#ইচ্ছেপূরণ *** কলমে -ছবি ব্যানার্জি
#ধারাবাহিক / কলমে -ছবি ব্যানার্জি
#ইচ্ছেপূরণ
পর্ব–৬
বাড়ি ঢুকে বীথি চুপচাপ নিজের ঘরে চলে যাচ্ছিল।অনুরাধা বলল–এত তাড়াতাড়ি চলে এলি যে?মুখ চোখের এমন অবস্থা কেন?শরীর ভালো আছে?বীথি বলল–ঠিক আছি মা।আজ কি একটা কারণে লাস্ট তিনটে ক্লাস হয় নি।
নিজের ঘরে গিয়ে বীথি অবনীকে ফোন করল।অবনী ফোন ধরে বলল–কোনো সমস্যা?বীথি বলল–তুমি কোথায়?–আমি প্রয়োজনীয় কিছু শপিং করছি। এখন যা মনে পড়ছে সেগুলো কিনছি।পরে লিস্ট করে বাকি জিনিস কিনব। ফ্ল্যাটে রান্নার গ্যাস থাকলেও রান্নার বাসন টাসন তেমন নেই।আসলে আমি দিনে অফিস ক্যান্টিনে খাই।আর রাতে হোম ডেলিভারি কিংবা অনলাইনে খাবার এনে খাই। আজ বৃহস্পতিবার।এই সোমবার তুমি রেডি হয়ে বেলা সারে দশটা নাগাদ চলে এসো।ওইদিন আমরা রেজিস্ট্রি করব।আর এই দুটো দিন কলেজ যেও না।ঠিকানাটা তোমাকে হোয়াটস আপে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আগামী কাল থেকেই তোমার আমার লড়াই শুরু হবে।
বীথি বলল–সরি অবন,আমি তোমাকে বিরাট অসুবিধায় ফেলে দিলাম।–আমি সব কিছুতে অভ্যস্ত বীথি।অসুবিধাটা তোমার হবে।আচ্ছা তোমার সংগে হাল্কা হলেও একটা লাগেজ তো থাকবে। সবচেয়ে ভালো হয় তুমি যদি একটা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে চলে আসো। আমি তোমার ব্যবহার্য্য সব জিনিস না হয় কিনে রাখব।
বীথি বলল–বারে আমার পোশাক আর নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিস তো নিতেই হবে।আমি একটা ট্রলি সুটকেস আর একটা ট্রলি ব্যাগ নেব।
অবনী বলল–ওগুলো সংগে নিয়ে কি রেজিস্ট্রি অফিসে যাবে? তুমি বরং সোজা মানিকতলা স্টপেজে অপেক্ষা কোরো।আমি লাগেজ ফ্ল্যাটে রেখে তারপর বেরোব।বীথি আরও একবার বলছি সত্যিই তুমি কাউকে জানাবে না? এখনও দুটো দিন হাতে আছে।ঠান্ডা মাথায় একবার ভেবে দেখো।আমরা রেজিস্ট্রির পর দুজনে একসংগে গিয়ে সবাইকে জানাতে পারতাম।ভেবে দ্যাখো আমরা ভুল করেছি কিন্তু অপরাধ করিনি।
বীথি বলল–আমি ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি অবন।আমি কথা দিচ্ছি সবরকম অবস্থায় আমি মানিয়ে নেব।–ঠিক আছে আমার যা ভালো মনে হয়েছে বললাম।এবার সিদ্ধান্ত তোমার।
বিকেলে চা করে বীথি বাবা মাকে দিয়ে বলল–মা কাল আমার কলেজ নেই।আমি সোমবার একবারে কলেজ যাব।মা বলল– সে না হয় হল।কিন্তু তুই চা করলি যে?আজ কোনদিকে সূর্য উঠল রে।জীবনে তো এক গ্লাস জল গড়িয়ে খাস না।বীথি বলল–কখন করব? আমি ইচ্ছে করলে সব করতে পারি।কিন্তু কলেজ পড়াশোনা নিয়ে সময় কোথায়? আজ রাতের চিকেনটাও আমি রান্না করব। দেখবে কেমন রান্না করতে পারি।এখন চা টা খেয়ে বলো তো বাবা কেমন হয়েছে?অরুণাভ বললেন–দারুণ হয়েছে।একদম লিকার ফ্লেভার পারফেক্ট।কিন্তু তোর মুখটা এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন মামণি? মায়ের কাছে বকা খেয়েছিস?
অনুরাধা বললেন–তোমার মেয়ে তো নবাব নন্দিনী।সে আমার বকুনিকে থোড়াই কেয়ার করে।তার ওপর যদি বাবার আস্কারা থাকে।তোমার তো যতো শাসন ছিল দুই ছেলের বেলায়।অরুণাভ বলল– বীথি মা আমার বরাবরের লক্ষী মেয়ে।ওকে কোনোদিন শাসন করার দরকারই হয়নি।
বীথি মনে মনে বলল–বাবা তোমরা কি একবারও কল্পনা করতে পারছ এই সোমবার তোমার মেয়ে তোমার সব বিশ্বাসকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে চিরদিনের জন্য এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।এ ছাড়া যে আমার কোনো বিকল্প উপায় নেই বাবা।আমি জানি তোমরা জীবনে কোনোদিন আমাকে ক্ষমা করবে না,আমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবে না। কষ্টে অনুশোচনায় আমার বুকটা ভেঙে যাচ্ছে সেটাও তোমরা কখনও বুঝবে না।শুধু অবনীর ভরসায় এক অনিশ্চিত জীবনের দিকে বাধ্য হয়ে আমাকে পা বাড়াতে হচ্ছে।
সোমবার বীথি স্নান করে দুই দাদা বৌদির সংগে একসংগে খেতে বসল।দাদা বৌদি বেরিয়ে গেলে মা বলল–তুই আজ বেরোতে এত দেরি করছিস কেন? গেট বন্ধ করে আমি এবার ঠাকুর পুজো করতে ঢুকব।বীথি বলল–মা আমার প্রথম দুটো পিরিয়ড অফ আছে।তুমি পুজো করতে যাও।আমার কাছে তো চাবি আছে।আমি একটু পরে চাবি দিয়ে চলে যাব।
অনুরাধা মেয়ের দিকে একঝলক তাকিয়ে বলল—আজ হঠাৎ শাড়ি পরলি যে?হাতে বালা গলায় চেনও পরেছিস।আমি বলে বলেও তোকে কখনও পরাতে পারিনি।নতুন বানানোর পর তোর বাবার কথায় দিনকতক পরে বলেছিলিস গয়না পরা আজকাল ব্যাকডেটেট।
বীথি বলল–মা আজ আমার একটা বন্ধুর জন্মদিন। কলেজ ছুটির পর রেস্টুরেন্টে সবাই কে খাওয়াবে।আজ সবাই শাড়ি পরে আসবে বলেছে।–বেশ রাত করিস না।সিনেমার প্রোগ্রাম নেই তো?–না মা,আজ শুধু একটু আধটু শপিং করা আর খাওয়ার কথা।
মা ঠাকুর ঘরে ঢোকার পর বীথি ওপর থেকে দুদিন আগে গুছিয়ে রাখা দুটো ট্রলি ব্যাগ খুব সাবধানে নামিয়ে আনল।রাস্তায় বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা মানিকতলায় নামল।অবনী অপেক্ষা করছিল। অবনীর ঝকঝকে চেহারা দেখে কে বলবে সে একটা বিরাট দায়িত্বের বোঝা বিনা প্রস্তুতিতে নিজের কাঁধে হাসিমুখে নিতে চলেছে।অবনী বলল– এত নার্ভাস লাগছে কেন তোমাকে?আমরা তো ভালোবেসে ঘর বাঁধছি বীথি।জীবনের সব দুঃখ কষ্ট আনন্দ আমরা দুজনে ভাগ করে পথ চলব।কিন্তু তুমি এত কি আনলে বলো তো? বীথি বলল–সব দরকারি জিনিস মশাই।তোমার ফ্ল্যাট কতদুরে?–তিন মিনিটের হাঁটা রাস্তা।
ফ্ল্যাটে ঢুকে বীথি বলল–বাহ্ বেশ গুছিয়ে রেখেছো তো?–রাখব না?স্বয়ং রাজকন্যা আসছে গরিবের কুটিরে।বিয়ে করে এসে মোমবাতি জ্বালিয়ে আমিই তোমাকে বরণ করব।আমার সাধ্যমতো তোমাকে ভালো রাখার চেষ্টা করব।কিন্তু সারাটা দিন তোমাকে একা থাকতে হবে।আমি না হয় টিউশন ছেড়ে দেব।বীথি বলল–আমাদের সামনে এখন অনেক খরচ অবন।টিউশনি ছেড়োনা।আমি ঠিক থাকতে পারব।
রেজিস্ট্রি হয়ে গেল।অবনীর তিনজন বন্ধু সাক্ষী দিল। ওরা সিঁদুর রজনীগন্ধার মালা সংগে এনেছিল। ওখানেই পালাবদল সিঁদুর পরানো হল।অবনী বলল–এবার তো খাওয়ার পালা শেষ হলেই বিয়ে সম্পূর্ণ।বীথি বলল–আমি তো ভাত খেয়ে বেরিয়েছি।আমি কিছু খাব না।–আমরা তো খাব।তুমি হাল্কা কিছু নিও।বন্ধুরা যাওয়ার আগে বলল–এবার আমরা আসি। তোদের দুজনকে অভিনন্দন।তোদের বিবাহিত জীবন সুখের ও দীর্ঘস্থায়ী হোক।
বীথির মনটা বিষন্ন হয়ে গেল।কি অনাড়ম্বরে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই তার বিয়েটা হয়ে গেল।অথচ এই দিনটা নিয়ে বাবা মা তার নিজের কত স্বপ্ন ছিল।বাবা একবারে পারবে না বলে একটা একটা করে গয়না বানিয়ে রেখেছিল। মা রাগারাগি করে বলত–তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি।গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল দেওয়া।কবে বিয়ে হবে তার ঠিক নেই। এখন থেকে গয়না কেনার মানে হয়?
বীথি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবল অবনীর বাবা মাও হয়তো ছেলেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে না। আপনজন ছাড়া একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মধ্যে তারা জীবন শুরু করতে চলেছে।যে জীবনে প্রতি পদে পদে শুধু সংকট আর ভয়।
ক্রমশ–