আত্মজা ————- ধারাবাহিক উপন্যাস    অধ্যায় -৭ সুদেষ্ণা সিনহা

আত্মজা
————-
ধারাবাহিক উপন্যাস
   অধ্যায় -৭
সুদেষ্ণা সিনহা

স্বাধীনতাদের বাড়িটা বাংলোর মতো,এক বিঘা জমির উপর তৈরি। দাদু,কৃষ্ণকান্ত সাহেবদের শেয়ার কাগজের অংশীদার ছিলেন। সাহেব আর্কিটেকচার দিয়ে বসত বাড়ির প্লান করান তিনি। এ পাড়ার অন্য বাসিন্দাদের চেয়ে তাদের বাড়ি গঠন অন্যরকম।

তাদের বাড়িতে নীচের এবং উপরের ঘরগুলোর চারদিকে বড় বারান্দা।উপরের বারান্দাটি একতলার সিঁড়ি অবধি এসেছে। উপরের বারান্দার  চারিদিকে বড় বড় জানলা।মেঝের এক ফুট উঁচু থেকে শুরু হওয়া জানলাগুলো কাঠের পাল্লা দিয়ে ঢাকা। খুলে দিলে হাওয়া,রোদ বারান্দায় এসে ঢোকে।

স্বাধীনতার দাদু বা বাবা দুজনেই কলকাতার জনজীবনে অভ্যস্ত ছিলেন।বারান্দা জুড়ে বড় বড়  ঠাকুর দেবতার বাঁধানো ছবি,সে সব দাদুর আমলের। তার মধ্যে একটা ছবি রামচন্দ্রের।ছবিটা ঠাকুর ঘরের প্রবেশ পথের মাথার উপরে  ঠিক মাঝখানে টাঙানো আছে।এই ছবিটাতে যে দিক দিয়েই দেখা হোক না কেন মনে হয় তার দিকে তাকাচ্ছে।
ছোটবেলায় দাদাভাইয়ের সঙ্গে তার ঝগড়া লাগতো।
শশী বলত,ছবিটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
স্বাধীনতা বলত,না আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
এই নিয়ে জোর ঝগড়া শুরু হলে মা সরমা বলতেন,দূর তোরা দুজনেই বোকা। এই ছবিটা এইভাবেই তৈরি যেদিক দিয়েই তাকানো যায় না কেন ,যে দেখছে তার মনে হবে যে তার দিকেই চেয়ে রয়েছে।

আরো কিছু ছোট ছোট বাঁধানো লেখা টাঙানো আছে তাদের উপরের বারান্দায় যেগুলো খুব অর্থবহ এবং প্রাসঙ্গিক।
এদের মধ্যে একটা বাঁধানো ছবিতে এক মাঝি নৌকা চালাচ্ছে,মাথার উপরের আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে।লাল আকাশের গা ঘেঁষে দুটো লাইন:
দিন যায়,
কথা থাকে ।
সত্যিই দিন চলে যায়,ঘটনা যা ঘটে যায় তা মনের কোণে রয়ে যায় !

দাদুকে দেখেনি স্বাধীনতা ।তার জন্মের আগেই দাদু মারা যান । তার দাদা শশীও দাদুকে দেখে নি। ঠাকুমা বলতেন,দাদু খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন।ইংরাজ সাহেবদের সঙ্গে দাদুর খুব ভালো সম্পর্ক ছিল।
ঠাকুমা আরো বলতেন,তোর বাবা খুব ভাল ইংরাজি বলতে পারত বলে কাস্টমস অফিসের চাকরিতে তোর বাবাকে ডেকে নিয়েছিল সাহেবরা।তোর দাদু মারা যেতে সেই চাকরি ছেড়ে দিল তোর বাবা। বাড়িতে একমাত্র পুরুষ মানুষ তোর বাবা।কি বা করবে বল!ঘরে জোয়ান বউ।  আমি বয়স্কা মহিলা।আমরা কি করে থাকব বহরমপুরে একা একা।তোর বাবাকে বললাম,শ্যামা চাকরি ছেড়ে চলে আয় এখানে।

স্বাধীনতার খুব গর্ব হয় তার বাবার জন্য। ভাগ্যিস বাবা তার নাম রেখেছিলেন স্বাধীনতা! বন্ধুরা বলে,কি সুন্দর তোর নামটা!
স্বাধীনতা নামের মাহাত্ম্য হৃদয় দিয়ে ছুঁতে চায় সে।
পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল মীরজাফর।সেদিনই বাংলার স্বাধীনতা হরণ করে নিয়েছিল ইংরাজরা।তারপর কত আত্মবলিদান!কত প্রাণদান! শুধু স্বাধীনতা লাভ করার জন্যে।

বাবা বড্ড ভালবাসতেন তাকে। আদর করে ডাকতেন,স্বাধীন,স্বাধীন মা আমার।
—- বাবা,ডাকছ?
——হ্যাঁ মা।কি করছ?
—–এই তো পড়ছি।
——কি পড়ছ?
—–ইংরাজি বাবা।
—-আচ্ছা আমি তোমাকে আজ টেন্স বুঝিয়ে দেব।
বাবার চোখে মাইনাস পাওয়ার ছিল।মোটা,ঘোলাটে,ভারি কাঁচের গোল গোল চশমা। বাবার চশমাটাকে ছোটবেলায় স্বাধীনতার মনে হতো বোতলের তলার মোটা কাঁচ দিয়ে তৈরি। বাবা কোনদিন বই হাতে ধরে পড়তেন না। স্বাধীনতাকে বলতেন,পড় তো মা  কি লেখা আছে।
—- বাবা,লেখা আছে  what is tense …
—–হ্যাঁ মা টেন্স কাকে বলে।টেন্স হল ক্রিয়ার কাল।অর্থাৎ
ক্রিয়া বা কাজ কোন সময় সম্পন্ন হবে তা বলবে টেন্স।
বাবা বুঝিয়ে দিলে চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে উঠত পড়াটা।

বাবা বলতেন,নিজের পায়ে স্বাধীনভাবে দাঁড়ানোর নাম স্বাধীনতা।
—–বাবা তবে পরাধীনতা কি?
——অন্যের উপর নির্ভরতাকে বলে পরাধীনতা।
স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে
কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে
কে পরিবে পায় ?
কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা।মনে পড়ছে?

শশীদাদা বিএ এল এল বি পড়ল  ভাল উকিল হবে বলে।আর স্বাধীনতা কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশনের পরে বিএ বিপি এড হেস্টিংস কলেজ থেকে।
স্বাধীনতা স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছে ।মেয়েদের একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার শিক্ষিকা সে।

বাড়িতে কত পরিবর্তন এল এই কয়েক বছরে।ঠাকুমা মারা গেছেন।বাবা মারা গেছেন।বাড়িতে সে,মা আর দাদা। মায়ের শরীরটা ভালো নেই। বসতবাড়িটুকু ছাড়া বাকি সব জমিজমা লোক ডেকে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে।এখন জমি রাখা মানে উটকো ঝামেলা।

বহরমপুর থেকে ট্রেনে মাত্র দশ মিনিট।রাস্তার উপরেই স্বাধীনতার স্কুল।সারগাছি রেলস্টেশনে নেমে একটা রিক্সা নিয়ে নেয় স্বাধীনতা। টুংটাং হর্ণ বাজিয়ে রিক্সাওয়ালা ছোটে।
স্টেশন থেকে রিক্সায় প্রায় দশ মিনিট।স্টেশন ছাড়িয়ে গ্রামের রাস্তা ধরে ছুটে চলে রিক্সা। হলুদ সর্ষে ফুল ফুটে আছে জমি জুড়ে।কোন কোন জমিতে পেয়ারার চাষ করা হয়েছে। পাখি ঠুকরে দেবে বলে প্লাস্টিকের মধ্যে পেয়ারাগুলোকে  ভরে রাখা হয়েছে।
যে রাস্তা ধরে রিক্সাটা ছুটছে  তার দু’পাশে জমিতে মটরশুঁটি গাছ আকর্ষ জড়িয়ে  ওঠার চেষ্টা করছে। গ্রামে এখন টুকটাক খাবারের দোকান হয়েছে।
বড় ছানার ডেকচি নিয়ে একটা লোক মিস্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কি সব বচসা করছে কে জানে!
সাড়ে দশটার মধ্যে স্বাধীনতা পৌঁছে গেল স্কুলে। সবে গেট খোলা হয়েছে। দুই একটা করে মেয়ে এসে ঢুকছে স্কুলে। দশটা চল্লিশে একটা ঘন্টা দেওয়া হয় , সেটা প্রেয়ারের।

