কিছু কথা***কলমে ছন্দা চট্টোপাধ্যায় *** পর্ব -৫
ধারাবাহিক উপন্যাসিকা / কলমে ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
কিছু কথা।
পর্ব -৫।
সৌম্য ভাদুড়ির কথা।
সুনন্দা ফিসফিস করে হিসহিসে গলায় বললো-‘ঐ যে এসে গেছেন তোমার গুণবতী বোন।-‘ দীপের বড় শালী ইলা সুনন্দাকে বললো-‘ সত্যই নন্দাদি,পায়ের চপ্পলটা দেখো, ক্ষয়ে গেছে। পড়নের ছাপা শাড়িটাও রং ওঠা। কেমন করে আত্মীয় বলে পরিচয় দেবে? লজ্জাও করে না?’- আমি মাথা নিচু করে রইলাম। খুকু যে আমারও ছোট বোন। তবু আমি কিছু বলতে পারলাম না। আমার সব অসহয়তা আর রাগ গিয়ে পড়লো খুকুর ওপর। -‘কেন এসেছিস দরদ দেখাতে? জানিস কি অসুখ দীপের? ব্লাড ক্যান্সার! চিকিৎসার খরচ নিয়ে কোন ধারণা আছে তোদের? আমার পক্ষে এতো দেওয়া সম্ভব নয়।পারবি আদরের ভাইয়ের চিকিৎসায় কিছু সাহায্য করতে?’- খুকু বললো -‘দাদা,আমি রক্ত দিলে হবেনা? আমাদের ব্লাডগ্রুপ তো একই।’- আমি বললাম -‘তোর ওজন কতো? নিজেই খেতে পাস না। ডাক্তার তোকে এ্যালাও করবে? ইলা বলে উঠলো-‘দাদাভাই, চিকিৎসার খরচ তো মনোজই দিচ্ছে। আমার বোনের দায়িত্ব, ভগ্নিপতির চিকিৎসার দায়িত্ব তো আমাদেরই নিতে হবে। আপনার মায়ের সঙ্গে সেই চুক্তিই তো হয়েছিল।’- আমার মাথা হেঁট হয়ে গেল। সুনন্দা কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণে স্থিরবুদ্ধি। উত্তর দিলো-‘চুক্তি তো মায়ের সঙ্গে হয়েছিল ভাই। আমাদের সঙ্গে তো কেউ পরামর্শ করেনি। তবু আমরা মা যতদিন বেঁচে ছিলেন খোরপোষের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। দীপের রক্ত কেনার জন্যেও কিছু দিয়েছি। কাকলিও সাধ্যমতো কিছু দিয়েছে।’- আমি কথা বাড়াতে চাইছিলাম না। হাসপাতালের করিডরে এই কথা কাটাকাটি শুনে লোকেরা ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিলো। আমি সকলকে নিয়ে দীপের কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
আমাদের প্রায় নিঃশব্দ পদধ্বনিতেও দীপের আলোহীন চোখের মণি দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আশ্চর্য! দর্শনেন্দ্রিয় নিষ্ক্রিয় হলে কী শ্রবনেন্দ্রিয় অতি তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে? ওর বিমর্ষ পাণ্ডুর মুখমণ্ডলে ফুটে উঠল সেই অনাবিল ছেলেমানুষী হাসিটা! মনে পড়লো, ও যখন বছর দুয়েকের মায়ের একটা অপারেশনের জন্য মাকে কয়েকদিনের জন্য হাসপাতালে থাকতে হয়েছিলো।সে সময়ে একজন কাজের মাসি আমাদের রান্না করে দিতেন।আমি সকালের টিউটোরিয়াল থেকে ফিরতেই দীপ টলমলে পায়ে দৌড়ে এলো -‘ দাদা,দাদা, মা হাঁপ্পাতালে, মাচি আচেনি, আমি ভাত কাবো।’- আমি তখন আঠারো বছরের তরুণ।মধ্যবিত্ত পরিবারের বড়ো ছেলে। কলেজে পড়ি,
আবার টিউটোরিয়ালে শিক্ষকের কাজও করি। মায়ের অল্প বয়সের সন্তান,তাই মোটামুটি ঘরের কাজ জানি। কিন্তু রান্না! অপটু হাতে উনুন ধরিয়ে আলুসেদ্ধ ভাত রেঁধে ভাইকে দিতেই কী উচ্ছল হাসি!
সেই দীপ! ক্লিষ্ট হাসিটা জোর করে ঢাকতেই যেন জোরে হেসে বলে উঠলো -‘বাহ্! সবাই এসেছে। দাদা,বৌদি, রাঙাদি, মিষ্টিদি! আর আমার কোনো কষ্ট নেই।’- শ্রীলার শাড়িটায় হাত বুলিয়ে বললো -‘এই তো সেই লাল সিল্কের শাড়ীটা। বিবাহবার্ষিকীতে দিয়েছিলাম।’- আমাদের বিস্ময় উত্তরোত্তর বাড়ছিল। দীপ তো দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে! শুধু শ্রীলার গাল বেয়ে নিঃশব্দ জলের ধারা গড়িয়ে নামছিলো। পরে জেনেছিলাম শ্রীলাকে ওই-ই চুপিচুপি বলে রেখেছিলো যেদিন সবাই একসঙ্গে আসবে শ্রীলা যেন লাল শাড়িটা পড়ে আসে। দীপ বললো-‘ আমাকে একটু ছোঁয়া দাও, বলে দেবো তুমি কে।’- খুকু ছুঁতেই বললো-‘মিষ্টিদি, ছোট ভাইকে দেখতে এসেছিস, লজেন্স কই?-‘ খুকু লজেন্স হাতে দিতেই কী অকপট হাসি! নন্দা সেই লজেন্স ছিনিয়ে নিয়ে বিনে ফেলে দিলো। -‘ন্যাকামো হচ্ছে? এখন ও লজেন্স চুষতে পারবে? ব্লাড কিট লাগানো আছে, মুখ দিয়ে কিছু খেতে পারছে না,দেখে বুঝছিস না নেকু-খুকু? আদিখ্যেতা!’- খুকু ব্যাগ থেকে দুটো পেয়ারা বের করে বিনে ফেলে দিলো। ওর গাছের ফল। নন্দা আর ইলার মুখ দুটো বিভৎস বিদ্রুপের হাসিতে বিকৃত হয়ে গেল। শুধু দীপ খুকুকে কাছে টেনে আন্দাজে চোখ মুছিয়ে বললো-‘ ছিঃ খুকুমনি, কাঁদতে নেই। তোর ভাই তোরই থাকবে মিত্তিদিদি।’-
ভিজিটিং আওয়ার শেষ। মৃত্যুপথযাত্রী ভাইটিকে একা ফেলে আমি সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম।