# সীমান্ত # পর্ব – ৭ কলমে – অরণ্যানী
# সীমান্ত # পর্ব – ৭
কলমে – অরণ্যানী
মহিলাটি বললো – ফুলির সাদি হবে কোথায় দলপতি?
দলপতি – ওদের যদি দু’জনের দু’জনকে পছন্দ না হয় তবে সাদি হবে কী করে? ফুলির অন্য কোনো দলের ছেলের সঙ্গে সাদি হবে।
মহিলা – ওমা, সে কী! ও আমাদের দল ছেড়ে অন্য দলে চলে যাবে?
দলপতি – যুবতী মেয়ে। বিয়ে না দিয়ে তো বেশিদিন রাখা চলে না।
ফুলি – অন্য দলের অন্য সমস্ত নিয়ম কানুন। ছোটবেলা থেকে একরকম আর এখন সব অন্যরকম হয়ে গেলে কী হবে?
একজন পুরুষ এগিয়ে এসে বললো – অনেক দলেই তো দুটো তিনটে বিয়ে করে। আমি যদি ফুলিকে বিয়ে করি?
সাথে সাথে তার বউ এগিয়ে এলো – না, আমি দেবো না করতে। নয় ফুলিকে আগুনে ফেলব, নয় তোকে ফেলব, নয়তো মরব।
এই বলে সে ফুলির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তখনও অগ্নিকুন্ডের আগুন ম্লান হয়ে গেলেও জ্বলছে। ওই পুরুষ, তার বউ ও ফুলি তিনজনে হাতাহাতি শুরু করল। অন্যরা তাড়াতাড়ি ছাড়িয়ে দিলো।
দলপতি – ফুলিকে আমি সাদি করব। নিয়ে এসো ফুলের মালা আর চন্দন। গয়নাগাটি পরে শহর থেকে কিনে দেবো।
দলপতির বউ – ওমা, সে কী! তুমি কেন আমি থাকতে আবার সাদি করবে?
দলপতি – সেছাড়া এ বিবাদ মেটানো যাবে না। তুমি চুপ করো। আমিই সাদি করব। দলের মেয়েকে সত্যিই বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া যায় না। আর যে সাদি করতে চায় না, তার সঙ্গে জোর করে দেওয়াও যায় না। যেহেতু আমি দলপতি, তাই এই সাদি আমাকেই করতে হবে। কিন্তু ফুলি দেখো, তোমার মত আছে তো?
মহিলাটি – হ্যাঁ হ্যাঁ, কেন মত থাকবে না। এই ফুলি, তুই সাদি করে নে। নাহলে তোর কী হবে?
ফুলি – হ্যাঁ মত আছে।
তাড়াতাড়ি ফুল এনে মালা গাঁথা হলো, চন্দন ঘষা হলো। তারপর দলপতির সঙ্গে ফুলির বিয়ে হয়ে গেল।
ওদিকে মেঘ কখন ওখান থেকে চলে গেল কেউই তা লক্ষ্য করল না। পছন্দ অপছন্দের তর্কাতর্কির সময় মেঘ স্থান ছেড়ে দ্রুতপদে হাঁটা দিয়েছিল। ওর একটু কাছ দিয়ে গাছপালা নাড়িয়ে একটা বড় জানোয়ার অন্ধকারে ছুটে পালালো। মেঘের চলা থামলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে সে উঠে গেল একটা উঁচু গাছের উপর। অন্ধকারেই গাছটার এ ডাল ও ডাল ঘুরে গাছটাকে দেখে নেওয়ার চেষ্টা করল। গাছের ডালে নাড়া পেয়ে কিছু পাখি কিচমিচ করে উঠলো। তারপর অপেক্ষাকৃত মোটা একটা ডালে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে চোখ বন্ধ করল মেঘ। ঘুম এলো না। মাঝে মধ্যেই চোখ খুলে অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইল। এভাবেই একসময় ভোরের আবছা আলোয় রাত শেষ হলো।
অস্ত্রশিক্ষার মাঠ :-
গ্রামে একটা বিরাট জমি পরিষ্কার করে সেটিকে অস্ত্রশিক্ষার মাঠ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এই বড় মাঠের ধারে ধারে নানান বড় বড় গাছ রাখা হয়েছে। রোদের মধ্যে অস্ত্রশিক্ষা নিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেলে গাছের ছায়ায় এসে বিশ্রাম নেয় তখন। অস্ত্রশিক্ষা ছাড়া অন্য সময়ে এই বড় মাঠের একদিকে ছেলেরা বল খেলে। ওদিকটা একটু ফাঁকা। অন্যদিকে কিছু দূরে দূরে কোনটা উঁচু, কোনটা নিচু, কোনটা মাঝারি ইত্যাদি ছোট ছোট বাঁশের মাচা তৈরি করা আছে। কয়েকটা মাচার উপর প্রায় মানুষের সাইজের বড় বড় খড়ের পুতুল দাঁড় করানো আছে। এগুলো অস্ত্রশিক্ষার সময় হাতের টিপ প্র্যাকটিসের জন্য ব্যবহার করা হয়। বাকি খালি মাচাগুলো লাফ দেওয়া শেখার জন্য ব্যবহৃত হয়। তাই মাচাগুলো কোনটা কাছে, কোনটা দূরে, কোনটা উঁচু, কোনটা নিচু। যাতে বিভিন্ন দূরত্বে ও উচ্চতায় ছেলে মেয়েরা লাফ দেওয়া অভ্যাস করতে পারে। সেরকমই খড়ের মডেলগুলোকেও কখনো কাছের মাচায়, কখনো দূরের, কখনো উঁচু, কখনো নিচু মাচায় রেখে কাছের, দূরের, নানারকম টিপ অভ্যাস করানো হয়।
অস্ত্রশিক্ষা :- সকাল আটটার কাছাকাছি হবে। আকাশে রোদ উঠে গেছে। মাঠের গাছতলা গুলোতে গ্রামের ছেলে মেয়েরা অস্ত্রশিক্ষা নিতে জড়ো হয়েছে। বারো থেকে ত্রিশের কাছাকাছি তাদের বয়স। পুরুষরা আর একটু বেশি বয়সেরও আছে। নারী পুরুষ সকলেই পুরুষদের প্যান্ট সার্ট পরে। এই নিয়ে বড় মেয়েরা আর বউরা নানা হাসি তামাশা করছে।
একটি বউ – মাগো, কী দেখাচ্ছে!
অন্য আর একজন – যুদ্ধ যুদ্ধ করে মেয়েদের লজ্জা সরম বলে আর কিছু থাকল না।
আর একটি বউ – তা আমাদের নয় বে হয়ে গেছে। এই বড় বড় আইবুড়ি মেয়েগুলো এইসব পরে মাস্টারদার কাছে অস্ত্রশিক্ষা নেবে?
ওদিকে একটা শিরিষ গাছের নিচে এসে জড়ো হয়েছে পতু, পদ্মা, শ্যামলী, কবিতা, জবারা। ছেলেরা ইতিমধ্যে মাচা ডিঙিয়ে লাফানো প্র্যাকটিস করছে। মাস্টারদা চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখছে, কে এসেছে আর কে আসেনি। না এলে তার কারণ জিজ্ঞাসা করছে।
মাস্টারদার নির্দেশে ফাঁকা মাঠটায় মেয়েদের হাতের টিপ প্র্যাকটিসের জন্য তিনটে মাচা ও খড়ের মডেল নিয়ে ফিট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল বিজয়, শ্যামল, দেবু ও আর কয়েকটা ছেলে। কবিতাদের দলটার দিকে এগিয়ে এসে বিজয় একবার কবিতার দিকে চাইল। কবিতা চোখ নামিয়ে নিল। জবা ভাবল ওদের সাহায্য করতে বলা হচ্ছে।
জবা – আমি যাব?
বিজয় – কোথায়?
জবা – ওই যে, ওই মাঠে মাচা টাচা নিয়ে যাচ্ছ।
বিজয় – না, ঠিক আছে। আমরা তো করছি।
দেবু – আয় না। জিজ্ঞেস করার কী আছে? তোরা অস্ত্রশিক্ষা নিবি, আর আমরা খেটে খেটে মরব?
জবা – আজ তো সবাইকেই খেটে খেটে মরতে হবে গো।
জবা ছেলেদের সঙ্গে হাত লাগিয়ে কাজ করতে চলে গেল। মাস্টারদা ওদের নির্দেশ দিচ্ছে কোনটা কোথায় বসাতে হবে। তাপস নামে একটি ছেলে লাফ দেওয়া প্র্যাকটিস করতে গিয়ে পড়ল জবার গায়ের উপর। জবা পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিল।
জবা – চোখে দেখো না? নাকি ইচ্ছা করে?
তাপস জবার একটি হাত ধরে বললো — তোকে মাইরি দারুণ দেখাচ্ছে আজকে। রাগ করিস না।
জবা – হয়েছে, হাত ছাড়ো। যা করছিলে তাই করো।
তাপস জবার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার একগাল হাসি দিয়ে চলে গেল। জবা নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।
এরমধ্যে আরো কিছু ছেলেমেয়ে মাঠে এলো। মাস্টারদা সকলকে দেখতে লাগলো। অনেক মেয়ে বউরা হাতের টিপ প্র্যাকটিসের জন্য ওদিকের মাঠে চলে গেছে। যারা এখনো প্র্যাকটিস শুরু না করে গল্প করছিল, মাস্টারদা তাদের ধমক দিয়ে প্র্যাকটিস করতে পাঠিয়ে দিল। কবিতারাও প্র্যাকটিসের মাঠের দিকে যাচ্ছিল। মাস্টারদা ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো।
মাস্টারদা – মৃন্ময়ী এখনো আসেনি?
কবিতা – না। আমি ওদের বাড়ি গিয়ে দেখে আসব?
মাস্টারদা – না। তোরা ভালো করে প্র্যাকটিস কর। আমি দেখছি।
মাস্টারদা – এই অলোক, তোর বোন আসেনি কেন?
অলোক – আমি জানি না। ও কী সব করছে। ডাকলাম, এলো না।
মাস্টারদা – তোর বোন অস্ত্রশিক্ষা নিতে আসেনি, তোর কোনো চিন্তা নেই? তুই তো দাদা। জোর করে ধরে নিয়ে আসতে পারিসনি?
অলোক – কী করব, যাব?
মাস্টারদা – থাক, তোরা প্র্যাকটিস কর। আমি দেখছি।
কবিতা চিন্তিত মুখে বললো — মাস্টারদা মারবে না তো?
পতু – ও যদি রোজই কামাই করে কী হবে? মারতেই তো পারে।
পদ্মা – কালকেই বলে দিল কামাই না করতে।
(ক্রমশ)