প্রেয়ারের ঘন্টা পড়লে মেয়েরা হুড়মুড় করে মাঠে নেমে আসে।স্বাধীনতা গলা তুলে বলে, সাবধান,
লেফ্ট-রাইট-লেফ্ট-রাউট-লেফ্ট। সাবধান-বিশ্রাম।
মেয়েরা দলে দলে পা মেলায়।
—— এবার মেয়েরা প্রার্থনা শুরু করে।
শিবের মন্ত্র:প্রভুমি,শমনি,শমশেষ,গুনম্….
তারপর জাতীয় সঙ্গীত– জনগণমন অধিনায়ক জয় হে……

প্রার্থনা শেষে মেয়েরা লাইন করে ঘরে ঢোকে। টিচাররা প্রার্থনা শেষ করে ঘরে ঢোকে।
স্বাধীনতা উপস্থিতির গাতা ও চক ডাস্টার এনে টেবিলের সামনে রাখে  ঘন্টা পড়লে ক্লাসে যাবে সে। কোন কোন .শিক্ষিকা ঘন্টা পড়লেও ক্লাসে যেতে দেরী করে অযথা। জল খাবে।কিছুক্ষণ পাশের শিক্ষিকার সাথে কথা বলবে।দু’একবার পুরোনো কথা মনে করবে । এসব করে অযথা সময় নষ্ট করার কিছু মানে আছে!
গাটা রি রি করে ওঠে স্বাধীনতার। তবুও সে কিছু বলতে চায় না।সে নিরীহ মানুষ। কোন ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট তার একদম ভালো লাগে না।

বাড়ি ফিরে কিছুক্ষণ মায়ের সাথে কথা বলে সে।সংসারের খুঁটিনাটি ব্যাপার মায়ের কাছে জেনে নেয়। প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলায় তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে, ধূপকাঠি দেখিয়ে সে শাঁখ বাজায়।

মা বলে,তুই চলে গেলে আমার কি হবে রে , সাধু?
স্বাধীনতা মিস্টি হাসে।
—- তবে মেয়েকে কাছে রাখতে চাও? ঠিক তো?  বাইরে তাড়ানোর জন্য আর কোনদিন কারোর সাথে কথা বলবে না?

—— তাই বললে হয় মা? মেয়েকে কি ঘরে রাখতে পারব মা?
—–খুব পারবে।
—– লোকজন কি বলবে? তুই তো সব বুঝিস।

সন্ধ্যেবেলায় বড়মামা হৈ চৈ করে বাড়ি ফিরলেন।মা বাড়িতে আলুর চপ বানিয়েছিলেন। একটা প্লেটে চা জলখাবার গুছিয়ে বড়মামাকে খেতে দিলেন।
—–স্বাধুর একটা বিয়ের  সম্বন্ধ এসেছে। ছেলে মাস্টারি করেন। তোমার পছন্দ তো ,মা?
——তোরা যা ভাল বুঝবি,করবি। বুঝলি রে।
স্বাধীনতা বুঝল  এখন এখানে তার না থাকাই ভালো।
ধীরে ধীরে ছাদে উঠে গেল স্বাধীনতা। এক আকাশ তারার নীচে হারিয়ে গেল স্বাধীনতা।

1 thought on “আত্মজা ————- ধারাবাহিক উপন্যাস    অধ্যায় -৭ সুদেষ্ণা সিনহা

  1. খুব ভালো লাগল লেখাটি পড়ে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *