# সীমান্ত # পর্ব – ৬ কলমে – অরণ্যানী
# সীমান্ত # পর্ব – ৬
কলমে – অরণ্যানী
ছোটবেলা থেকেই মেঘ অমিশুক প্রকৃতির। খুবই স্বল্পভাষী। একাই নিজের মনে থাকে। বড় হওয়ার পর ছোট ছেলে মেয়েগুলোর সঙ্গে তাও একটু ভাব আছে। তাদের তীর-ধনুক বানিয়ে দেয়, গুলতি বানিয়ে দেয়, গুলতি দিয়ে ফল পেড়ে দেয়।তবে কথা খুব কমই বলে। সমবয়সীরা তার স্বভাবের জন্য মেঘকে দেখেও দেখতে পায় না। বেশিটা সময় সে একাই থাকে। হাতের টিপ মেঘের অসাধারণ। ছোটবেলা থেকে একা থাকার ফলে, তীর-ধনুক বা গুলতি নিয়ে টিপ প্র্যাকটিস করাটা ওর একটা খেলার মধ্যে পড়ে। হাতের টিপের জন্য দলপতি ওর উপর খুবই সন্তুষ্ট। কারণ প্রায় রোজই ও কিছু না কিছু শিকার করে আনে। সকলে সাধারণত দল বেঁধে শিকারে যায়। কিন্তু মেঘ একাই শিকারে যায়। দলপতি অনেক সময় বিপদের আশঙ্কায় তাকে দলের সঙ্গেই থাকতে বলেছে। কিন্তু দলের সঙ্গে গেলেও সে কখন যে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে— আঁধার হওয়ার আগে তার সন্ধান পাওয়া যায় না। একেবারে বাসস্থানে শিকার নিয়ে সে উপস্থিত হয়।
সকাল থেকেই মেঘ আপন খেয়ালে ঘুরে বেড়ায়। কখনো নদীর ধারে বসে থাকে, কখনো গাছের উপরে বা নিচে, কখনো বা উদ্দেশ্য বিহীন ভাবে গভীর জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। এভাবে কৈশোর পার হয়ে সে পূর্ণ যৌবনে পা দিয়েছে। চেহারা তার সুগঠিত। কৈশোর থেকে একা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবার ফলে আজ এ জঙ্গলের সমস্তটাই তার খুব পরিচিত।
আসা যাক বর্তমান কাহিনীতে। আঠারো বছরের পূর্ণ যুবক মেঘ মোটেই পরিপাটি নয়। আদিবাসী অল্প বয়স্ক ছেলে মেয়েরা উৎসব অনুষ্ঠানের দিনে সাজে। চুলে তেল দেয়, পরিপাটি করে আঁচড়ায়, গা হাত পা নিয়মিত পরিষ্কার করে। কিন্তু মেঘ এগুলো কিছুই করে না। ফলে তার মাথার ঝাঁকড়া চুল ধুলো ময়লায় মলিন ও জট পড়া। পোশাক সর্বদাই মলিন। চোখের দৃষ্টিতে তার অদ্ভুত কোন গভীরতা বা অন্যমনস্কতা তা বোঝা যায় না। মুখে হাসি নেই। তাবলে দুঃখেরও কোনো ছাপ নেই। শুধু আছে দু’চোখ ভরে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা।
আজ মেঘ চলেছে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। এ জঙ্গল তার চির পরিচিত বাসভূমি। সে জানে এক স্থানে গিয়ে এ জঙ্গল শেষ হয়েছে। সেখানে দেশের সীমানা। সেই সীমানা পার হওয়া মানা। সীমানায় পাহারা দিচ্ছে কত শত শত সেনা! এরা একরকম পোশাক পরা। আবার ওদিকে রয়েছে অন্যরকম পোশাক পরা আর এক সেনাদল। যে যার দেশকে পাহারা দিচ্ছে। আজও মেঘ সেই সীমানার কাছে জঙ্গলে এসে বসল একটা বড় গাছের তলায়। সেখানে বসে সেনাবাহিনী কিভাবে পাহারা দেয় দেখতে লাগলো। এই সীমানা পার হলেই অন্য দেশ! কে জানে কেমন সেই দেশ। সেনা – – – সেনা – – – আর সেনা। দেশটা তো দেখাই যায় না। হ্যাঁ, অনেক দূরে ওপারে একটা জঙ্গল আছে। ওটাই আর একটা দেশ?!
ধীরে ধীরে বিকেলের রোদ পড়ে এলো। এদিকে ঘন জঙ্গল। তাড়াতাড়ি অন্ধকার নামে। মেঘ চারদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর খেয়াল হলো, শিকার তো আজ কিছুই করা হয়নি। খালি হাতে যাব কী করে? বলা বাহুল্য যে তার সঙ্গে তীর-ধনুক আছে। তাই বাসস্থানের পথে এগোতে গিয়ে সে অন্য পথ ধরল। মেঘ এখন ভালোই জানে এ জঙ্গলের কোথায় কোন প্রাণীদের দেখা যায়। সে একটা গাছের উপর উঠে অন্ধকার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। অন্ধকার নামতেই তীর-ধনুক নিয়ে প্রস্তুত হয়ে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টিপাত করতে থাকলো। এখন ওর চোখের দৃষ্টি গেল পাল্টে। ভীষণ উজ্জ্বল আর তীক্ষ্ণ সে দৃষ্টি। আশপাশে খসখস শব্দ ও শিয়ালের ডাক শোনা গেল। দেখতে দেখতেই অন্ধকার তখন কালো হয়ে এসেছে। এবার খসখস শব্দ হতেই মেঘ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অন্ধকারের মধ্যে কিছু দেখার চেষ্টা করলো ও তীর ছুঁড়ে দিলো। পর মুহূর্তেই গাছ থেকে লাফ দিয়ে নেমে আশপাশে কিছু খুঁজতে লাগলো। একটা গর্ত চোখে পড়তেই গাছের ডাল ভেঙে তাই দিয়ে গর্তের মুখ বড় করে, গর্তের মধ্যে থেকে একটা তীর বিদ্ধ খরগোশ বের করলো। তীরটা শরীর থেকে খুলে নিয়ে সাবধানে সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাতে তাকাতে সে দ্রুত বাসস্থানের দিকে এগোল।
আদিবাসীদের উৎসব :- মেঘ যখন তার বাসস্থানের কাছে এলো, ততক্ষণে ওদের উৎসব শুরু হয়ে গেছে। বড় করে একটা অগ্নিকুন্ড তৈরি করা হয়েছে। সেই অগ্নিকুন্ডকে ঘিরে আনন্দের সঙ্গে নৃত্য ও গীত করছে জনা পঞ্চাশেক মানুষ। যুবক যুবতীরা অনেকেই জোড়ায় জোড়ায় কোমর ধরে নৃত্য ও গীত করছে। অনেকে শিকার করা পশুর মাংস আগুনে ঝলসে নিচ্ছে। সকলেই নানান রং বে রংয়ের নতুন পোশাকে সুসজ্জিত।। নারী পুরুষ সকলেরই বনফুলের মালা গলায় ও হাতে। মেয়েরা মাথার খোপাতে ফুলের মালা দিয়েছে। আগুনের আলোয় চারপাশের জঙ্গল আলোকিত। অনেকটা দূর থেকেই মেঘ ওদের সঙ্গীতের ধ্বনি শুনতে পেল। মেঘের মনে পড়ল যে আজ উৎসব।
মেঘ জায়গাটিতে এসে পৌঁছলে সকলের মনে পড়ল যে ও এতক্ষণ ফেরেনি। দু এক জন পুরুষ ওকে জিজ্ঞেস করল যে এতো দেরি হলো কেন। মেঘ কোনো কিছু গ্রাহ্য না করে দলপতির দিকে এগিয়ে গিয়ে তার শিকার করা খরগোশটা দলপতিকে দিল।
দলপতি – এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
মেঘ অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখিয়ে বললো – ওই যে, ওইদিকে।
দলপতি – এতক্ষণ কী করছিলে? অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। নাও ধরো। নতুন কাপড় পরো।
মেঘ দলপতির কাছ থেকে সবুজ রঙের একটা নতুন কাপড় নিল।
এক মহিলা এগিয়ে এসে বললো — ওমা! আগে নদী থেকে ভালো করে নেয়ে এসো।গায়ে মাথায় কত ময়লা না।
যুবতী মেয়েরা ওকে দেখে হেসে উঠলো। মেঘ চলে গেল নদীতে স্নান করতে।
ওদিকে উৎসব চলতে থাকলো। বয়স্করা বড় বড় পিস্ করে ঝলসানো নানান পশুর মাংস, ফলমূল, বড় বড় কলাপাতা ও শাল পাতায় সাজিয়ে রাখলো। কয়েকজন মৌচাকের মধু, ও নানান ফল পচিয়ে মাদক দ্রব্য তৈরি করে মাটির কলসি করে রাখলো খাবারের পাশে। সঙ্গে কয়েকটি মাটির মালসাও। সকলে নৃত্যগীত করতে করতেই মাংস তুলে খেতে লাগলো, কেউবা কলসি থেকে মালসায় ঢেলে পান করতে লাগলো মাদক দ্রব্য।
ওদিকে মেঘ নদীর ঘাটে এলো স্নান করতে। আগুনের আলো নদীর ঘাটে গিয়েও পড়েছে। নতুন কাপড় পাশে রেখে মেঘ ঘাটে বসল। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল বিকেলে দেখা সীমান্ত। এপার থেকে দেখা যায় ওপারের জঙ্গল। আবার এপারের উৎসবের ছবি ভেসে উঠল ভাবলো, ওপারের জঙ্গলেও কি এরকম উৎসব হয়? কেমন মানুষ থাকে সেখানে? নাকি সবই অন্যরকম। নতুন কোনো রকম হবে। নদীর জলে আগুনের আলো। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। মেঘ হীন পরিষ্কার আকাশ। মেঘ নদীর জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। কিন্তু উৎসবের কলরব কানে এসে পৌঁছতেই ঘোর কাটলো। তাড়াতাড়ি নদীতে নেমে ডুব দিয়ে চুলের ও গায়ের ময়লা পরিষ্কার করে, ঘাটে এসে নতুন কাপড় পরে, সকলের কাছে গেল। হাসি কলরবের মধ্যে দিয়ে উৎসব তখন পুরোদমে চলছে। মেঘ দেখলো, অনেক যুবক তার বউ বা প্রেমিকাকে গ্রামের হাট থেকে কেনা চুড়ি, বালা, ফিতে ইত্যাদি দিচ্ছে। দু জোড়া যুবক যুবতীর আজ সাদি হচ্ছে। তারা পরস্পর মালা বদল করছে, পরস্পরকে লাল চন্দনের টিপ পরিয়ে দিচ্ছে। মেঘ অবাক চোখে ওদের দিকে চেয়ে রইলো। দলপতি এগিয়ে এলো মেঘের কাছে।
দলপতি — মেঘ, আজ তোমার সাদিটা হয়ে যাক। তুমিও তো বেশ বড় হয়ে গেছো। বলো, তুমি কাকে সাদি করবে?
যুবতীরা কলরব তুলে হাসতে লাগলো। অবিবাহিতা এক যুবতী লাজুক চোখে চেয়ে ছিল মেঘের দিকে।
মেঘ – না, আজ থাক। পরে কোনদিন – – – আমার সঙ্গে তো কিছুই নেই। কী দেবো?
এক মহিলা বললো – সে নয় পরেই দিও। দেখো না তাকিয়ে, ফুলিকে তোমার পছন্দ হয়? দলে তো আর ছেলে নেই। এরপর তো ওকে অন্যের সঙ্গে ভাগ করে স্বামী নিতে হবে। আর তখনই হবে অশান্তি।
দলের মধ্যে সবচেয়ে কমা দেখতে মেয়েই ফুলি। তাই সে একাই পড়ে আছে। বাকিদের সকলেরই সঙ্গী যোগাড় হয়ে গেছে। ফুলি চিন্তান্বিত চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে রইলো উত্তরের অপেক্ষায়। মেঘ তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। দলের সকলেই সাগ্রহে ওদের দিকে তাকিয়ে। নৃত্যগীত সমাপ্ত হয়েছে।
দলপতি – কী হলো, বলো? মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে বললো – দুটো মালা লাগবে, আর লাল চন্দন।
মেঘ – না, পছন্দ নয়।
ফুলি রাগে ফুঁসে উঠলো – তবে তোমার সাদি হবে কোথায় শুনি?
মেঘ শান্ত ভাবে উত্তর দিলো – সাদি নাহলে করব না।
মহিলা – কিন্তু ফুলির সাদি হবে কোথায় দলপতি?
(ক্রমশ)