোখ মুছে তার মুখের দিকে তাকাতেই মুচকি হাসে অলোক । স্বাধীনতার ডান হাত ছুঁয়ে অলোক বলে , আর কেঁদো না শরীর খারাপ করবে।আমি আছি তো তোমার পাশে।